ইলিশ নিয়ে কথকতা

ইলিশ নিয়ে অতি পুরাতন রূপকথাসম এক কল্পকাহিনী দিয়ে শুরু করা যাক। একদিন নদীর পাড়ে বসবাসকারী এক হরিণের সাধ হলো ইলিশের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় নামার। ইলিশকে বলতে সে রাজি হয়ে গেল। শর্ত ছিল যে হারবে তার শরীরের এক টুকরো বিজয়ীকে দিতে হবে। তীব্র সেই প্রতিযোগিতায় জয় হলো ইলিশের। হার মেনে নিল হরিণ। নিজের শরীর থেকে কিছুটা মাংস পুরস্কার হিসেবে ইলিশের গায়ে তুলে দিল। সেই থেকেই ইলিশ মাছ তার শরীরের গাদার অংশে গর্বভরে বয়ে বেড়াচ্ছে হরিণের মাংস। সেই ছোটবেলা থেকেই দাদী-নানীর কাছ থেকে এই কাহিনী শুনেই বড় হয়েছি। আজও ইলিশের গায়ে সেই হরিণের মাংসের দেখা মেলে!

এই গল্প থেকে একটা কথা পরিস্কার হলো যে ইলিশ গভীর জলের অতি দ্রুত গতির মাছ। ইলিশ তার জীবনকালে অধিকাংশ সময় সাগরে থাকলেও ডিম ছাড়ার সময় হলে সাগর থেকে (আমাদের দেশের বেলায় বঙ্গোপসাগর) চলে আসে মিঠা পানির নদীতে। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রথমে মেঘনা, সেখান থেকে পদ্মা। কখনো ধীরে, কখনো বা দৌড়ে চলে একেবারে আরিচাঘাট পর্যন্ত। এই চলার পথে মিঠা জলের সংস্পর্শে ইলিশের গা থেকে নোনা বিলীন হতে থাকে।

কাজেই ইলিশ ডিম ছাড়ার সময় ও পরে যত বেশিদূর উজানে দৌড়াবে তত বেশি তার স্বাদ হবে। তার আকার পরিবর্তন হবে, দেখতে হবে নাদুস-নুদুস, অতি আকর্ষণীয়। বলা হয় নদীর পলিমাটি, বিশেষ করে পদ্মার মাটি না খেলে ইলিশের শরীরে তেল জমে না, স্বাদও হয় না। এ কারণেই পদ্মার ইলিশের যে অনুপম স্বাদ তা অন্য কোন নদীর ইলিশে পাওয়া যায় না।

দুঃখের বিষয় পদ্মা নদীতে এখন আর ইলিশ তেমন পাওয়া যায় না। সাগর মুখেই এখন জেলেরা ইলিশ ধরে নেয়। সাগরস্থল পেরিয়ে মেঘনায় যখন আসে সেখানেই তার যাত্রা শেষ হয়ে যায়। পদ্মা নদীতে আসার তেমন সুযোগ হয় না। কাজেই মাওয়া ঘাটে বা ঢাকার বাজারে পদ্মার ইলিশ বলে যে মাছ গ্রাহকের থলিতে গছিয়ে দেয়া হয় তার প্রায় পুরোটাই ফাঁকি। আমরা যারা পদ্মা পাড়ের মানুষ, তারা জানি কোনটা কোন নদীর মাছ। ছোটবেলায় প্রথম যেদিন একা একা মাছ কেনার জন্য গ্রামের বাজারে গিয়েছিলাম, তার আগে পদ্মার ইলিশ সঠিকভাবে চেনার তালিম দেয়া হয়েছিল।

ছোট মুখ, চওড়া পিঠ এটাই হলো পদ্মার ইলিশের প্রধান চেহারা। মেঘনাসহ অন্য নদীর মাছ লম্বাটে মুখ, লম্বা দেহ নধরকান্তি হবে না। মাছ কিনে দুরু দুরু বুকে মায়ের মাছ কাটার বটির সামনে দাঁড়াতাম পরীক্ষার ফল প্রকাশের জন্য। বটিতে এক কোপ দিতেই মা বুঝে ফেলতেন এটা পদ্মার মাছ কিনা। পদ্মার মাছের ঘ্রাণও ভিন্নতর। সেটা রান্নার আগেও। আর ইলিশ যদি সত্যি পদ্মার হয় তবে সে রান্না করার সময়ই পাড়া-প্রতিবেশীদের জানান দেয়। এক ঘরে ইলিশ রান্না হলে তার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের বারো ঘরে। আজ কি আমরা সেই ঘ্রাণ পাই? আমরা যারা পদ্মা পাড়ের বা পদ্মার কাছকাছি এলাকার মানুষ তাদের মুখে পদ্মার ইলিশ না হলে রসনার তৃপ্তি হয় না। ইলিশ খাব তো পদ্মার ইলিশই খাব। সেই পদ্মাও নেই, নেই তার ইলিশও। কাজেই ইলিশ এখন আর মুখে রোচে না।

ইলিশ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক ধাপ্পাবাজি আছে। পদ্মার ইলিশ খাওয়ানোর কথা বলে হোটেল-রেস্তোরাঁয় চলছে ক্রেতাদের পকেট কাটার উৎসব। পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ বাংলার সংস্কৃতি বলে বিজ্ঞাপনের ঝলক তুলে চলছে ঠগবাজির বাণিজ্য। অনলাইনে, সুপারশপে, বাজারে, ফুটপাতে, ভ্যানে এই ভর মৌসুমে ইলিশের ছড়াছড়ি। কেজি প্রতি মূল্য ১২০০ থেকে ১২৫০ টাকা। মজার ও বেদনার ব্যাপার হলো, এরা সবাই বলে: ‘নিয়ে যান, এটা পদ্মার ইলিশ।’ এমন কী নয়া দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে বাঙালি প্রধান এলাকার মাছের বাজারে ঘটা করে সাইন বোর্ড টাঙ্গানো আছে, এখানে পদ্মার ইলিশ পাওয়া যায়। দেড় কেজি কিংবা তারও চেয়ে বেশি ওজনের লোভনীয় আকারের ইলিশ মেলে সেখানে। চার বছর দিল্লি বাসে বহুবার সেই মাছের বাজারে গিয়েছি। তবে পদ্মার ইলিশের সেই ফাঁদে পা দেইনি।

জানি, পদ্মা নদীতে আর তেমন ইলিশ আসবে না। জানি ইলিশের মৌ মৌ সেই ঘ্রাণ পাড়াজুড়ে আর কখনো ছড়িয়ে পড়বে না। তবু ইলিশের নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে পদ্মা। সেটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি। খবর-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান