কর্মসংস্থান সৃষ্টি আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ

অটোকন গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এম হামিদ শরীফ এ দেশের অটোমোবাইল ব্যবসায় পরিচিত নাম। দীর্ঘদিন তিনি এ ব্যবসায় জড়িত। আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন, এবি টিভির সঙ্গে দেশের গাড়ি ব্যবসার সার্বিক অবস্থা, বাজেট, জাপানিদের বিনিয়োগ আগ্রহ, দেশে কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, শিল্প বিকাশে বাধা ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। তাঁর সঙ্গে কথপোকথনের উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

এবারের বাজেটে অটোমোবাইল বা গাড়ি সেক্টরের অবস্থা:এবারের বাজেটের প্রতি আমরা গাড়ি ব্যবসায়ীরা খুবই সন্তুষ্ট। কারণ- এবারই প্রথম পরিবেশবান্ধব হাইব্রিড গাড়িকে সহজলভ্য করার ব্যবস্থা করেছে সরকার। আশা করি এটি বাস্তবায়িত হলে দেশ জনগণ ক্রেতা সাধারণ সবাই উপকৃত হবে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোকে ২০২০ সালের মধ্যে ৫০% গাড়ি হাইব্রিড পদ্ধতিতে তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাইব্রিড বলতে বোঝানো হয়েছে, যে গাড়ির ইঞ্জিনে লিথিয়াম ইয়ন ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। যেখানে অনেক বেশি পাওয়ার রিজার্ভ করে রাখা যায়। কিছুক্ষণ ফুয়েলে চলার পর গাড়ি পাওয়ারে চলতে পারে। ব্যাটারির পাওয়ার কমে গেলে আবার ফুয়েল দিয়ে চালানো যাবে। এ পদ্ধতির কারণে কম জ্বালানি খরচে গাড়ি চালানো যায়। ফলে বায়ুদূষণও কমে যাবে। আর সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে- গাড়িতে যে সিএনজি ব্যবহার করা হয় সেটি করতে হবে না। সেই গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ অন্যান্য কাজ করা যাবে।

তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে – রিকন্ডিশন গাড়ির মূল্যায়ন করার পদ্ধতিটা ন্যায়সঙ্গত হয়নি বলে মনে করি। এটি বিশ্বমানেরও হয়নি। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি গ্রহণ করা হোক।

গাড়ির আকার আয়তন দেখে শুল্ক নির্ধারণ করা উচিত। ১৫০০ সিসি একটি গাড়ির জন্য ১২৮% ট্যাক্স দিতে হয়। কিন্তু ১২৮% কত টাকার? বা কোন মূল্যের তা নির্ধারণ করতে হবে। একটি নতুন গাড়ির যে পরিমাণ ট্যাক্স পুরাতন গাড়ির তো সেই একই পরিমাণ ট্যাক্স হতে পারে না। একটি গাড়ি পুরাতন হলে বছরপ্রতি কত টাকা অপচয় ধরা হবে। এটা নির্ধারণ করে সেই পরিমাণ টাকা বাদ দিয়ে অবশিষ্ট টাকার ওপরে ট্যাক্স আরোপ করতে হবে। এবার সেই অপচয়ের হারটা অনেকাংশে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা বাস্তবিকভাবে সেই গাড়ির সঙ্গে সামঞ্জস্য নেই। এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত ছিল।

