কমিশন প্রথা উঠে গেলে বীমাখাত আরও উন্নত হবে

আমাদের দেশে বর্তমানে ৭৮ টি ইন্সুরেন্স কোম্পানি রয়েছে। তারা কেউ এ পর্যন্ত দেউলিয়া হয়নি। কাজেই বীমা বাজারটা এখনো ভালো আছে। এটা যুক্তিসংগতভাবে অর্থনৈতিকভাবে ভালো, যেহেতু আমরা এখনো রিস্ক নিচ্ছি, ক্লেইম পেমেন্টে আমাদের কোন সমস্যা হয় না, যেহেতু আমাদের রি-ইন্সুরেন্স মার্কেট আছে। আসলে রি-ইন্সুরেন্স ছাড়া কোন কোম্পানি, কোন দেশেই এমনকি আমেরিকাও রি-ইন্সুরেন্স ছাড়া কোন সময়, কোন কোম্পানি এককভাবে তাদের রিস্ক নিজের কাছে রাখে না। বিভিন্ন দেশে রি-ইন্সুরেন্স এর মাধ্যমে রিক্সটা ছড়িয়ে দেয়।

রি-ইন্সুরেন্স কি: আমি যে সম্পদটার ইন্সুরেন্স করলাম, সেটা বাংলাদেশের একটি প্রোপার্টি, ধরুন বেক্সিমকো গ্রুপের একটি সম্পদ। যার ইন্সুরেন্স মূল্য ৫০০ কোটি টাকা। এই ৫০০ কোটি টাকার রিস্ক প্রগতি বা কোন কোম্পানি একক ভাবে বহন করা সম্ভব না। সেকারণে এই ইনস্যুরেন্সটাকে আমরা রি-ইন্সুরেন্স করি। বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে রিস্কটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, এটাই হল রি-ইন্সুরেন্স। যাতে করে একটা বড় লস হলে এককভাবে লসটা বহন করতে না হয়। সবাই মিলে লসটা ভাগ করে নেয়া হয়। ইন্সুরেন্স বিষয়টা কিন্তু এরকম। ধরুন আমি যদি ১০০ টা ইন্সুরেন্স করি, তাহলে দেখা গেল যে ১০টাতে লস হবে। হয়তো এই ১০টা ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে, কিন্ত বাকি ৯০টাতে আমি লাভবান হচ্ছি। সেজন্য কোন কোম্পানি সহনীয় মাত্রা পর্যন্ত এককভাবে কোন রিস্ক রাখে না।

অসম প্রতিযোগিতা: আমাদের বাজারে অসম প্রতযোগিতা হচ্ছে এমনটা আমি বলবো না। যেহেতু কমিশনতো সবাই দিচ্ছে, কমিশন দিয়েই সবাই ব্যাবসা করছে। যে কারণে এটাকে অসম প্রতযোগিতা না বলে, বলতে পারেন এটা একটা আনহেলদি বা অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা। এই আনহেলদি প্রতিযোগিতার কারণে এই মার্কেটটা ঠিক সেভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। যেমন মনে করেন, আমার ১০০ টাকা প্রিমিয়াম ইনকাম। কিন্ত দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে ষাট সত্তর শতাংশ  কমিশন চলে যাচ্ছে। এই কমিশনের কারণে আমার আরনিং থাকল ত্রিশ শতাংশ। ত্রিশ টাকার মধ্যে আমাকে রি-ইন্সুরেন্স করতে হয়, ম্যানেজমেন্ট খরচ, অন্যান্য এস্টাব্লিশম্যান্ট খরচ করতে হয়। সব মিলিয়ে আসলে ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো দাড়াতে পারছে না। এই আনহেলদি প্রতিযোগিতা যদি বাজারে না থাকতো, তাহলে ভালো ভাবে ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো দাড়াতে পারতো। আসলে ইন্সুরেন্সের সাথে কমিশনটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা যখন রি-ইন্সুরেন্স করি, তখন তারাও আমাদের কমিশন দেয়। আমাদের দেশে নিয়ম আছে ১৫ শতাংশ কমিশন দেওয়া যাবে। এর অতিরিক্ত কমিশন অবশ্যই বৈধ না। এই অতিরিক্তগুলোই আনহেলদি প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে যায়।

সলভেন্সি মার্জিন: আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলোর জন্য সলভেন্সি মার্জিন। ‌’সলভেন্সি মার্জিন’ মানে একটা সুষ্ঠু পরিবেশ। আমি ইনকাম করলাম ১০০ টাকা, কিন্ত আমার পকেটে ১০ টাকাও নাই। তাহলে আমি কিভাবে এই মার্কেটে প্রতিযোগিতা করবো? আমার তো একটা রিটেনশান আছে। সেটা দেওয়ার মত সক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেলেছি শুধু মাত্র কমিশনের কারণে। সুতরাং কমিশন প্রথা উঠে গেলে অবশ্যই ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো মার্কেটে আরো অবদান রাখতে পারবে।

