কৃষকের চাহিদা অনুসারে উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে

 ড. এফ এইচ আনসারী:
বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার বীজ-পানি-সার প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে কৃষির, বিশেষত খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য একটি কর্মসূচি শুরু করে। ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলে কর্মসূচিটি আরও গতি লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের উত্তরাধিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনকে সেচ পাম্প, সার ও উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহ ও বণ্টনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতির কারণে এবং দেশে সবুজ বিপ্লব সংঘটনের ফলে কৃষিকাজে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, সেচকৃত জমি ও উন্নত জাতের ধানের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। একই সময়ে বিশেষত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পঁচাত্তরে জাতির পিতার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সেনা শাসনামলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৪৮ শতাংশের পাশাপাশি সামগ্রিক শস্যের উৎপাদন মাত্র ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ ও খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। গমের উৎপাদন বৃদ্ধি ছিল ১৫ দশমিক ১ শতাংশ হারে। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত মেয়াদে বাণিজ্যিক সার ও উন্নত জাতের বীজের ব্যবহার এবং সেচ এলাকার আনুপাতিক হার বৃদ্ধি ও সার্বিকভাবে কৃষিবান্ধব নীতির প্রয়োগের ফলে ১৯৯৯-২০০০ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সম হলেও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ এ অর্জন ধরে রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ধানের বার্ষিক গড় ফলন বৃদ্ধি ২০০৯-১০ সালের পর থেকে ২০১৩-১৪ সাল পর্যন্ত ৯ থেকে ২৩ কিলোগ্রামের মধ্যে ছিল। সম্প্রতি সেচের অধীনে বোরো মৌসুমের ধানের ফলন বৃদ্ধির হার আরও কম দেখা গেছে। আমাদের দেশে মোট চাল উৎপাদনের ৫৫ শতাংশের ওপর আসে এই বোরো ধানের আবাদ থেকে। গম, আখ, তামাক ও মসলাজাতীয় ফসলের ফলনে ২০০৯-১০ সালের পর থেকে উন্নতি দেখা গেলেও ডাল ও তেলজাতীয় ফসলের ফলন ওঠানামা করেছে। পাট ও সবজির ফলনে অবনতি হয়েছে। আখ আবাদি এলাকা ১৯৯০-৯১ সালে ৪ লাখ ৭২ হাজার একর এবং উৎপাদন ৭৬ লাখ টনের ওপরে উঠে পরের বছর থেকে পড়তে শুরু করে। ক্রমান্বয়ে ৪০ শতাংশের ওপর কমে গিয়ে ২০১৩-১৪ সালে আবাদি এলাকা ২ লাখ ৬২ হাজার একর এবং উৎপাদন ৪৫ লাখ টনে নেমে এসেছে। সবচেয়ে লণীয় হলো হাইব্রিড ধানের আবাদি এলাকার সংকোচন। বিদেশ থেকে বীজ আমদানি করে নব্বইয়ের দশকে এই প্রযুক্তির ব্যবহার জোরেশোরে শুরু হয়। হাইব্রিড ধানের আবাদ ২০০৮-০৯ সালে মোট ধান আবাদি জমির ৭ শতাংশের ওপরে পৌঁছে গেলেও পরবর্তী বছরে পড়তে শুরু করে ৬ শতাংশের নিচে চলে আসে। একই সঙ্গে ফসল নিবিড়তা বৃদ্ধির হার থমকে গেছে। ফসল নিবিড়তা ২০০৬-০৭ সালে ১৭৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৯-১০ সালে ১৮৩ এবং ২০১০-১১ সালে ১৯১ শতাংশে পৌঁছায়। এরপর ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ সালে ১৯০ শতাংশ থাকে। এ থেকে প্রতীয়মান হতে পারে যে ফসল উৎপাদনে এবং নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগে কৃষকদের আগ্রহ কমছে।
নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ফলন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিলেন। বিশেষ করে যেসব কৃষক পরিবারের মালিকানায় আবাদি জমির পরিমাণ এক হেক্টর বা আড়াই একরের কম, এসব ুদ্র খামারের মালিক বা কৃষকেরা নতুন বীজ এবং সুপারিশকৃত হারে রাসায়নিক সার ব্যবহার, সেচ প্রদান, উন্নত পরিচর্যা ও পারিবারিক শ্রম বিনিয়োগ করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করে। তাদের পারিবারিক উপার্জন বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০০৮-০৯ সালে নিজ জমিতে উচ্চফলনশীল জাতের বোরো মৌসুমে ধান আবাদ করে একরপ্রতি গড়পড়তা নগদ ১৭ হাজার ৩৪৯ টাকা আয় হয়েছে। এ জন্য বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত ৪৯ দিন নিজ শ্রম নিয়োগের সুযোগ হয়েছে। অন্যের জমি চুক্তিতে আবাদ করে আয় হয়েছে ১৩ হাজার ৭১০ টাকা। আর নিজ জমিতে মজুরি খরচ বাদ দিয়ে আয় হয়েছে ৯ হাজার ৭৪১ টাকা। এরই মধ্যে ধানবীজের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। সার ও সেচ বাবদ খরচে পার্থক্য হয়েছে। ফলে ধান আবাদে ফলন বৃদ্ধি হলেও লাভের পরিমাণ কমে গেছে। নিজ জমিতে বা জমি চুক্তি নিয়ে নিজস্ব শ্রম বিনিয়োগে আয় কিছুটা বাড়লেও নিজ জমিতে মজুরি খরচ বাদ দিয়ে লাভের পরিমাণে তেমন পার্থক্য হয়নি। এ অবস্থায় কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানো কিংবা বেশি মুনাফা দিতে প্রযুক্তির বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে অর্ধেকের বেশি কৃষি পরিবারের মালিকানায় জমির পরিমাণ এক একরের কম। বছরে নিজ জমিতে বা চুক্তিতে দুবার ধান চাষ করেও এসব পরিবারের প্রয়োজনীয় খরচ মেটানো দুষ্কর হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে যাদের বেশি জমি, তাদের ধান আবাদে বিনিয়োগের আকার অনুযায়ী লাভের পরিমাণ কমে গেছে। সেই সঙ্গে আছে নানা রকম ঝুঁকি। এদিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলেও ফসলের দাম ২০০৯-১০ সালের পর থেকে আর উঠছে না। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে পাওয়া বাজারদর অনুযায়ী সারা দেশে মোটা আমন চালের খুচরা মূল্য গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতি কিলোগ্রাম সর্বোচ্চ ৩১ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এ চালের দাম ২০১০ সালের ওই মাসে প্রতি কিলোগ্রাম সর্বোচ্চ ২৮ টাকা ছিল। অর্থাৎ, প্রতি কিলোগ্রাম গড়পড়তা ৩ টাকা বেড়েছে। একই সময়ে সরু আমন চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে প্রতি কিলোগ্রাম সর্বোচ্চ ৪ টাকা। গত ছয় বছরে সাধারণ হিসাবে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ১০ শতাংশ। অন্যদিকে দেশে এই সময়ে বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ শতাংশের ওপর থেকে ১১ শতাংশের কাছাকাছি। অন্যান্য ফসলের দাম বাড়লেও মুনাফা বিশেষণে কৃষকদের পে সন্তোষজনক এমন কোনো পার্থক্য দেখা যাবে না।
কিন্তু প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা একটি সূ বিষয়। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব, কিন্তু আমাদের দেশে প্রযুক্তি ব্যবহারের দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের দেশে প্রযুক্তির এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা বেশ কঠিন। আবার অতীতে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে যে ভালো ফল পাওয়া গেছে, সেটাও বলা যাচ্ছে না। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রযুক্তির একটি অন্যতম বিষয় হতে পারে জেনেটিকস।
তাই জেনেটিকস বা জিন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করতে হবে। দেশে গবেষণার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশের গবেষণার ভান্ডারগুলোকে অগ্রগামী করার জন্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের গবেষণাগার ও প্রযুক্তির সাথে সমন্বয় করে চলতে হবে। তা না হলে মানুষ বাইরের প্রযুক্তিগুলোর দিকে তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়বে। এতে যেকোনোভাবেই হোক ত্রুটিযুক্ত প্রযুক্তি দেশে চলে আসার সম্ভাবনা থাকবে। ভালো প্রযুক্তি এলে তো ভালো। কিন্তু যদি ত্রুটিযুক্ত প্রযুক্তি চলে আসে, তাহলে আমাদের প্রযুক্তির ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এ কারণে প্রযুক্তির এসব চিন্তাভাবনা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। প্রযুক্তির এসব বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটি করতে হলে সরকারের প থেকে বেসরকারি খাতকে নীতি-সহয়তার পাশাপাশি গবেষণার জন্য আর্থিক সহয়তা দিতে