আমাদের দেশে শিল্প বিকাশের প্রতিবন্ধকতা
এ বিষয়ে আলোচনা করতে হলে আগে বলতে হবে বিগত বছরগুলোর বাজেটের কথা। দিন দিন বাজেটের কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সেই হারে বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিশেষ করে দেশের বিনিয়োগ যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এফডিআই বা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা বৈদেশিক বিনিয়োগ। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কোনোভাবেই লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছনো যাচ্ছে না। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পেলে শিল্পের বিকাশ সম্ভব না। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যতিক্রমী দেশ যাদের হিউজ ইয়াং জেনারেশন অ্যান্ড ওয়ার্ক ফোর্স রয়েছে। জাইকার বিভিন্ন সার্ভে রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে- ২০৫০ সাল পর্যন্ত এই ওয়ার্ক ফোর্স আমরা ধরে রাখতে পারবো। এখন আমরা যদি প্রয়োজনমতো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারি এবং বিদেশি ইনভেস্টমেন্ট যদি অনুপ্রাণিত করতে পারি তাহলে আমাদের দেশেই অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অন্য দেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। এটি দরকার বলে আমি মনে করি। এই কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি ভোকেশনাল এডুকেশনের দিকে নজর দিতে হবে। যেমন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য খুব অল্প সংখ্যক কর্মসংস্থান রয়েছে। এই বিশাল অংশটাকে আমরা প্রপারলি কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের মহিলাদের তেমন কাজে লাগাতে পারছি না। যদিও বর্তমানে গার্মেন্টসে প্রচুর নারী কাজ করে। কিন্তু তারা পর্যাপ্ত সুবিধা পাচ্ছে না। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই মহিলা। এদের ন্যায্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ৮ম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা করতে পারে না। তাদের ভোকেশনাল শিক্ষা দিয়ে কাজে লাগানো যেতে পারে।

প্রতিবন্ধকতা কাটাতে করণীয়
এই সেক্টরের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে সরকারকেই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ভকেশনাল শিক্ষার বিষয় নিয়ে যে আলোচনা করলাম সেটিও সরকারকেই করতে হবে। একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুল করতে যে আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হয় একটি পদ্মা সেতু তৈরিতেও একই ফরমালিটি মেইনটেইন করতে হয়। সরকারের জন্য যে এটি শুধু ব্যয় সাপেক্ষই নয় একইসঙ্গে সময় সাপেক্ষও।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশ অনুসরণ করলে দেখা যাবে- সম্প্রতি চীনে ৬ হাজার জাপানি শিল্প কারখানা রয়েছে। এখন চীনে তারা অত্যন্ত খারাপ অবস্থানে আছে। ফলে এখন তারা অন্য কোনো দেশে যেতে চাচ্ছে। বাংলাদেশেও আসছে। জাপানের এই শিল্পগুলো থাইল্যান্ডে শিফট করার কারণে থাইল্যান্ডের অগ্রগতি হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় শিফট করার কারণে মালয়েশিয়ার অগ্রগতি হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনসহ যে দেশেই জাপানিজ শিল্প শিফট করেছে তাদের অগ্রগতি হয়েছে। জাপান এখন মোটর টেকনোলোজির পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এগুলো যদি আমাদের দেশে তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাহলে তাদেরই উদ্যোগ নিয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের ভোকেশনাল এডুকেশন এবং স্কিল ডেভেলপমেন্ট পুরোটাই হয়ে যাচ্ছে। এতে আমাদের কয়েকটা উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে। এক. এফডিআই আসছে। দুই. টেকনোলোজি পাচ্ছি। আর এই টেকনোলোজি ব্যবহারের জন্য স্কিল ডেভেলপ হচ্ছে এবং একই সঙ্গে ভোকেশনাল শিক্ষাও হয়ে যাচ্ছে।

জাপানি ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশে আনবার জন্য করণীয়
আমি জাইকার বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমার যেটি মনে হয়েছে- আমরা যেমন বাইরের কোনো রাষ্ট্রে গেলে পাশাপাশি থাকার চেষ্টা করি। সে যে দেশেই হোক। ঠিক তেমনি অন্য দেশের ব্যবসায়ীরাও যে কোনো দেশে গেলে চায় তারা যেন একই এরিয়ায় এক সঙ্গে থাকতে পারে। জাপানেরও চাওয়া এমনই। তারা চায় যেন ঢাকা থেকে এক বা দুই ঘন্টার দূরত্বের মধ্যে একটা স্পেশাল জোন দেওয়া হোক। সেখানে তারা শিল্প কারখানা গড়বে প্রাথমিকভাবে। পরে তারা পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে। এটি হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য। দীর্ঘদিন পর আমাদের বর্তমান সরকার নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে একটি জায়গা নির্ধারণ করেছে জাপানের জন্য। কিন্তু সেটি দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে না। জাপানের অনেক শিল্প কারখানা ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ওইসব দেশে চলে যাচ্ছে। তাদের ধরে রাখতে হলে আমাদের এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা যদি স্পেশাল জোন ডেভেলপ করতে পারি তবে এই ইনভেস্টমেন্টগুলো নিয়ে আসতে পারবো।

