কবি মিজান মালিকের ‘গল্প ছাড়া মলাট’

একটি কবিতা, তা হতে পারে চার লাইন কিংবা দশ লাইন বা হতে পারে সনেট বা কুড়ি লাইন। কিন্তু তা কখনো উপন্যাস, এমনকি আকারে ছোট গল্পের ধারে কাছেও যায় না। অথচ কয়েক লাইনের ছোট কবিতা ব্যক্ত করতে পারে একটি বিশাল উপন্যাসের চেয়েও বেশি শক্তিশালী বক্তব্য, আগ্নেয়গিরির মতো উত্তাপ। কবি মিজান মালিকের”গল্প ছাড়া মলাট”কবিতার বইটি তেমনি। এর নামটা দেখার সাথে সাথেই বোদ্ধা পাঠকরা বুঝে ফেলবে বইটির অনেক কিছু। কারণ বইটি না বলা কথার অনেক কিছু অবলীলায় বলে দেয়। বইটিতে কবি একই সাথে প্রেম, ভালোবাসা, দ্রোহ ও সমাজের কবি। তাইতো তাঁর নিজের আশ্চার্যান্বিত হতাশাও শব্দের শিল্পীত আকারে প্রকাশ পায়। তাঁর প্রতিটি কবিতা যেনো একেকটি ছোট গল্প। এটা তার কবিতার বিশেষ দিক। কবিতায় তিনি বলেন,

“তুমি হয়তো পারবে চোখ বন্ধ করে সব ভুলে যেতে
কারণ সব দায় তো আমার কাঁধেই দিয়ে হয়েছো নিশ্চিত
আমিই অপরাধী!”

কবি এই সমাজেরই বাসিন্দা। তিনিও পথ চলেন আরো অন্য দশজনের মতো। তাঁর হৃদয়েও দ্রোহ, দুঃখ ও ভালোবাসা একই সাথে উথলে উঠতে পারে। কারণ তিনি একজন কবি এবং কবি মানেই সর্বোপরি একজন হৃদয়বান মানুষ। তাই কবি মিজান মালিক তাঁর ” খেপাটে মন ” কবিতায় বলেন,

“যদি ফুলের পাপড়ি নিয়ে
আমার বেখেয়ালি হাতটি বাড়াই
যদি চুলের খোঁপায় আলতো করে
সেই ফুল গুঁজে আমি দিই
এমনটি হতে পারে কতটা অস্থিরতায়
জেনে নিও ভালোবাসি শুধু তোমাকেই।”

তাঁর দুঃখকে চেপে রেখে ব্যথিত হৃদয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ করেন,

“তুমি চাও আমি দিয়েছো যা থাকি তা নিয়েই তুষ্ট
আমি তো মানি বলি না আমি আমার মনের কষ্ট”

কবিতাটিতে কবি মাত্রাকে এড়িয়ে গেলেও এর তাল, লয় এবং অন্তমিল কবির আবেগকে স্পষ্ট করে তোলে। নিজের অজান্তেও যে তিনি একজন স্বভাবজাত কবি তা স্পষ্ট হয়ে উঠে কবিতাটিতে।

কবি যে শুধু নিজ প্রেম নিয়েই মশগুল তা না। তিনি যে একজন প্রকৃত দেশ প্রেমিকও, তাঁর”স্বাধীনতা”কবিতাই এর সাক্ষ্য বহন করে। দ্বিধাহীন চিত্তে তিনি উচ্চারণ করেন,

“স্বাধীনতা তুমি উদার জমিন
বুকের ভিতর স্বপ্নবাস
তুমি না এলে আঁধারেই ঢাকা
থাকতো আমার আকাশ।”

কবি শুধু কল্পনায় বিচরণ করেন না। সমসাময়িক বাস্তবতাকেও নিজের মাঝে লালন করেন এবং প্রতিবাদে ঝলকে উঠেন তা তাঁর ” বাজার দরের জীবন ” কবিতা পাঠ করলেই বোঝা যায়। তিনি বলেন,

“পেঁয়াজ বাড়ে লবন বাড়ে
মোটা চালও যায় না বাদ
নাগাল ছাড়া বাজার দরে
মাথায় পড়ে বাড়ির ছাদ।”

কি চমৎকার অথচ বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। শব্দের শিল্পে কি সুন্দর গাঁথুনি।

“গল্প ছাড়া মলাট”বইটিতে তার প্রতিটি কবিতাই আলোচনার দাবি রাখে। তাঁর লেখনীর সরলতা এতটাই যে তিনি খুব সরলভাবে বলেন,

“কিছু লোক অঝোরে কাঁদবে
কিছু লোক কান্না লুকাবে
কিছু লোক হাত তুলে করবে প্রার্থনা”

কষ্টকেও যে কবি অলঙ্কার হিসেবে দেখেন তাকেতো বাহবা দেওয়াই যায়। তাঁর কাছে

“ইচ্ছে করে কষ্ট গুলো জমা করে অলঙ্কার বানাই
_ _ _ _ _ _ _ _ _
অবহেলা গহনায় কতটা মানায় দেখি তোমাকে।
_ _ _ _ _ _ _ _ _

তাঁর প্রথম বই হিসেবে”গল্প ছাড়া মলাট”একটি সুন্দর কবিতার বই। পরিশেষে তাঁর নিজেকে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠার জন্য তাঁকে বলবো, যতি চিহ্ন, মাত্রা এবং বানানের বিষয়ে আরো সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। তবে তাঁর কবিতায় রসের দিক থেকে এই বইখানি বর্তমানে অনেক কবিতার বইয়ের ভিড়ে উপরের দিকেই স্থান পাওয়ার যোগ্য। বইটি পাঠককে প্রচুর আনন্দের খোরাক যোগাবে শুধু মাত্র এর সহজ সরল ভাষা প্রয়োগের জন্য। কবি তার কবিতায় কোথাও কোন দূর্বোধ্য ভাষা বা পান্ডিত্যের ব্যবহার করেননি।

আমি মিজান মালিকের”গল্প ছাড়া মলাট”বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

ইলিয়াস ফারুকী
কবি ও ছোট গল্পকার। সূত্র-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান