আয়কর ও আমদানি নীতির সমন্বয় দরকার

শামসুল হুদা : আমদানি নির্ভর আমাদের অর্থনীতি। এখানে আমাদের ডলারের সংকট হলে তো খুবই খারাপ কথা এবং সেখানে হয়তো অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে আমরা দেখছি বিভিন্ন আমদানির ওপর বিভিন্ন ধরনের বাধ্যবাধকতা দিচ্ছে। আমরা গত টার্মে দেখতে পেয়েছি যে খাদ্যতে আমাদের বিশ্লা একটা টাকা মানে বৈদেশিক মুদ্রা চলে গেছে। সেটা একটা ব্যাপার এবং আরেকটা ব্যাপার সরকার বলছে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ। হ্যাঁ, ক্যাপিটাল মেশিনারিজে আমাদের টাকা যাবেই। সেখানে যে আমাদের সরাসরি ক্যাপিটাল মেশিনারিজে আমাদের টাকা গেলে আমাদের আমদানি বেড়েছে, আমাদের বিনিয়োগ বাড়ছে তা না।

ক্যাপিটাল মেশিনারিজে আমদানি আমাদের দেখতে হবে যে আমরা যে সমস্ত মেশিনারিজ ব্যবহার করছি সব মেশিনারিজেরই বয়স হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে টেক্সটাইল সেক্টরে। অনেকেরই এখানে পুরো ইন্ডাস্ট্রিজই বাতিল করে নতুন করে আবার রিডাকশনে যেতে হচ্ছে।

কারণ তাদের ওই পুরানা মেশিন দিয়ে বর্তমান বাজারকে হিট করতে পারছে না। তো এসবের ক্ষেত্রে যে আগের এমপ্লয়মেন্ট খুব একটা বাড়বে তা না। তবে আমাদের মেশিনারিজগুলো আপডেট হবে এবং আমাদের প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে।

এই জন্য আমাদের আমদানিতে ক্যাপিটাল মেশিনারিজের পিছনে এখানে বড় একটা খরচ দুই তিন বছর পরপর হয়তো আসতেই পারে। এটাকে স্বাভাবিকভাবে ধরে নিতে হবে। তারপরে আমাদের আরও দেখতে হবে যেহেতু আমাদের গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে এবং সেখানে আমাদের তেল আমদানি কতখানি বাড়ল। তার পিছনে আমাদের ডলার কতখানি যাচ্ছে। তারপরে আমরা এখন সিএনজি আমদানিতে যাচ্ছি। সেখানে আমাদের ডলার ইনভল্ভমেন্ট কত। আমদানির ওপর যদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিধিনিষেধ দিতে থাকে এবং আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে তাহলে অবশ্যই এখানে একটা প্রাইজ হাইকিংয়ের ব্যাপার আসবে। হয়তো ধীরে ধীরে দেখা যাবে আমাদের পণ্য ঘাটতির দিকে চলে যাচ্ছে।

আমাদের দেশ কিন্তু এখন একটা পর্যায় থেকে অর্থনৈতিক উন্নতিতে আরেকটা পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। দেখেন, পুঁজি বাড়ছে। বাড়ার কারণ দেখেন, গত ছুটিতে আমরা কক্সবাজারে প্রচন্ড ভীড় দেখেছি। তার মানে লোক জনের বাড়তি আয় আছে। লোকজন এখন কিছুটা আগের থেকে সচ্ছল। তাহলে তারা কী করবে? একটা লোকের যখন আয় বাড়বে, গভর্নমেন্ট যেভাবে বেতন বাড়াচ্ছে বা প্রাইভেট সেক্টরে আমাদেরও বেতন বাড়াতে হচ্ছে বিশেষ করে কর্পোরেট লেভেলে, তো তারা কী করবে? তারা কিন্তু চাল খাওয়া বাড়াবে না। তারা অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের দিকে যাবে। তাদের খরচটা ভোগ্য পণ্যের দিকে যাবে। সে জন্য অন্যান্য ভোগ্য পণ্যাদি আমদানিতে যথেষ্ট ডলার ব্যয় হবে বা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবে। সেদিকে আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

গভর্নমেন্ট যেহেতু সম্প্রতি বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরকে বেশ কিছু ছাড় দিচ্ছে। এখন পচাত্তর হাজার টাকার মোবাইল ফোনের জন্য তাকে অবশ্যই, সারা বাংলাদেশে কতগুলো আছে আমি জানি না, কতগুলো মোবাইল ফোন লাগবে। তবে আমার ধারণা, দুই তিন কোটি ডলার বাজেট করতে হবে মোবাইল ফোন আমদানির জন্য বাড়তি। যেটার ডিমান্ড ছিল না। শুধু এই মোবাইল ফোন আমদানি করলেই শেষ না। এই মোবাইল ফোনগুলো ব্যবহার হবে। সেখানে তাদের কথা বলার খরচের কোনো লিমিট নাই।

কিন্তু আমাদের দেশে যে সমস্ত কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে আমরা কথা বলছি তারা কিন্তু বিদেশি। তাদের কিন্তু লাভ বাড়বে। তারা কিন্তু তাদের লাভের টাকাটা বিদেশের মুদ্রায় নিয়ে যাবে। এটা গভর্নমেন্টের মাথায় রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের কিন্তু গাড়ি আমদানির সুযোগ দিচ্ছে। সেখানে কিন্তু তার তেলের চাহিদাও বাড়বে। সেটাও মাথায় রাখতে হবে।

এই সমস্ত চাহিদার জন্য যে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার সেটার জন্য অবশ্যই গভর্নমেন্টকে ভালো কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যবসায়ীরা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারে বা আমদানিতে তারা যেন কোনো অবস্থাতেই কোনো রকম নেগেটিভ নীতির প্রভাবে না পড়ে। তাহলে প্রাইজ হাইকিং বাড়বে।

আমাদের যেটা দেখা গেছে যে ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কন্ট্রোলের নামে, যে কন্ট্রোল অনেক আগে থেকেই করা উচিত ছিল, তো এখন আমরা হঠাৎ করে পুরো কন্ট্রোল চাপিয়ে দিয়েছি। এটা হয়তো কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কন্ট্রোলটা তো ধীরে ধীরে বাড়ানো যায়। কন্ট্রোল করতে হবে। কন্ট্রোল না করলে ব্যাংকগুলো সব দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। অভার না করে যদি আস্তে আস্তে এই পর্যায়ে আনা হতো তাহলে হয়তো হঠাৎ করে এই রকম একটা রিভার্স পরিবর্তন আমাদের ওপরে, ব্যবসায়ীদের ওপরে চাপ হতো না।

আমরা ব্যবসায়ী হিসেবে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা চাই সেটা হচ্ছে আমরা সুস্থভাবে ব্যবসা করতে চাই এবং আমরা একটা সুস্থ কর নীতি চাই। যে কর নীতিতে, যেমন আমরা ভ্যাট দিচ্ছি আবার ইআইপি দিচ্ছি। আমরা দুইটাই দেই। আর আমদানির ক্ষেত্রে আরও অনেক ধরনের এই চার্জ ওই চার্জ, সার চার্জ, এটিভি এরকম অনেক ধরনের খরচ দিতে হয়। এগুলোতে মূলত আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। কিন্তু এই সমস্ত আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণেই কিন্তু বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে সমস্ত পণ্যের দাম, কৃষিজাত পণ্য সেগুলো বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে। সেগুলোর ওপর যদিও অতটা ইফেক্ট পড়ছে না।

কিন্তু যেগুলো আমদানি নির্ভর পণ্য সেগুলোর ওপর কিন্তু যথেষ্ট ইফেক্ট পড়ছে। আমরা চাই যে আমাদের কর নীতিতে ভালো সুস্থ একটা পরিকল্পনা এবং কর্পোরেট ট্যাক্স, আমরা কিন্তু কর্পোরেট ট্যাক্স দেই। আমাদের কিন্তু হাত-পা বাঁধা। আমাদের অডিট হচ্ছে। গর্ভমেন্টের বিভিন্ন ধরনের খবরদারি আছে আমাদের ওপর। আমাদের কিন্তু কর ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় নাই। প্রায় নাই বললেই চলে। কর ফাঁকি দেওয়ার অবস্থান প্রায় শূন্যের ওপরে।

আমাদেরকে যদি তারা, আমাদের যে স্লাব আছে আয় করে এই স্লাবটাকে যদি কমিয়ে না নেয় তাহলে আমাদের পক্ষে তা খুবই দুঃসহ হচ্ছে। তবে এই ধরনের ইনকামটা যেমন আমরা এখন আটত্রিশ চল্লিশ এ রকম দিচ্ছি। তবে এটাকে কমিয়ে হয়তো পচিশ ত্রিশ এর ভিতরে নিয়ে আসলে আমাদের জন্য সহনীয় পর্যায়ে আসে। আর উৎসে আয়কর যেটা আমদানির ক্ষেত্রে সেটাকে গর্ভমেন্টের হয়তো আরও কমানো উচিত।

আমাদের যদি ফান্ড ফ্লো বাড়ে তাহলে আমরা এখানে ইনভেস্ট করব। সেই ইনভেস্টমেন্টে আমাদের হয়তো এমপ্লয়মেন্ট সৃষ্টি করবে। কিন্তু আমাদের যদি ফান্ড ফ্লো কমে যায় তাহলে তো আমাদের ইনভেস্টমেন্ট করার সুযোগ থাকবে না। না থাকলে ধীরে ধীরে এমপ্লয়মেন্ট খাতটা শীথিল হয়ে আসবে। আয়কর এবং ইমপোর্ট নীতি শুধু এই দুইটাকে সমন্বয় করা দরকার। সারা পৃথিবীতে দেখা যাচ্ছে যে ভ্যাট তিন পারসেন্ট, চার পারসেন্ট হিসেবে আর আমাদের এখানে পনের পারসেন্ট।

শামসুল হুদা
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
উইল্টস্ মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেড।

রাসেল/