কী ব্যবসায় কখন বিনিয়োগ করতে হবে, নির্বাচন করা ব্যবসায়ীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ

‘আমাদের অবশ্যই সভ্য জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচিত করতে হবে। আজ এই বাংলাদেশকে সবাই চেনে। অথচ বাংলাদেশকে একসময় ইন্ডিয়া হিসেবে ট্রিট করা হতো। বাংলাদেশ নামে যে আলাদা একটা রাষ্ট্র আছে তা কেউ বুঝতেই চাইত না। এখন এই বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নত একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। একসময় যে দেশটিকে হেয় করে দেখা হতো সেই দেশকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিশ্ব উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। আমরা চাই সেভাবে বিশে^র প্রতিটি দেশের মানুষ আমাদের সম্মান করুক, সম্মান দেখাক। সেই সম্মান নিয়ে আমরা সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াতে চাই। প্রত্যেকটা নাগরিকের কাছে এটাই আমার চাওয়া’ – এ্যাফিনিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইশরাত জাহান আইভী বলছিলেন এসব কথা। আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন এবি টিভির সঙ্গে তাঁর কথপোকথনের চুম্বক অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি

আমি তো মনে করি ব্যবসার পরিস্থিতি এখন খুবই ভালো। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের জন্য বিশ্বের একজন রোল মডেল হিসেবে দেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ জন্য আমি গর্ববোধ করি। আমাদের দেশ যে এতো দ্রুত ডিজিটালাইজেশনের দিক দিয়ে এতটা উন্নতি করবে তা আমরা চিন্তা করতে পারিনি। উন্নয়নের মডেল হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সামনে রেখে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছি। ব্যবসায় যেভাবে আমরা বিনিয়োগ করছি সেভাবেই আমরা লাভ পাচ্ছি। মূল কথা, যেখানে বিনিয়োগ করলে মুনাফা আসবে সেটা যদি আমরা জানি তাহলে আমার মনে হয় যে সবাই আমরা উন্নতি করতে পারব। সবমিলিয়ে আমি বলব, সার্বিকভাবে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ
আমি মনে করি আমার বিনিয়োগটাই একটা চ্যালেঞ্জ। আমি যদি দেখি যে একটা জায়গায় বিনিয়োগ করলে প্রফিট করতে পারব তাহলে সেখানে আমি ইনভেস্ট করব। আর এই বিনিয়োগ করতে হবে চারপাশের পরিবেশ বিবেচনায় রেখে। কারণ খেয়াল রাখতে হবে কোনো সমস্যা রয়েছে কি না, কোনো ঝুঁকি আছে কি না। কত দ্রুত মূলধন ওঠে আসতে পারবে, এসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। বলতে পারেন, বিনিয়োগ উপযোগি পরিবেশ থাকলেই তখন বিনিয়োগের দিকে এগুতে হবে।

আসলে ব্যবসার উদ্দ্যেশ্যই লাভ এবং ক্ষতি। আর একজন ব্যবসায়ী লাভের উদ্দেশ্যেই ব্যবসায় নামে। সুতরাং যেখানে আমি বেশি লাভ দেখব সেখানেই আমি বিনিয়োগে আগ্রহী হবো। ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যবসার গ্রাউন্ড বুঝেই বিনিয়োগ করা উচিত।

রিয়েল এস্টেট ব্যবসার বর্তমান অবস্থা
আবাসন ব্যবসার একজন হিসেবে বলতে পারি, এ ব্যবসায় আমরা এখনও তেমন করে সাহস পাচ্ছি না কিভাবে এগুবো। কারণ শেয়ার মার্কেট ধসের পর থেকে এর প্রভাব আমরা এখনো বহন করছি। অনেক ক্ষতি হয়েছে আমাদের। তা ছাড়া বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ ইত্যাদির সমস্যাতো আছেই। যারা এই ব্যবসা করছে তারা যে কিভাবে কী করছে আমি জানি না। আদৌ কি কোনও এপার্টমেন্ট গ্রাহকের কাছে হস্তান্তর করতে পেরেছে কি না তাও আমার জানা নেই। আমরা এখন পর্যন্ত পারি নি। এখনও দায়বদ্ধ রয়েছি। তো এর জন্য রিয়েল এস্টেট ব্যবসা আমি আর চালাচ্ছি না। আমরা আমাদের ব্যবসা নিয়ে এখন ব্যস্ত আছি।

আমরা এখন কী ব্যবসা করছি
এখন আমরা বেবি ফুডের ব্যাবসা করছি। বেবি ফুডের মধ্যে স্যারিলাক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পেম্পাডর্স, ডায়াপার , মিল্ক প্রডাক্ট আমরা ইমপোর্ট করছি। সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমরা এগুলো আমদানি করি।

