গার্মেন্টস কারখানা সংস্কারে সহযোগিতার আহবান প্রধানমন্ত্রীর

বিভিন্ন ব্রান্ড ও ক্রেতাগণকে গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের কারখানাগুলোর সংস্কার কার্যক্রমে সহযোগিতার আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গুরুত্বারোপ করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সোনারগাঁও হোটেলে ‘দ্বিতীয় ঢাকা অ্যাপারেল সামিট ২০১৭’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। খবর বাসসের।

২০১৪ সালের প্রথম অ্যাপারেল সামিটের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক এবং রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) দিনভর এই দ্বিতীয় অ্যাপারেল সামিটের আয়োজন করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্রান্ড ও ক্রেতাগণ সহায়তা করতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’

২০২১ সালের মধ্যে তৈরি পোশাকখাতের রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ৫০ বিলিয়ন ডলার অর্জনে কর্মপন্থা প্রণয়ন এবং তৈরি পোশাকখাতকে একটি টেকসই উন্নয়নখাত হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে আয়োজিত এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘টুগেদার এ বেটার টুমরো।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্ব বাজারে আমাদের পণ্যসামগ্রীর চাহিদা কীভাবে বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে আমাদের কাজ করতে হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এজন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পোশাকশিল্পকে নিরাপদ করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গৃহীত উদ্যোগের আওতায় ইতোমধ্যে ৩ হাজার ৮৬৯টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। ‍এগুলোর মধ্যে মাত্র ৩৯টি কারখানায় ত্রুটি পাওয়া গেছে এবং সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা উন্নয়নে সংস্কার কার্যক্রম চলছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিজিএমইএ, সরকার, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ, উন্নয়ন সহযোগী সবাই মিলে একটি নিরাপদ ও টেকসই শিল্প গড়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছি।

পুরাতন বাজারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে শিল্প উদ্যোক্তাদের নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করে রফতানি বৃদ্ধির আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের রফতানি আয় বৃদ্ধি করতে হলে পণ্যের বৈচিত্র্য এবং পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের রফতানি মূলত উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশনির্ভর। রফতানির ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি ভালো না। আমাদের রফতানিযোগ্য পণ্যের তালিকা বৃদ্ধির অনেক সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি আমাদের নতুন নতুন দেশে রফতানির সুযোগ তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে আমি রফতানিকারকদের আরও মনোযোগী হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা এগিয়ে আসুন, সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, পোশাকশিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এ খাতে। যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই নারী। পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটিরও বেশি মানুষ এ শিল্পের উপর নির্ভরশীল।

তিনি বলেন, পোশাকশিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ, বিশেষ করে এর আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে বিজিএমইএ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। পাশাপাশি আমার সরকারও প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী আমরা বিজিএমইএকে সিও ইস্যু করার ক্ষমতা প্রদান করেছি। পোশাকশিল্পের স্বার্থে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য পোশাকশিল্প সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

সরকার প্রধান বলেন, তাঁর সরকার ২০১৪ সালে তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করার পর থেকে পোশাকশিল্পের স্বার্থে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে- এ শিল্পে অগ্রিম আয়কর ১ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৭ শূন্য শতাংশ করা এবং তৈরি পোশাকশিল্পে কর্পোরেট করের হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির জন্য রফতানিমুখী পোশাকশিল্পে প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং-এর কাঁচামাল ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সকল পোশাক রফতানিতে ‘০’দশমিক ২৫ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা এবং পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৫ হাজার ৩শ টাকা করার কথাও উল্লেখ করেন।

মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার শ্রমিক-মালিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, শ্রমিকদের আইনগত অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং শ্রম কল্যাণে বহুবিধ কর্মসূচি যেমন-শ্রমকল্যাণ ফাউন্ডেশন এবং রফতানিমুখী শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য কল্যাণ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী-কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে শক্তিশালীকরণ, ন্যূনতম মজুরি কমিশন শক্তিশালী করা, রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান, শ্রম আইন সংশোধন এবং শ্রম বিধিমালা জারির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থাসহ পোশাকশিল্প এলাকায় নিরাপত্তা প্রদানের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ গঠনের পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন।

‘পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা যাতে ২ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের জন্য নিজস্ব জমিতে ডরমিটরি স্থাপন করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করে দিয়েছি,’ উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের খন্ডচিত্র তুলে ধরে বলেন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ‘রোল মডেল।’ গত বছর ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রফতানি আয় ৩৪ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে। গত ৮ বছরে ৫ কোটিরও বেশি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উঠে এসেছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ১,৪৬৬ ডলার। মেট্রোরেল ও বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলছে। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ৪-লেনে উন্নীত করা হয়েছে। ২০১৮ সালে পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলবে।

শেখ হাসিনা বলেন, সারাদেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে ২টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বিজিএমইএকে দেওয়া হবে। ৪-লেন বিশিষ্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ৬-লেনে উন্নীত করার বিষয়টি আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে।

সরকার প্রধান বলেন, এ্যাপারেল সামিট-২০১৭ চলাকালে বেশকিছু অধিবেশনের আয়োজন করা হয়েছে। আমি আশা করি, এসব অধিবেশন থেকে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো একটি উন্নততর বাংলাদেশ গড়ার পথে আমাদের আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী মুজিবুল হক এবং বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়েদুন।

বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি মাইনুদ্দিন আহমেদ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের অগ্রগতি নিয়ে একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শিত হয়।

অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূতবৃন্দ, কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ, দাতা সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ এবং তৈরি পোশাক খাতের দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।

সুত্র: দ্য রিপোর্ট