হবে। আবার যেসব প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও সম্প্রসারণের কাজ করতে আগ্রহী, তাদের স্বল্প সুদের যে ঋণ ব্যবস্থাপনা রয়েছে, তা সহজলভ্য করতে হবে। যেমন ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সহয়তা দিচ্ছে। এরই মধ্যে ইউএসআইডি বাংলাদেশের কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাঠামোগত উন্নয়নে ধারণতা নির্মাণের জন্য সহয়তা দিয়েছে। নেদারল্যান্ডস সরকারও কিছু প্রযুক্তিগত সহয়তা দিয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য দেশের সরকার এসব খাতে সহয়তা দিচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এ ধরনের সহায়তা দেওয়ার কারণও রয়েছে। এ কাজের মাধ্যমে দেশের প্রাইভেট সেক্টর ও বাইরের দেশের প্রাইভেট সেক্টরের মধ্যে মধ্যস্থতা বজায় থাকবে। এতে যোগাযোগ করা সহজ হবে এবং উভয়ের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। সেখানে আবার আগাম প্রতিশ্রুতি আছে। এর ফলে প্রযুক্তিগুলো খুব তাড়াতাড়ি দেশে আসবে এবং আমাদের কৃষি তুলনামূলক ভালো থাকবে; যার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। এতে উৎপাদন খরচ কমে যাবে, লাভ বেশি হবে, সর্বশেষ দেশের উন্নতি হবে। এটাকে ভিত্তি ধরে দেশের জন্য কিছু কাজ করা উচিত।
ইদানীং আমরা ল করেছি যে আমাদের দেশের যেসব বিজ্ঞানী দেশের বাইরে কাজ করতেন, তাঁদেরও দেশে আসার পর কাজ করার আগ্রহ বেড়ে গেছে। অথচ কয়েক বছর আগেও প্রতি মাসেই কোনো না কোনো বিজ্ঞানী কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে চাকরি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ইু গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কৃষি বিজ্ঞানীরা চাকরি ছাড়ার কারণে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন বিভাগ কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। যাঁরা চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের বিকল্প তৈরি হচ্ছে না। তাঁরা এসব েেত্র পদবঞ্চিত কিংবা অনুজ্জ্বল ভবিষ্যতের কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।
আরা জানি, এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি গবেষণা সেক্টরে নানা সহায়তা আসছে। কিন্তু সেসব ব্যবহারের জন্য যোগ্য লোক নেই। মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানীদের আমরা ধরে রাখতে পারছি না। অনেকে প্রশিণ বা উচ্চশিার জন্য বিদেশে গিয়ে আর ফিরছেন না। অনেকে চাকরি ছেড়েই বিদেশে যাচ্ছেন। তবে এ ধরনের পরিস্থিতির পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। যেহেতু প্রাইভেট সেক্টর বিভিন্নভাবে গবেষণার ক্যাপাসিটি বিল্ড করেছে এসব জায়গায়, সেহেতু আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা ফিরে আসতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে দু-একটি জায়গায় কাজ শুরু করেছেন এবং কাজ করছেন। এ জন্য দেশের ট্রেনিং দতা আরও গতিশীল ও বেগবান করতে হবে।
এমন অবস্থা সৃষ্টি হলে আমাদের দেশের জনশক্তি বাইরের দেশে যাবে না এবং গেলেও একটা লাভ আছে। কেননা, তাঁরা সেখান খেকে কিছু শিখে আসবেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করবেন। এসব ট্রেনিং শুধু ফসলের ওপর দিলে হবে না। যেমন মাঠ ফসল, সবজি, অন্যান্য মাঠ ফসল, মুরগি চাষ, মাছ চাষ ও গরু চাষের ওপর ট্রেনিং দিতে হবে। এখন ইস্যুটা হলো আমরা গবেষণা কোথায় করব? আমরা বিভিন্ন অধ্যায়ে গবেষণা নিয়ে আলোচনা করেছি। যেমন আমরা মাঠ ফসল নিয়ে গবেষণা করতে পারি। যদিও মাঠ ফসল উৎপাদন গড়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের দেশ এগিয়ে রয়েছে।