এগুলো কি দেশে উৎপাদন করা যায় না?
আসলে আমাদের দেশে বেবি প্রোডাক্টগুলোর তেমন উন্নতভাবে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়নি। ফলে জন্য এসব পণ্য আমাদের বাইরে থেকে আামদানি করতে হয়। যেহেতু এ পণ্যগুলো বাচ্চাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে, তাদের সঙ্গে মানিয়ে যাচ্ছে, তাই আমরা উৎপাদনের দিকে না গিয়ে আমদানি করছি। দেশে এসবের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া বেবিফুড কিংবা কিডস গুডসের দেশি ব্র্যান্ডের পণ্যের ওপর গ্রাহকের তেমন আস্থা নেই। তাই আমরা উৎপাদনের দিকে যাইনি।

ব্যবসা পরিচালনায় সমস্যা
অনেক সময় ভ্যাট-ট্যাক্সের সমস্যায় পড়তে হয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশে জঙ্গি হামলা, বৈরি পরিবেশ এগুলোও বড় ধরনের সমস্যা। এ জন্য আমাদের বিদেশি বন্ধুরা সময়মত পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে না বলে ব্যবসায় আগ্রহ হারায়। তবে সমস্যা ওভারকাম করেই আমরা এখন স্থিতিশীল জায়গায় আসতে পেরেছি। আমাদের সরকার সব কিছুতে নিরাপত্তা দিচ্ছে। তারপরও কেন জানি বিদেশিরা আমাদের বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা ভাবছে আমরা কি তাদের পণ্য সারা দেশে সরবরাহ করতে পারব? সময়মতো তাদের টাকা পরিশোধ করতে পারবো? কিংবা আমরা যথেষ্ঠ বিনিয়োগ করতে পারব কি না? এ ব্যাপারে তাদের বিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে আমরা অনেকসময় বিপদে পড়ছি। জানি না এই সমস্যার সমাধান আমরা কবে করতে পারব? সরকার বিভিন্নভাবে উদ্যোগ নিচ্ছে। এটাই যথেষ্ঠ নয়, আমাদেরও তো হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। সরকারের পাশাপাশি আমাদের সমান তালে কাজ করে যেতে হবে। বিদেশিদের বোঝাতে হবে, তাদের বিশ্বাস স্থাপনে চেষ্টা করতে হবে। সেটা আমাদেরই করে নিতে হবে।

ব্যাংকের সমস্যা
ব্যাংক থেকে এ পর্যন্ত আমি কোন ঋণ নিইনি। আমি আশা করি নিবও না আপাতত। ভবিষ্যতে যদি কোন বড় আকারের কিছু করি তখন দেখা যাবে। আসলে অনেকেই বিভিন্নভাবে ব্যবাসায় এগুতে না পেরে আমার কাছে সহযোগিতা চায়। আমি প্রয়োজনমত সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। ব্যাংকের কাছে লোনের জন্য আমাকে যেতে হয়নি। ব্যাংকের দিক দিয়েও কোনোরকম অনাস্থা, ঝামেলার মুখোমুখি আমি হই নি।

নারী ব্যবসায়ীদের প্রতিবন্ধকতা
আসলে ব্যবসায়ী হিসেবে নারীদের অনেক রকম সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। প্রথমেই আমরা বাধা পাই পরিবার থেকে। আমি বাইরে গেলে বা কোথাও কোনো মিটিংয়ে গেলে পরিবারের কাছে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। সন্তান দেখাশোনা করতে হয়, আমার দায়িত্ববোধ থেকেই তো আমি তাদের দেখবো। বাইরের সমাজ তো আমি পরে দেখবো। আগে পরিবারের বাধা অতিক্রম করা জরুরি। আমি যদি নিজে ঠিক থাকি, আমার পরিবার যদি আমাকে সেই সাপোর্ট দেয় তাহলে সমাজ কী বলবে? আর আমরা যদি আজ সবাই মিলে একসাথে কাজ করি তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে। সরকার তো আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। সরকার চায় আমরা এগিয়ে আসি। কিন্ত পরিবারের এই সব সমস্যার কারণে আমরা পিছিয়ে যাই। প্রতিটি পরিবারের উচিত যদি কোনো মেয়ের মেধা থাকে, তার যদি এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে কোনো সুযোগ থাকে তাহলে তাকে উৎসাহ দেয়া, সহযোগিতা করা। অন্তত তাকে সহযোগিতার মন-মানসিকতা নিয়ে যদি আমরা সবাই এগিয়ে আসি তাহলে দেখবেন নারীরা অনেক উন্নতি করবে। সমাজ তো অনেক পরে। ভালো মন্দ না বুঝে দেখা গেল যে কেউ এগিয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে দিল কিংবা সমস্যার সমাধান না করে আরো জটিলতার সৃষ্টি করল।