আইডিআরএ: বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসিয়ালি যেমন ব্যাংকগুলোর অভিভাবক, তেমনি আইডিআরএ হচ্ছে ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলোর অভিভাবক। ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই সরকার তাদের সেই হাতিয়ার দিয়েই গঠন করেছে। ২০১০ সালে এই প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। কিন্ত সমস্যা হল, সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে পুরোপুরি ইকুইপ্ট করতে পারেনি। যেহেতু জনবল বলেন, সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট বলেন, যারা এটাকে নিয়ন্ত্রন করবে, তাদের নিয়ন্ত্রন করার মতো তো ইকুইপমেন্ট থাকতে হবে। তাদের জনবল থাকতে হবে। যেহেতু নিজেদেরকেই তারা শক্তিশালী করতে পারেনি, ইকুইপ্ট করতে পারেনি। সেহেতু তারা ইন্সুরেন্স মার্কেটটা নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না। তবে এখন যিনি আইডিআর-এর চেয়ারম্যান সফিকুর রহমান পাটোয়ারি, উনি একজন সরকারি আমলা ছিলেন, উনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। তিনি ব্যাংকিং সেক্টরের সচিব ছিলেন। উনার চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে উনার অরগানোগ্রাম না হওয়ার কারণে উনার মুভমেন্ট করার জায়গা নেই। এই যে ৭৮টা ইন্সুরেন্স কোম্পানি, তাদের সারা বাংলাদেশে শাখা আছে। অথচ আইডিআরের বেশিরভাগই মাস্টার রোলে বিশ পচিশ জন কর্মচারী আছে। তাদের ইন্সুরেন্স সম্পর্কে সে রকম দক্ষতাও নেই। আর এই জনবল নিয়ে তারা পুরো মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যার্থ হচ্ছে।

ইন্সুরেন্স সেক্টরে চাকরি: আসলে ইন্সুরেন্সে চাকরির ক্ষেত্রটি হচ্ছে ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ক, আউটসোরসিং। সত্যিকার অর্থে বেশিরভাগেরই ওই রকম নিশ্চিত চাকরি হয় না। তাকে একটা টার্গেট দেওয়া হয় এবং বলা হয় তুমি এই টার্গেটের কমপক্ষে ৮০ ভাগ ব্যাবসা আনলে মাস শেষে তুমি বেতন পাবা, ওই মাসের। না হলে বেতন পাবে না। এখানে একটা অনিশ্চয়তা রয়ে যায়। আর ইন্সুরেন্স মার্কেটটা পরিবেশগত দিক থেকে, সামাজিক দিক থেকে এখনো সেরকম সম্মানজনক স্থানে আসতে পারেনি। দুটো কারণ আছে। মনে করেন লাইফ ইন্সুরেন্স-এর প্রসার বেশি। কিন্ত কোন একটা মানুষ মারা গেলে, বীমাদাবি দিতে তারা দীর্ঘসুত্রিতা করে। একারণে ইন্সরেন্স খাতটাকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। বলা হয়, মানুষ মারা গেলেও এরা টাকা দিতে অনীহা করে। এতে উভয়পক্ষেরই দোষ আছে। একজন মানুষ মরে গেলে তার তো একটা সাক্সেসন সার্টিফিকেট লাগে। তো দেখা যায়, আমাদের দেশে একটা লোক মারা গেলে তার উত্তরাধিকার সুত্রে শিকড় এত বেশী দূরে চলে যায় যে, ওরা সাক্সেসন সার্টিফিকেটটা আনতে অনেক দেরি করে। ফলে ক্লেইমটা পেতে দেরি হয়। আবার কোন কোন সময় দেখা যায়, আমাদের যারা ইন্সুরেন্স করে তারা প্রিমিয়াম নিয়েছে মানুষের কাছ থেকে, কিন্ত সেটাকা আর কোম্পানির ফান্ডে জমা দেয়নি। কিছু পদ্ধতিগত সমস্যাও আছে।

এখাতে চ্যালেঞ্জ: বীমাখাত একটু চ্যালেঞ্জিং আছে, কারণ এখানে কিছু প্রমোশনাল কাজ হয়। যেমন যত প্রিমিয়াম ইনকাম করবে তার উপর বেতন হয়। বীমাখাতে দুই ধরনের চাকরি আছে, একটা অফিসে বসে, আরেকটা ডেভেলপমেন্টের চাকরি, যাদেরকে ব্যাবসা সংগ্রহ করতে হয়। এই ব্যাবসা সংগ্রহ করা আমাদের দেশের মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ। যারা ব্যাবসা আহরনের চাকরি করছেন, তাদের মধ্যে যারা পেরেছেন তারা বেশ মজা পেয়েছেন। আমি তো আমার এই কোম্পানিতে যেটা দেখেছি, যারা পেয়েছে তারা খুব মজা পেয়েছে এবং তারা মোটামুটি একটা দুইটা করতে করতে এক সময় মার্কেটে তারা অনেক ভালো করেছে। ওই ব্যাক্তিকে আপনি যদি বলেন অন্য কোথাও চাকরি দেব, করবেন নাকি? সে যাবে না। বীমা সেক্টরে সেই সুবিধাটা আছে।

