‘কৃষি টেকনোলজিকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় বাজেট করতে হবে’

ড. এফ এইচ আনসারী : আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ ধারাবাহিক এবং এটি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য আসলেই গর্বের ব্যাপার। সাথে সাথে আমাদের মনে রাখতে হবে এই প্রবৃদ্ধিটা প্রাথমিকভাবে অর্জিত হয়েছে দুই থেকে তিনটা সেক্টরকে প্রাধান্য দেয়ার কারণে। এ খাতগুলো রপ্তানি নির্ভর।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মানে হলো আমরা যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু খাই, আর যেভাবে ব্যালান্স করে খাওয়া দরকার সেটুকুই খাই। আমাদের দেশে অর্ধেকের বেশি লোক কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষিতে শ্রম দেয়ার কারণে বর্তমানে আমরা গ্রেডে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। ধানে, সবজিতে, দুধে, তেলে, ঘাসে অর্থাৎ সব ধরণের ফসলেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। আর এটি করতে হলে কৃষিতে টেকনোলজির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

টেকনোলজির সাথে সাথে টেকনোলজির জন্য যে সমস্ত কন্ডিশন আছে সেগুলো প্রোডাক্টিভ করার জন্য এনসিউর করতে হবে। এসব প্রযুক্তিগত সুবিধাগুলো কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে সঠিকভাবে যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। আমাদের ৯০ শতাংশ কৃষি প্রাইভেট সেক্টরগুলো পরিচালনা করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরগুলোকে যদি সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে সম্পৃক্ত করে সমন্বয় করা যায় তাহলে ফল শুভ হবে। আর নতুন টেকনোলজিগুলোর সাথে কৃষকদের পরিচয় করিয়ে দেয়া গেলে, প্রযুক্তিগুলো তাদের শেখানো গেলে আমাদের কৃষি আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে, সমৃদ্ধ হবে।

অনেক বেশি সুবিধার জায়গা হলো, আমাদের সরকারি সংস্থাগুলোতে কৃষি সম্প্রসারণকর্মী আছেন। আমাদের দেশে প্রযুক্তিগুলো কয়েকভাবে আসে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে, রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে আর অনেক ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরগুলো বাইরের দেশের প্রযুক্তি এনে দেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর পর কৃষককের হাতে সেসব প্রযুক্তি তুলে দিচ্ছে। প্রাইভেট সেক্টরের হাতে এখন আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি আছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন কৃষক একটি ছোট জায়গায় স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারেন। তখন শুধু কৃষকই নয় কৃষিও একটি প্রোডাকটিভ খাত হবে। যা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। এখন দেশে যা চাহিদা আছে সেটা মেটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। আমাদের সমৃদ্ধির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা লাগবে। কারণ আমাদের অর্থনীতি অনেকটা বৈদশিক মুদ্রার উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে দুই একটা সেক্টর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে। এসব খাতের পাশাপাশি আমরা কৃষিকে অন্য একটা সেক্টর হিসেবে নিতে পারি। এটাকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে প্রোডাকটিভ করা গেলে ভালো হবে। একইসাথে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের কাজে লাগানোর পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরকে কাজে লাগানো গেলে আমাদের কৃষি যেমন দাঁড়িয়ে যাবে তেমনি কৃষকের আয়ও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তাছাড়া এ খাতে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব হবে।

তাই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আমরা কৃষি খাতটিকেই বেছে নিয়েছি। এক্ষেত্রে অন্য সেক্টরগুলোতে যদি ঝামেলা হয় বা লোকসান গুনতে হয় তাহলে কৃষি, গার্মেন্টস আর প্রবাসীদের রেমিটেন্স দিয়ে সেটা ব্যালান্স করা সম্ভব হবে।

তাহলে এটি ব্লেন্ডেড ইকোনোমি হবে। যা অত্যন্ত সহনশীল হবে। আর আমরা যে অবস্থাতে অর্থনৈতিকভাবে আছি সেটাকে আরো সাসটেইনেবল করা যাবে।

কৃষিতে ভালো করতে হলে- শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত কোনো বিষয় এখানে মূখ্য নয়। এখানে লাগবে প্রযুক্তি আর দক্ষতা। দক্ষতা তৈরি হবে তাকে শেখানোর মধ্য দিয়ে, তবে এক্ষেত্রে যারা শিক্ষিত তারাই তাড়াতাড়ি শিখবে।

আমাদের দেশে কৃষকের ছেলে কিন্তু কৃষি কাজ করতে আগ্রহী থাকে না। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে কাজ করতে হয় বলেই তারা কৃষিকাজ থেকে বিমুখ হয়ে পড়ে। কিন্তু কৃষিতে আগ্রহ না থাকলেও তারা ইনকাম করতে চায়, কাজ করে তারাও স্বাবলম্বী হতে চায়। তাদেরকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তাদের হাতে যন্ত্র তুলে দেয়া গেলে, তাদের কাজে কষ্ট কমিয়ে দেয়া গেলে, উৎপাদনে খরচ কমে মুনাফা বাড়লে তারাও এ কাজগুলোতে উৎসাহ ফিরে পাবে। আর এভাবেই আমাদের ইয়োথ জেনারেশনকে কৃষিতে ধরে রাখা যাবে। তারা আবারো কৃষিতে প্রোডাকটিভ হবে।