এসব জায়গায় আমাদের কাজ করতে হবে। বিশ্বে জলবায়ু ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হচ্ছে এবং আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। যেমন দণিাঞ্চলে লবণাক্ততা, উত্তরাঞ্চলে পানি কমে যাচ্ছে, মধ্যাঞ্চলে বন্যাপ্লাবিত এলাকা বাড়ছে। এসব জায়গায় আমাদের দেশের কৃষকেরা কৃষিকাজ করতে শুরু করেছেন এবং কীভাবে কৃষিকাজ করতে হয় তা শিখে গেছেন। কিন্তু এভাবে কৃষিকাজ করলে হবে না। এর জন্য জেনেটিকস বিজ্ঞান লাগবে এবং জেনেটিকসের দরকার আছে। দেশে যেহেতু মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে, সেহেতু তাদের হাতের আয় বাড়ছে। যেহেতু মানুষ ডালের পাশাপাশি সবজি খায়, সেহেতু ডাল ও সবজির উৎপাদন বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে, এ েেত্র ডালের উৎপাদন বাড়াতে হলে দেশে ভালো জাতের ডালের বীজ আনতে হবে। আবার আমরা গবাদিপশু পালন করছি, সেহেতু গবাদিপশুর খাদ্য লাগবে। গবাদিপশুর খাদ্য উৎপাদন করার জন্য যেসব উপাদান লাগবে, সেসব উপাদান যদিও দেশে উৎপাদন হচ্ছে, তারপরও আমদানিও অনেক হচ্ছে। তাই আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশের মধ্যেই উৎপাদন বাড়াতে হবে।
আবার দেশে মাছ চাষে সফলতা এলেও হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন অনেক কম। মাছের গড় উৎপাদন বাড়াতে হলে আমাদের দেশের মৎস্য গবেষণায় প্রচণ্ডভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মাছের জেনেটিকস, মাছের হাইজিন, পুকুর ব্যবস্থাপনা, উচ্চ গুণাগুণসমৃদ্ধ মাছ, নিরাপদ মাছ, মাল্টিলেয়ার ফিশিং ও মাছের খাদ্যের গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা ও বিনিয়োগ করতে হবে। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে দেশে পোলট্রির চাহিদা বেড়েছে। পোলট্রিতে আমরা ক্রস ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে কাজ করি। এটাকে যদি ৫০ দিনে ৮০০ গ্রাম করতে পারি, তাহলে আমরা ভালো লাভ করতে পারি। সে েেত্র বিদেশি বা পাকিস্তানি জাতের ওপর নির্ভর করতে হবে না। যদিও পাকিস্তানি জাতটি আমাদের দেশে মৃতপ্রায়।
দেশীয় গরু থেকে আমরা দুধ ও মাংস কম পেয়ে থাকি। সে েেত্র আমাদের গবাদিপশুর জেনেটিকস নিয়ে গবেষণা করতে হবে। এ ছাড়া গবাদিপশুর স্বাস্থ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির ওপর গবেষণা করতে হবে। গবাদি পশুর একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে এবং এর প্রয়োজনও রয়েছে আমাদের। দুধ উৎপাদনে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে চাহিদা পূরণের েেত্র একটা বড় ধরনের ফারাক রয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, ৯০ ভাগ গবাদিপশু এখনো পারিবারিকভাবে পালন করা হচ্ছে। গবাদিপশু পালনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব। যে গরু এক লিটার দুধ দেয়, ওই গরু থেকে যদি ১০ লিটার দুধ উৎপাদন করা যায়, তাহলে উৎপাদন খরচ এখনকার তুলনায় ১০ ভাগ কমে যাবে। তখন ২০ টাকা দুধ বিক্রি করলেও চলবে। কিন্তু আজকে ৪০ টাকা লিটার দুধ বিক্রি করেও মুনাফা হয় না।
বেলজিয়ামের একটি গবাদিপশু মেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি, তারা ২৯ টাকা লিটার দুধ বিক্রি করে মুনাফা করছে এবং বাণিজ্যিকভাবে গরু পালছে। আমাদের দেশে এটা করতে হলে ুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রশিণ দিতে হবে, তাঁদের হাতে প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে হবে। এটা খুব কঠিন কোনো কাজ হবে না। আমরা বিভিন্ন খাতে পরোভাবে ভর্তুকি দিচ্ছি। লাইভস্টক খাতে প্রত্যভাবে ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিণকেন্দ্র চালু করে। এখানে ুদ্র ব্যবসায়ীরা প্রশিণ নেবে,  পাশাপাশি এই খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করা যেতে পারে।
আমি মনে করি লাইভস্টকের একটি দিকে বেশি নজর দিতে হবে। আমাদের দেশে এখনো সঠিক ব্রিড নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। লাইভস্টক ব্রিডিংয়ে সমস্যা এখন সংকটে রূপ নিয়েছে। তবে এখন ব্রিড নীতি নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা না থাকলেও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আচরণ রহস্যজনক। যখনই ব্রিড আমদানির আবদেন বা স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়, তখন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। এমন অন্ধকার পরিস্থিতিতে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা খুব কঠিন। শুরুতে যে কয়েকটি খাতের কথা বলেছিলাম, সেগুলোর সফলতার পেছনে কিন্তু বেসরকারি বা ব্যক্তি খাতের বড় ধরনের অবদান রয়েছে। তাই বিদ্যমান নীতির আলোকে থেকেই যদি ব্রিড আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়, নতুন নতুন ব্রিডের ট্রায়াল করতে দেওয়া হয়, ডেভেলপমেন্ট করা হয়, বেসরকারি খাতকে যুক্ত করা হয়, তবে ভালো ফল আসবে। ভালো ব্রিড হলে উৎপাদনশীলতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। কৃষকদের প্রশিণ দেওয়া হলো, অথচ ব্রিড ভালো দেওয়া হলো না, তাহলে উন্নয়ন হবে না। আমরা দুই বছর আগে একটা প্রযুক্তির বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলাম। ওই প্রযুক্তি তখনো ভারত চালু করেনি। এখন যদি খোঁজ নেন তাহলে দেখা যাবে, গত এক বছরে ভারতের প্রতিটি ফার্মে এটা টেস্ট করা হচ্ছে এবং চালু করা হয়েছে।  অথচ আমাদের দেশে বিষয়টি এখনো অন্ধকারে রয়েছে। এ নিয়ে যদি কোনো পলিসি করা হয়, তবে বেসরকারি খাত তা গ্রহণ করবে এবং তা মেনেই বিনিয়োগ করবে। বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া আজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে গেছে।
সতর্ক হতে পবে গাভি লালন-পালন ও পরিচর্যায়। কোনো দুধ দেওয়া গরুর ওলানে যদি ইনফেকশন হয়ে যায়, তবে তা নন-প্রডাক্টিভ হয়ে যায়। এতে কৃষকের মারাত্মক তি হয়। এটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কিছু নয়। হাইজিন পদ্ধতিটা সঠিকভাবে কৃষককে শেখানো গেলেই এটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে ভেটেরিনারি হসপিটাল খুবই কম। পশুর জন্য বেসরকারি হসপিটাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার নেই। এ েেত্র সরকার আর্থিক সহায়তা বা স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিলে বেসরকারি হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠবে। গরুর রোগ সহজে প্রতিরোধ করা যাবে।
দুধ সংগ্রহ ও বিপণনের জন্য উদ্যোক্তা তৈরিতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দুধ বিক্রি বাড়লে আমাদের দেশের শিশুদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে, কৃষকদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসবে এবং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হবে। কখন উৎপাদন করা উচিত, কী পরিমাণ উৎপাদন করা উচিত, কখন বাজারে গেলে মুনাফা হবে এ নিয়ে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। গবাদিপশু খাতের উন্নতি করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।
শস্য খাতের উন্নয়নে দেশের আবহাওয়া-সম্পর্কিত সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমন খরা, অলো, হঠাৎ করে আর্দ্রতা, হঠাৎ করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, শীতকালে হঠাৎ করে তাপমাত্রা কমে যাওয়া, বৃষ্টি অনেক বেশি হওয়া, পোকা ও ভাইরাসের আক্রমণ বেড়ে যাওয়া এবং ফাঙ্গাস হওয়া অথবা বন্যা ইত্যাদির কারণে আমাদের দেশের ফসল ও প্রাণীর মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে। এসব সমস্যা সমাধানের সঠিক তথ্য ব্যবহার করতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের গবেষণা করতে হবে এবং অন্যান্য দেশেরে যেসব স্যাটেলাইট ডেটা আছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে কৃষককে সহয়তা করতে হবে, যাতে কৃষকেরা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের পরিকল্পনা করতে পারে।
কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন : কৃষি গবেষণা সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে। তবে এনজিও ও প্রাইভেট সেক্টরকে সম্পৃক্ত করে কর্মসূচি উন্নয়নের প্রচেষ্টা নেওয়া যায়। একবিংশ শতকের কৃষির বৈজ্ঞানিক উন্নয়নকল্পে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের দশটি প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য আরও বাড়াতে হবে এবং এ জন্য জৈব প্রযুক্তি গবেষণা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, উন্নতমানের গবেষণার অনুকূলে সহায়তাদানসহ বর্ধিত তথ্য সিস্টেম, সুবিধা ও খামারিদের চাহিদাভিত্তিক গবেষণায় অগ্রাধিকার এবং বিজ্ঞানীদের পর্যাপ্ত প্রণোদনাকাঠামো গড়ে তুলতে সহায়তা করতে হবে। পশুসম্পদ, পোলট্রি, মৎস্য, বনসহ শস্যবহির্ভূত সেক্টরের গবেষণা ও উন্নয়নে বর্ধিত মনোযোগ দিতে হবে। গভীর বন্যাযুক্ত এলাকা, চর, বন্যাপ্রবণ এলাকা, উপকূলীয় জোয়ার ও লবণাক্ততাপ্রবণ এলাকা এবং পাহাড়ি অঞ্চলের চাষিদের জন্য শস্যজাত উদ্ভাবনকল্পে জাতীয় জৈব প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে গবেষণা পরিচালনার ব্যবস্থা নিতে হবে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষিসহ সার্বিক গবেষণা ও উন্নয়ন (জ্উ) খাতে জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ বর্তমানের দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে বৃদ্ধির সুপারিশ রাখা হয়েছে। গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধিতে সবিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
প্রযুক্তি বিতরণ : চাষি, ভূমিহীন চাষি ও বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী এবং নারীসহ বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে অংশগ্রহণমূলক সম্প্রসারণ সেবার ওপর জোর দিতে হবে। প্রাইভেট সেক্টর ও এনজিওর সঙ্গে যাঁরা এরই মধ্যে প্রতিশ্র“তিশীল প্রযুক্তি বিতরণে বেশ কিছু সফল পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের সমবায়গুলোর অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে।
কৃষি থেকে প্রাপ্ত দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও কর্মসংস্থান থেকে বোঝা যায়, কৃষি এ দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার েেত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচনে এবং খাদ্যের পুষ্টিমানের দৃষ্টিকোণ থেকে কৃষির ভূমিকা অনন্য। অবশ্য শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে মোট উৎপাদনে কৃষির অবদান হ্রাসের পাশাপাশি শিল্প ও সেবা খাতের অংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তদুপরি একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশের গ্রামীণ জনগণের আয় ও কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে কৃষির ভূমিকা অব্যাহত থাকবে।

অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানকে সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ করার পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নগরায়ণের চাপ মোকাবেলার জন্য কৃষিজমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের বহুমুখীকরণের কৌশল অবলম্বন, উৎপাদনব্যবস্থার দতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্রয়যোগ্য মূল্যে খাদ্যের সরবরাহ, বণ্টন ও বাজারব্যবস্থা নিবিড় পরিবীণ, ভূপ্রকৃতি অনুযায়ী খাদ্যশস্যের আবাদ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে লাগসই বীজ, খাদ্য ও খাদ্যজাতীয় ফসল উৎপাদনে প্রযুক্তির উদ্ভাবনমূলক গবেষণায় প্রণোদনা প্রদান এবং যথাযথ কৃষি সম্প্রসারণব্যবস্থা প্রণয়ন করার আবশ্যকতা রয়েছে। কৃষি খাতের উন্নয়নে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ল্েয ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কৃষকদের ঋণপ্রাপ্তিতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, কৃষির যান্ত্রিকীকরণের ল্েয কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় উপকরণ কৃষকদের কাছে সহজলভ্য করা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের অত্যধিক মূল্য বৃদ্ধি আমাদের দেশের খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার বিষয়টিকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। এই প্রোপটে দেশের কৃষিকে এগিয়ে নিতে উন্নত প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও জেনেটিকসের ব্যবহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এতে একবিংশ শতাব্দীর উপযুক্ত শিল্প অর্থনীতির অনুকূল একটি কৃষি অর্থনীতি বাংলাদেশে গড়ে উঠবে।