আমাদের দেশের ছেলেগুলো ভাবে, আমি বিসিএস দেব বা চেয়ার টেবিলে বসে করার মতো জব, এরকম কিছু একটা করবো। যেহেতু বীমাটা একটা চ্যালেংজিং জব, সেহেতু বেশিরভাগ ছেলেরা এখানে আসতে চায়না। আবার আমাদের দেশে এই পেশা মানুষের কাছে সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্যতা কম। তারও কারণ আছে। আমি একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি সাধারণ বিমায় থাকতে, আমার পরিচিত কক্সবাজারের এক ছেলে বলল, তার বোনকে চাকরি দেওয়ার জন্য। আমি চাকরির এপোয়েন্টমেন্ট কার্ড পাঠিয়ে দিলাম। কিন্ত তার বোনতো কান্নাকাটি করে বলল, আমাকে ইন্সুরেন্সে চাকরি দিল. আমার তো বিয়ে হবে না। এরকম সামাজিক নেতিবাচক অবস্থা এখানে আছে। এজন্য দু-পক্ষই দায়ী। যারা বিমা করছেন এবং যারা করাচ্ছেন। আমাদের দেশের বিভিন্ন এজেন্টরা গ্রামে গঞ্জে প্রিমিয়ামের টাকা নিয়ে, পলিসির টাকা আর দেয় না। যখন পলিসি আনতে গেল, দেখা যায় বিমার টাকা জমা নেই। এমন ঘটনাতো আছেই।

প্রগতি ইন্সরেন্সএর বিশেষত্ব:  প্রগতি ইন্সুরেন্স এজন্যই ভালো কারণ এখানে ইন্সুরেন্স জানা লোকজন আছে। আর এ কারণে এই প্রতিষ্ঠান ইন্সুরেন্সের নিয়মে চলে। বাজারে কি চাচ্ছে সেটা বড় কথা না, যার কারণে আমরা শুধু বিমাই করাচ্ছি না। আমরা এডভাইজার হিসেবে কাজ করি। যেহেতু ইন্সুরেন্স সম্পর্কে মানুষ অনেক কম জানে। আমাদের যারা গ্রহীতা আছে তাদেরকে আমরা কোনটা করলে ভাল হবে সে ব্যাপারে সাজেশন দিয়ে থাকি। যেহেতু আমাদের রিইন্সুরেন্স মার্কেটটা খুব ওয়েল স্ট্যাবলিসড, সেহেতু ক্লেইম হলে আমরা প্রথমে ক্লেইম সেটেল করি, রিইন্সুরেন্স রিকভারির আগেই। যেহেতু আমাদের সেই অর্থনৈতিক সক্ষমতা আছে। আমরা ক্লেইম সেটেল করে দেই, পরে আবার রিইন্সুরেস থেকে রিকভারি করে আমরা বুঝে নিই। আসলে এখানে বীমা গ্রহিতাদের কাছে ক্লেইম সেটেলমেন্ট অন্যতম একটি ইস্যু। প্রগতির ক্লেইম সেটেলমেন্ট ভালো দেখেই বিভিন্ন কোম্পানি আমাদের সাথে ইন্সুরেন্স করতে স্বস্থি বোধ করে। তাছাড়া এমন অনেক কোম্পানি আছে যারা বছরের পর বছর ক্লেইম দিচ্ছে না। বীমা গ্রহিতাকে কেইস করতে হচ্ছে। লোয়ার কোর্টে যাচ্ছে, হাই কোর্টে যাচ্ছে, সুপ্রিমে কোর্টে যাচ্ছে। যেহেতু ওই কোম্পানিগুলোর “সলভেন্সি মার্জিন” দুর্বল । আমরা আমদের একটা প্রোপার্টির হাউসরেন্ট থেকে বছরে ১২ কোটি টাকা আয় করি। এগুলো আমরা ইন্সুরেন্স পারপাসে ব্যাবহার করি। পরে আমি রিইন্সুরেন্স রিকভারি থেকে সেটা এডজাস্ট করে নিই। আমরা খুব বাছাই করে প্রগতিতে নিয়োগ দিই। আমরা আমাদের ছেলেদেরকে কোম্পানির খরছচ ফরেন ট্রেইনিং করাই, লোকাল ট্রেইনিং তো আছেই, যাতে তারা অনুপ্রানিত হয় । এসব কারণেই প্রগতি ইন্সুরেন্সের সুনাম আছে।

মো. রেজাউল করিম,
এমডি ও সিইও, প্রগতি ইন্সুরেন্স লিমিটেড