কর্ণফূলী নদীর প্রস্থ ১৪ বছরে কমেছে ৪৭৬ মিটার

দ্বিতীয় কর্ণফূলী সেতু নির্মাণের সময় এডিবি মাস্টার প্ল্যান ও বিএস সিট অনুযায়ী কর্ণফূলীর প্রস্থ ছিল ৮৮৬ দশমিক ১৬ মিটার। কিন্তু গত ১৪ বছরের ব্যবধানে দখল-দূষণে কর্নফূলীর প্রসস্থতা কমেছে ৪৭৬ মিটার, যা অর্ধেকেরও বেশি।

বর্তমানে শাহ আমানত সেতু (দ্বিতীয় কর্ণফূলী সেতু) পয়েন্টে কর্ণফূলীর প্রস্থ নেমে এসেছে মাত্র ৪১০ মিটারে। নদী বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন অচিরেই কর্নফূলী রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া না হলে অদূর ভবিষ্যতে এক সময়ের প্রমত্ত কর্ণফূলী খালে পরিণত হবে, কার্যকারিতা হারাবে চট্টগ্রাম বন্দর।

সোমবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে ‘চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন’ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কর্নফূলী নদী নিয়ে তাদের করা এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে ‘কর্ণফূলী দখল জরিপ প্রতিবেদন-২০২০’ সাংবাদিকদের কাছে উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান। গত ৩০ আগস্ট থেকে ২১ দিন ব্যাপী ‘চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন’ কর্তৃক কর্ণফূলী নদীর শাহ আমানত সেতু থেকে নগরের ফিরিঙ্গিবাজারের মনোহরখালী পর্যন্ত এ জরিপ পরিচালনা করেন।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্ণফূলী ব্রিজ (শাহ আমানত সেতু) নির্মাণের সময় এডিবি মাস্টার প্ল্যান ও বিএস সিট অনুযায়ী কর্ণফূলীর প্রস্থ ছিল ৮৮৬ দশমিক ১৬ মিটার। কিন্তু ‘চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন’ কর্তৃৃক তৈরী নতুন জরিপে দেখা যাচ্ছে শাহ আমানত সেতুর নিচে বর্তমানে ভাটার সময় নদীর প্রস্থ থাকছে মাত্র ৪১০ মিটার। জোয়ারের সময় চর অতিক্রম করে তা সর্বোচ্চ ৫১০ মিটার পর্যন্ত হয়। এছাড়া ভড়াট হয়ে যাওয়া প্রায় নদীর ৩০০ মিটার এলাকা দিয়ে কোনো প্রকার নৌযান চলাচল করতে পারে না। একারণে স্থানীয়রা কর্ণফূলী নদীর মাঝ বরাবর অঘোষিত ঘাট বসিয়ে যাত্রী পারাপার করছে।

প্রতিবেদন আরো উঠে এসেছে, এডিবি মাস্টার প্ল্যান ও বিএস সিট অনুযায়ী রাজাখালী খালের মুখে কর্ণফূলীর প্রসস্থতা ৮৯৮ মিটার, কিন্তু বাস্তবে তা মাত্র ৪৬১ মিটার। চাক্তাই খালের মুখে কর্ণফূলীর প্রস্থতা থাকার কথা ৯৩৮ মিটার, কিন্তু বর্তমানে সেখানে আছে ৪৩৬ মিটার। এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত মেরিনার্স পার্ক এলাকায় কর্ণফূলীর প্রসস্থতা ৯৮১ মিটার হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে আছে ৮৫০ মিটার, যদিও সেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন ড্রেজিং অব্যাহত রেখেছে। ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় কর্ণফূলীর প্রসস্থতা হওয়ার কথা ৯০৪ মিটার, কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ গাইড ওয়াল নির্মাণ করায় সেখানে নদীর প্রসস্থতা নেমে এসেছে ৭৫০ মিটারে।

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ বলেন, কর্ণফূলী নদী নিয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষার সুযোগ নেই। শাহ আমানত সেতু এলাকায় নদীর ৩৫০ মিটার জায়গা ভরাট হয়ে গেছে। একই সঙ্গে সদরঘাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নদী পুরোপুরি ভরাট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। শাহ আমানত সেতু যখন তৈরী হয়, তখনই আমরা সতর্ক করেছিলাম। এখন নদী ভরাট হয়ে যাওয়া দুই হাজার টনের আর কোনো জাহাজ উজানে আসতে পারছে না।

চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ বলেন, আজ প্রায় দেড় যুগ ধরে কর্ণফূলী রক্ষায় আন্দোলন করে আসেছি। কিন্তু কর্ণফূলীর দখল দুষণ বন্ধ হচ্ছে না। ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে আমরা এই কর্ণফূলী নদী পাড় হয়েই চট্টগ্রাম শহরে আসতাম। আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন একবার শিকলবাহা নদী দিয়ে লঞ্চ মুড়ালীঘাট এসেছিলাম। সেখানে এতটাই গভীর ছিল যে, সেবার লঞ্চ ডুবে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। অথচ এখন সেই মুড়ালীঘাটের অস্তিত্ব নেই।

হালদা বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিররিয়া বলেন, কর্ণফূলি নদী নাব্যতা হারানোর জন্য অন্যতম দায় হলো কাপ্তাই বাঁধ। মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এত বিশাল জায়গা অপচয়ের প্রয়োজন আছে কিনা তা আমাদের ভাবতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে ৬ টি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। সেগুলো হচ্ছে- অবিলম্বে কর্ণফূলী মেরিনার্স পার্ক, সোনালী মৎস আড়ত, বেড়া মার্কেটসহ কর্ণফূলী নদী দখল করে গড়ে উঠা সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর গতিপথ ফিরিয়ে আনা ইত্যাদি।

সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক নোমান সিদ্দিকি, কর্ণফূলী গবেষক ড. মো. ইদ্রিস আলী, অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দাশ, অধ্যাপক মনোজ কুমার দে প্রমুখ।