এ দেশে আসার জন্য জাপানিদের আগ্রহ কতটুকু
বাংলাদেশে ব্যবসা করার জন্য জাপানিদের আগ্রহ বেশি। আমরা প্রাইভেট কোম্পানিগুলে তাদের আগ্রহে বেশ রেসপন্স করি। তারা এদেশে আসার পর একটি ফ্যাক্টরি করতে অনেক ফরমালিটিজ মেইনটেইন করতে হয়। ট্রেড লাইসেন্স থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্লট প্রত্যকটি জায়গায় এসে অনেক সময় তারা হোঁচট খেয়ে বসে। এরপরও জাপারে অনেক কোম্পানি আমাদের এখানে ব্যবসা করে যাচ্ছে। যেমন- ওয়াই কে কে দীর্ঘদিন ধরে ইনভেস্ট করে আসছে। এবং ওয়াইকেকে’র ইনভেস্টমেন্ট প্রথম তিন বছরেই প্রফিটে চলে গেছে। ইনভেস্টমেন্ট পুরোটাই রিটার্ন হয়ে গেছে। তারা সেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে এবং অন্য জাপানিজদেরও সেটি জানাচ্ছে। আমাদের দেশের ম্যানপাওয়ার নিয়েও তাদের ধারণা খুবই ভালো। বাংলাদেশিদের প্রতি জাপানিজদের আগ্রহ অনেক বেশি। আমাদের দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্বলতাগুলো যদি না থাকতো তাহলে আমরা অনেক বেশি পরিমাণে জাপানি ইনভেস্টমেন্ট পেতাম।

দক্ষ জনশক্তি গড়তে করণীয়
দক্ষ জনশক্তি গড়তে হলে সরকারের পাশাপাশি এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশনগুলোও ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দেশের এডুকেশন সেক্টরের পরিসর খুব ছোট। আমাদের টেক্সটাইলের ওপর ইউনিভার্সিটি আছে। সেটি খুবই ভালো চলছে। সেখান থেকে একটা স্কিল ম্যানপাওয়ার আমরা পাচ্ছি। কিন্তু সংখ্যার দিক দিয়ে খুবই কম। প্রয় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে সংখ্যাটি খুবই সীমিত। এজন্য একাডেমিক ইনস্টিটিউশন দাঁড় করিয়ে স্কিল ডেভেলপ হতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা বই থেকে যে ধরনের শিক্ষা পাই পেশাগত জীবনে গিয়ে সেগুলোর সঙ্গে কোনো মিল পাই না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে- টেকনোলোজি সমৃদ্ধ ইনভেস্টমেন্টকে এনকারেজ করা। তাহলে সেই টেকনোলোজি ডেভেলপ করার স্বার্থেই তারা আমাদের দক্ষ করে তুলবে। আমাদের টেকনিক্যাল নো হাউ শেখাবে। এ প্রসঙ্গেই ভোকেশনাল এডুকেশণের বিষয়টি পাশাপাশি চলে আসে। এসব কারণেই আমি জাপানের ইনভেস্টমেন্টকে একটু বেশি গুরুত্ব দিই।

দেশের উন্নয়নের জন্য সরকারসহ সবার যে বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া উচিত
খুবই অল্প কথায় এবং সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে আমি বলবো- দেশের উন্নয়নের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট। এ দিকটায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গ্যাস সেক্টর উন্নত করতে হবে। এবং যারা টেকনোলোজি ব্যবসা নিয়ে আসবে তাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। অনেকেই রিয়েল স্টেট ব্যবসা নিয়ে আসতে পারে সেগুলো কিন্তু আমাদের জন্য তেমন জরুরি নয়। এখন যারা টেকনোলোজি বেইজ ব্যবসা করবে তাদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া। এতে আমাদের স্কিল ডেভেলপ হবে। এভাবে নিজেদের উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই বলতে চাই আমাদের টেকনিক্যাল শিক্ষায় বেশি নজর দেওয়া উচিত।

হামিদ শরীফ
চেয়ারম্যান
অটোকন গ্রুপ