আলু নিয়ে দেশে অনেক কথা হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় অধিক উৎপাদন হওয়া। আমাদের দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৫ লাখ টন আলু উৎপাদন করা হয়। বর্তমানে দেশে আলুর চাহিদা বা প্রয়োজন ৬০ থেকে ৭০ লাখ টন। এটা সবজি জাতের আলু। বাইরের দেশের ফেঞ্চ ফ্রাই বা পটেটো চিপস তৈরির জন্য যে জাতের আলু দরকার তা আমরা চাষ করি না। আমাদের আলুতে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। এক্ষেত্রে উন্নত জাতের আলুর বীজ আনতে হবে। যা দেশীয় আবহাওয়ায় রোগ বালাই সহনশীল হবে।

ছোট্ট একটা বিষয় খেয়াল করুন, এক কেজি আলু রপ্তানি করে আমরা পাই ২৮ সেন্ট (মুদ্রা) বা ২০ টাকা। পক্ষান্তরে এক কেজি পটেটো ফ্লেক্স রপ্তানি করলে আমরা পাচ্ছি ২ ডলার বা ১৬০ টাকা। যদি ২ কেজি আলুতে এক কেজি ফ্লেগ উৎপাদন করা হয় তাহলে ৪০ টাকার আলু ১৬০ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব হবে। আসলে আমাদের দেশে বর্তমানে আলুর নতুন নতুন বীজ আনা জরুরি। একটা সুপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে আলুকে একটা ব্যবস্থাপনায় আনা গেলে এ খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হবে। এক্ষেত্রে দেশে আলুর চাহিদা ৬০-৭০ লাখ টন পূরণের পর বাকিগুলো আমরা রপ্তানি করতে পারব। এভাবে আলু লাভজনক অবস্থানে যেতে পারে। এই সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারি। আমার মনে হয় আলুর উপর আমাদের জোর দেয়া উচিত। জাত নির্ধারণ ও টেকনোলজি ব্যবহার করলে এ ফসলে আমরা লাভবান হবো।

মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়ে আমরা আসলেই গর্ববোধ করছি। এ অর্জন টিকিয়ে রাখতে হবে। দুই থেকে তিনটা ইকোনমির উপর নির্ভর করে আজকে আমরা এ অর্জন করেছি। কিন্তু দেশের বাইরের ওইসব ইকোনমি যদি কখনও ভঙ্গুর হয়ে যায় তাহলে আমরা এ অর্জন ধরে রাখতে পারব না। আমরা কখনই চাইবনা মধ্যম আয়ের দেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে প্রথমাবস্থায় ফিরে যেতে। এটাতে সাসটেইন করতে হলে নিজেদের স্পেশালিটির জায়গাটি খুঁজে বের করে তার ভিতে দাঁড়াতে হবে। আমরা যেহেতু কৃষিনির্ভর দেশ সেহেতু আমরা এ খাতে উন্নত বীজ আর টেকনোলজি এনে কৃষকের হাতে তুলে দিতে পারি। যাতে করে নতুন প্রজন্ম কাজ করে আনন্দ পাবে। কৃষি অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পরে সুফল আরো বেশি করে আসবে।

যেসব প্রযুক্তি বাংলাদেশের জন্য সংবেদনশীল যা বাংলাদেশের জন্য স্যুট করে না সেগুলো আমরা আনতে পারিনা। এক্ষেত্রে নিজেদের আবহাওয়া উপযোগী প্রযুক্তি আমাদের মেধাবী উদ্ভাবকরাই বের করে থাকেন। তাদের আরো বেশি উৎসাহিত করা গেলে আমরা কৃষিতে আরো নতুন মাত্রা যুক্ত করতে সক্ষম হবো। এক্ষেত্রে পাবলিক সেক্টরে পরীক্ষাগার তৈরি করে দিতে হবে।

টেকনোলজি উদ্ভাবন করতে মানব সম্পদের বিকল্প কিছু নেই। দেশে যে সমস্ত কৃষি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট রয়েছে তা থেকে যে মানবসম্পদ প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে, তারা পিএইচডি করতে দেশের বাইরে যাচ্ছে, সেখান থেকে তারা উন্নত প্রযুক্তি ও কৃষি নিয়ে দেশে ফিরছে।

প্রাইভেট সেক্টরগুলো এ খাতকে উৎসাহিত করতে ফান্ডিং করবে। কখনও কখনও লাইক এ গ্রান্ড কন্ট্রিবিউট করতে হবে। তাহলে এ খাতে অনেক বেশি কোম্পানি যুক্ত হবে। এতে করে এ বাজারে টিকে থাকার প্রতিযোগিতাও অনেকাংশে বেড়ে যাবে।

আর এসব কোম্পানি আমাদের দেশের শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত লোকগুলোর হাতে টেকনোলজি তুলে দেবে। আমাদেও দেশে যত মডার্ণ কমিউনিকেশন ট্যুলস আছে সেগুলো আমাদের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হাতে তুলে দিতে হবে। এর ফলে শক্তিটা অনেক বেশি কাজে লাগবে।

প্রচুর পরিমাণে অর্থনৈতিক রিসোর্চ দিতে হবে পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরে। তাহলে কৃষি আগাবে। আর এতেই মধ্যম আয়ের দেশে কৃষির কন্ট্রিবিউশন থাকবে। সে জন্যই আগামী বাজেট থেকেই কৃষি খাতে সরকারের সুনজর দেয়া উচিত। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বাজেট ৪ থেকে ৫ গুণ বাড়ানো উচিত। কারণ কৃষি রিসার্চে সিস্টেমেটিক্যালি বরাদ্দ দিলে ওভারঅল স্পীড ঠিক থাকবে, গ্রোথ ঠিক থাকবে।

ড. এফ এইচ আনসারী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও
এসিআই এগ্রিবিজনেস।

জাকির/এমআর/আরএম