গ্যাঁটেবাত এবং ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের চিকিৎসা

ডা: শাহজাদা সেলিম
সাম্প্রতিককালে ইউরিক এসিড বিষয়ক আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এর কিছুটা যৌক্তিক কারণও আছে। রক্তে ইউরিক এসিডের আধিক্য ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের সাথে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ ইউরিক এসিড নিয়ে যে কারণে ব্যতিব্যস্ত তা হলো গ্যাঁটেবাত (Gout)। গ্যাঁটেবাত একটি তীব্র ব্যথাযুক্ত অস্থি সন্ধি প্রদাহ (ARTHRITIS), যা সাধারণত: একটি জয়েন্টকে আক্রান্ত করে। এই বাতটি রক্তে ইউরিক এসিড বেশি হবার কারণেই হয় এবং এতে ইউরিক এসিড বৃদ্ধির জন্য ক্রিস্টাল তৈরী হয়ে অস্থি সন্ধিতে জমা হয়।

ইউরিক এসিড আমরা খাদ্য থেকে পাই। প্রধান উৎস- মাংশ, মাছ ও শীম জাতীয় সবজি। অতএব, ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়াঃ ইউরিক এসিড বেড়ে গিয়ে সৃষ্ট ঝুঁকি সমূহ (গ্যাঁটেবাত ও মেটাবলিক রোগ সমূহ) প্রতিরোধ করতে হলে পরিমিত ইউরিক এসিডযুক্ত খাবার খেতে হবে। তবে, মনে রাখতে হবে যে, এটি গ্যাঁটেবাতের চিকিৎসা নয়: বরং এটি একটি প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থাপনা। এক্ষেত্রেও খাদ্য ব্যবস্থাপনার শুরুতেই ওজন কমানোর দিকে নজর দিতে হবে।

রক্তে ইউরিক এসিড কমাতে সহায়ক খাদ্য ব্যবস্থাপনা নিন্মরূপ হতে পারে-
প্রচুর পরিমাণে জল ও জলীয় খাদ্য গ্রহণ করুন (গরমকালে অন্তত: ৩.০-৩.৫ লিটার এবং শীতকালে ২.৫-৩.০ লিটার প্রতিদিন)। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাদ্যসমূহ প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে। বাংলাদেশে প্রায় ১২ মাসই এসব খাদ্য পাওয়া যায়। যেমন আমড়া, জাম্বুরা, আমলকি, লেবু (কামরাঙ্গা নয়), লটকন, টক চেরি ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে ভিটামিন সি যুক্ত ঔষধ খাওয়ার ও দরকার হতে পারে। ডাল, মিষ্টি আলু, তরমুজ, পেঁপে, শষ্যদানা (ওট, বাদামী চাল, বার্লী)।প্রচুর শাকসবজি খেতে হবে, যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, মাশরুম, পুঁইশাক, পালন শাক, ডাঁটাশাক ইত্যাদি। আঁশযুক্ত শাকসবজি, ভিটামিন ও খনিজ দ্রব্য এবং ফাইটো নিউট্রিয়েন্ট এ ক্ষেত্রে উপকারী। কিছু পরিমাণে মাছ, মাংশ (প্রতিদিন ৫০-৬০ গ্রামের বেশি নয়) খাওয়া যেতে পারে। ডেইরী প্রোডাক্ট ও সীমিত পরিমাণে খাওয়া সম্ভব। তবে, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উপাদান ও পানীয় বর্জন করতে হবে। বেশি পিউরিন আছে, এমন খাদ্য বর্জনীয়।

যে সব খাবারের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা করতে হবে তাদের তালিকাঃ
অবশ্যই বর্জনীয় – সামদ্রিক মাছ, লাল মাংশ, চিনিযুক্ত পানীয়, এলকোহল। বর্জন করা ভালো-গিলা, কলিজা, মগজ, যকৃৎ, বৃক্ক, চিনিযুক্ত পাউরুটি, ফলের রস, সোডা । সতর্কতার সাথে খাওয়া যাবে- খাশির মাংশ, স্যামন মাছ, মুরগী, বেকারীর কেক, ক্যান্ডি, পাস্তা। মনে রাখতে হবে, আদর্শ খাদ্য ব্যবস্থাপনা কর্মময় জীবন যাপন ও সুস্থ্যতার জন্য অপরিহার্য।

ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্ন
পায়ে নানা ধরনের আঘাত লাগার ঝুঁকি থাকলেও আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পায়ের তেমন একটা যত্ন নিই না। তাই ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের অনেকেই বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভুগে থাকেন। তাছাড়া ডায়াবেটিস জনিত পায়ের সমস্যা যেমন ইনফেকশন, ক্ষত হওয়া, গ্যাংগ্রিন ইত্যাদি ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি হবার একটা বড় কারণ।

পায়ের সমস্যার প্রাদুর্ভাব – ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের ৩-৮%।একবার ক্ষত হলে পরবর্তী ৫ বছরে ক্ষত হবার ঝুঁকি ৫০-৭০% বেড়ে যায়। ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের পা কেটে ফেলার মত সমস্যার ৮৫%ই শুরু হয় ছোট ক্ষত দিয়ে। শরীরের নিম্নাংগ কেটে ফেলার কারণগুলোর ভিতর ৫০-৭০%ই হয় ডায়াবেটিস জনিত জটিলতার কারণে ডায়াবেটিস জনিত পায়ের ক্ষত শুকাতে ১০-১৪ সপ্তাহ সময় লাগে।ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের Macro-vascular complication হিসেবে পায়ে রক্ত চলাচল কমে যেতে পারে এবং Micro-vascular complication এর কারণে নিউরোপ্যাথী থেকে নানা ধরনের আকৃতিগত পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। এগুলো ছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে নানা ধরনের ইনফেকশন হবার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। তাই এ সব কিছুর মিলিত প্রভাবে একজন ডায়াবেকি ব্যক্তির পায়ে নানা ধরনের সমস্যা হবার প্রবণতা দেখা দেয়।

তাছাড়া অন্যান্য যে সব কারণে পায়ে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে সেগুলো হলো – পায়ের জুতা সঠিক না হলে। পায়ের যথেষ্ট যত্ন না নিলে।পায়ে আঘাত লাগলে। ধূমপান/তামাক গ্রহণ করলে।

ডায়াবেটিস জনিত পায়ের সমস্যা তিন ধরণের- স্নায়ু বৈকল্য জনিত (Neuropath)। রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়া জনিত (Ischaemia)। ইনফেকশন জনিত
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পা।

নীচের যে কোন একটি বিদ্যমান থাকলে সেটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পা এবং সে ক্ষেত্রে বিশেষ যত্নবান হতে হবে-পায়ের রক্তচলাচল বন্ধ হওয়া বা কমে যাওয়া। পায়ের অনুভূতি না থাকা বা কমে যাওয়া।আকৃতিগত অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হওয়া। পা নাড়াচাড়া করতে না পারা। পায়ে পূর্বে কোন ক্ষত হয়ে থাকলে। পা আগে কোন কারণে কেটে ফেলা।

ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের সাধারণ সমস্যা সমূহ- কর্ণ/ক্যালাস, ফোস্কা পড়া, বুনিয়ন, ছত্রাকের আক্রমণ, কেটে যাওয়া, ক্ষত হওয়া, গ্যাংগ্রিন ইত্যাদি।

পা পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপ
প্রতি ৩ মাস থেকে ১ বছর সময়ের ভিতর পায়ের বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা করা জরুরী- ত্বক, রং, তাপমাত্রা, ক্যালাস আছে কিনা, কোন হাড় বা জোড়ার অসামঞ্জস্য আছে কিনা, ইনফেকশনের কোন লক্ষণ আছে কিনা, অস্বাভাবিক গরম থাকা। লাল হয়ে যাওয়া, ফুলে যাওয়া, ব্যথা হওয়া, পুঁজ বা পানি বের হওয়া, রক্তক্ষরণ আছে কিনা, পুরু নখ আছে কিনা, আগে কোন ক্ষত বা কেটে ফেলা হয়েছে কিনা, রক্ত চলাচল ঠিক আছে কিনা, কম্পনের অনুভূতি ঠিক আছে কিনা , গরম/ঠান্ডার অনুভূতি ঠিক আছে কিন্তু পরিধান করা জুতা/স্যান্ডেল আদর্শ কিনা।