পরিবার যদি ঠিক থাকে তাহলে সমাজও তাকে গ্রহণ করবে। সুতরাং একজন নারী উদ্যোক্তার প্রথম সহযোগিতা আসতে হবে তার পরিবারের কাছ থেকে। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করতে পারে না। কারণ পুরুষ সমাজের মন মানসিকতা এখনো অনেক ‘ন্যারো’ রয়ে গেছে। সহনশীল, সহযোগী এবং সমপর্যায়ে নারীদের মেনে নেয়ার মানসিকতা সম্পন্ন পুরুষের সংখ্যা আমাদের সমাজে খুব কম। আমরা এখানে আনকমফোর্টেবল। আমি বলব আসুন, নারী পুরুষ ভেদাভেদ ভুলে ভাই-বোনের মতো করে এগিয়ে যাই । দেখবেন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে , সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হচ্ছে।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কী বলবেন
আমি কোচিং সেন্টার নির্ভর শিক্ষা সাপোর্ট করি না। কেন না বাসায় ছাত্রছাত্রীদের পড়ার সুযোগ না হলে শিক্ষকদের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে যায় তারা। তো নিজেদের মেধা বাড়াতে বেশি করে পড়াশুনা করা দরকার। অথচ আমরা ছেলেমেয়েদের প্রতিটি বিষয়ের জন্যই একজন করে শিক্ষক দিয়ে দিচ্ছি। বাসায় শিক্ষক থাকতেই পারে, এটা স্বাভাবিক। কিন্ত কোচিং সেন্টার বসিয়ে সেখানে ব্যবসা করা আমি মোটেও সমর্থন করি না। আমার নিজের যে সেন্টার আছে সেখানে বিদেশে স্টুডেন্ট পাঠানোর জন্য তাকে প্রয়োজনমত তৈরি করা হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসা করার জন্য বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলা কিংবা তাদের উপর নির্ভর করতে হয়। সে জন্য বাইরে যখন কোন ছাত্র পড়তে যাবে তখন তাদের আইএলটিএস, টোয়েফল, জিআরই , জি ম্যাটসের দকার হয়। আমার সেন্টার থেকেই শিক্ষার্থীকে ওই সাপোর্টগুলো দিই।

সম্ভাবনার কথা বলতে চাই
আমাদের অবশ্যই সভ্য জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচিত করতে হবে। আজকে এই বাংলাদেশকে সবাই চেনে। বাংলাদেশকে একসময় ইন্ডিয়া হিসেবে ট্রিট করা হতো। বাংলাদেশ নামে যে আলাদা একটা রাষ্ট্র আছে তা কেউ বুঝতেই চাইত না। এখন এই বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নত একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যারা একসময় এই দেশকে হেয় করে দেখতো সেই দেশকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিশ্বে উন্নয়নশীল একটা রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। আমরা চাই সেভাবে বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষ আমাদের সম্মান করুক, সম্মান দেখাক। সেই সম্মান নিয়ে আমরা সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়াতে চাই। এটাই আমার চাওয়া প্রত্যেকটা নাগরিকের কাছে।

সামাজিক কর্মকাণ্ড
দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে থাকা প্রতিবন্ধী শিশুরা রয়েছে। যারা অসহায়, কত কষ্টে তাদের জীবন কাটে। তাদেরও তো বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। আজ এই সমাজে তারা চলতে পারে না, অবহেলিত থাকে। তাদের নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। তাদেরও তো সমাজে চলতে ইচ্ছে করে, বিভিন্ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হতে মন চায়। আমরা কেন তাদের সহযোগিতা করি না? তাদের সেই চাহিদাকে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কাজ করছি। অনেকে আছে তাদের প্রতিভা বিকাশ করতে পারছে না তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছি। বিভিন্ন স্কুলে তাদের বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব সাপোর্ট, বই খাতাসহ বিভিন্ন শিক্ষা সামগ্রী কিনে দিচ্ছি। তাদের জন্য কয়েকমাস পরপর ভালো খাবারের ব্যাবস্থা করি, সবার বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমি জড়িত। আর তাই সমাজের উন্নয়নে ব্যবসার পাশিাপাশি অন্য কাজও করে যচ্ছি।

আমার অনুপ্রেরণা আমার বাবা। বাবাকে দেখেছি তার কাজের পাশাপাশি বিভিন্নভাবে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িেেয়ছিলেন। তাদের দুঃখ কষ্টের সময় সহযোগিতা করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমিও চেষ্টা করি কিছু করার।
আমার বড় ছেলে এখন বিবিএ শেষ করবে। সেই মূলত আমাকে ব্যবসায় হেল্প করে। আমার স্বামী আমার কোন কাজেই বাধা দেয় নি। তার সহযোগিতায় আমি আজ এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি।

ইশরাত জাহান আইভী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
এ্যাফিনিটি গ্রুপ

আজকের বাজার: আরআর/ ১৬ আগস্ট ২০১৭