নিজে পা পরীক্ষা করা- সম্ভব হলে প্রতিদিন পা পর্যবেক্ষণ করা, বিশেষ করে উপরের দিক, পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে এবং পায়ের তলা ভালভাবে পরীক্ষা করা জরুরী।অনুভব করা এবং খুঁজে দেখা- পায়ে কোন ক্ষত, ফোস্কা, ঘা, রঙ বদলে যাওয়া বা ছড়ে যাওয়া আছে কিনা। পায়ের তলা দেখার জন্য প্রয়োজনে বন্ধু/পরিবারের অন্য সদস্য/আয়নার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

পায়ের যত্নের উল্লেখযোগ্য বিষয়- পা কখনো শুকনো খস খসে রাখা যাবে না, প্রয়োজনে লোশন বা ভ্যাসলিন ব্যবহার করতে হবে। পায়ের আঙ্গুলের মাঝের জায়গাগুলো যাতে ভেজা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরী।পায়ের নখগুলো খুব বেশী ছোট করা ঠিক নয়, বিশেষ করে নখের কোণা গভীর করে কাটা উচিত নয়।বেশী গরম পানিতে পা ভিজিয়ে রাখা বা পরিষ্কার করা উচিত নয়।কখনোই খালি পায়ে থাকা উচিত না। জুতা অবশ্যই নরম, মাপমত হওয়া জরুরী। মোজা অবশ্যই সুতা বা উলের হওয়া উচিত এবং মোজার উপরের দিকের রাবার খুব বেশী টাইট হওয়া উচিত নয়। নতুন জুতা কেনার সময় বিকেলের দিকে কেনা উচিত এবং অবশ্যই মোটা মোজা পরে সাইজ পরীক্ষা করা উচিত। প্রথম দিনই দীর্ঘসময় নতুন জুতা পরে না থাকাই শ্রেয়। পায়ে যে কোন ধরনের পরিবর্তন দেখা দিলে অবশ্যই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।

যে সকল উপসর্গ থাকলে জরুরী চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন- পায়ে ব্যথা হওয়া।পা লাল হওলা বা রঙ পরিবর্তন হওয়া।পা খুব গরম হয়ে যাওয়া।পায়ে কোন রকম দুর্গন্ধ হওয়া।পা থেকে কোন ধরনের রস নি:সৃত হওয়া।পায়ে ক্ষত বা ফোস্কা দেখা দেওয়া।অন্য যে কোন সমস্যা হওয়া।

যা করা উচিত-প্রতিদিন পা পরীক্ষা করা।সঠিক জুতা/স্যান্ডেল পরিধান করা।জুতা অবশ্যই মোজাসহ পরিধান করা।জুতা পরার আগে কোন লোহার টুকরা/ ইটের টুকরা আছে কিনা দেখা।ধর্মীয় স্থান যেখানে খালি পায়ে হাটতে হবে সেখানে সকালের দিকে ভ্রমণ করা।নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া।

যা করা উচিত নয়-

খালি পায়ে কখনোই থাকা যাবেনা, এমনকি ঘরের ভিতরেও না।সরু প্রান্ত বিশিষ্ট জুতা ব্যবহার করা। নিজে নিজে কোন রকম ঔষধ দিয়ে বা ব্লেড দিয়ে কর্ণ/ক্যালাস এর চিকিৎসা করা। ধূমপান/তামাক খাওয়া

ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজী বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ

আজকের বাজার: আরআর/ ১৬ আগস্ট ২০১৭