চট্টগ্রামে ২১ বছর জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি ‘জ্ঞান-প্রদীপ’

চট্টগ্রাম নগরীতে একুশ বছর ধরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি ‘জ্ঞান-প্রদীপ’। হাজার হাজার বইবাহী বিশেষভাবে নির্মিত দু’টি বাস প্রতিদিন রুটিন করে নগরীর বিভিন্ন স্পটে পৌছে যাচ্ছে। জ্ঞান-পিপাসু মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে বই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সাঈদ তাঁর নিজস্ব উদ্যোগে ২০০১ সালে এ ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালু করেন। তাঁর ব্যক্তিগত প্রয়াসে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়াতো এ চলমান বই বিতান। প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সাঈদের ইচ্ছায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে এ ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির দায়িত্ব নেয়। বর্তমানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অধীনে এর কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলমান দু’টি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির একটিকে বড় বাসে এবং একটিকে মিনি বাসে সাজানো হয়েছে। একজন লাইব্রেরিয়ান, একজন বাসচালক ও একজন হেল্পার এতে অবস্থান করেন। জেনারেটরের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো এবং প্রয়োজনে এয়ার কন্ডিশনার চালানোর কাজ চলে। একটিতে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে পাঠাগার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ সময়ে নগরীর ১২ থেকে ১৬ টি স্পটে গিয়ে দাঁড়ায় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। সপ্তাহের কোন দিন কোন্ স্পটে কতক্ষণ থাকবে তার রুটিন করা আছে। ফলে আগে থেকে পাঠকরা অপেক্ষায় থাকেন অথবা উক্ত সময়ের মধ্যে গাড়িতে এসে লাইব্রেরির কাজ সেরে নেন। লাইব্রেরির রুটিন প্রত্যেক সদস্যকে দেয়া আছে। এছাড়া, আগ্রহী কেউ চাইলে এ ছাপানো রুটিন দেয়া হয়।

বড় বাস লাইব্রেরিতে দায়িত্বরত কর্মকর্তা মাসুদ আলম বাসস’কে জানান, ‘মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহে ৬ দিন এভাবে শহরে ঘুরে ঘুরে আলো ছড়ায় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের এই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। কম করে হলেও ২৮ থেকে ৩০ হাজার বই রয়েছে এই লাইব্রেরিতে। সদস্য সংখ্যা গত ২ মার্চ দুপুর পর্যন্ত ২২ হাজার ৫৪ জন ছিলেন। সারাদেশের মধ্যে চট্টগ্রামে সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ। ছোট বাস-লাইব্রেরিতে রয়েছে ৮-৯ হাজার বই। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া সব ধরনের বই এখানে পাওয়া যায়। এর মাঝে গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, রম্য, কিশোর কাহিনী, গোয়েন্দা কাহিনী অন্যতম।’ তিনি জানান, করোনার ব্যাপক প্রকোপের সময় কঠোর লকডাউন চলাকালে লাইব্রেরি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এছাড়া, করোনার অন্য সময়গুলোতে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালু ছিল।

জামালখানে বড় বাসের লাইব্রেরিতে ঘণ্টাখানেক অবস্থান করলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সী পাঠকরা আসছেন এখানে। তবে বসে পড়ার বদলে বই বাসায় নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। এক্ষেত্রে সদস্যরা শ্রেণীভেদে এক বা একাধিক বই বদলে নিচ্ছেন। অপেক্ষার এ সময়ে পাঠকের চাপ তৈরি হলে লাইব্রেরিয়ানের সাথে লাইব্রেরির কাজে দক্ষতার সাথে সহযোগিতা করেন বাসচালক ও হেল্পার। বাসের কোন জায়গায় কি বই রাখা আছে মুখস্থ তাদের। আগ্রহী কেউ জানতে চাইলে ঝটপট সদস্য হওয়ার নিয়ম-কানুনও জানিয়ে দিতে পারছেন।

মাসুদ আলম আরো জানান, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে বই পেতে হলে সদস্য হতে হয়। একশ টাকায় সাধারণ সদস্য এবং দুইশ টাকা ফি পরিশোধ করে বিশেষ সদস্য হতে হয়। ফরম পূরণ করে বাসেই সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের মানুষ সদস্য হতে পারেন। লাইব্রেরি থেকে বই বাসায় নিতে হলে মাসিক দশ টাকা হারে ফি দিতে হয়।

একজন সাধারণ সদস্য একটি বই নিতে পারেন। তবে একাধিক সদস্য হলে বইও একাধিক নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এসব সদস্য প্রতি মাসে এই লাইব্রেরি থেকে বই নেন। পড়ে পুনরায় ফেরত দেন।

মাসুদ আলমের তথ্য মতে, নগরীর ৪০ টি স্পটের মধ্যে জামালখান সিঁড়ির গোড়া, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি ও ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঠক সংখ্যা অনেক বেশি। এখন করোনার প্রকোপ হ্রাস পাওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। ফলে শিক্ষার্থী পাঠকরা পুনরায় লাইব্রেরিতে ভিড় করছে। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থী পাঠকই বেশি।

বাসচালকের সাথে কথা বলে জানা যায়, যেহেতু তাদের স্পট নির্দিষ্ট, ফলে বড়ো বাসটি নিয়েও কোথাও দাঁড়াতে সমস্যা তেমন হয় না। মাঝে মাঝে এক-দু’জন দোকান মালিক তাদের দোকানের সামনে রাখা নিয়ে আপত্তি তুললেও পাঠক, পথচারী ও পুলিশ সবসময় তাদের সহায়তা করে। তারা নিজেরাও চেষ্টা করেন অন্যের অসুবিধা হয় না এমন স্থানে দাঁড়াতে।

লাইব্রেরির ষাটোর্ধ্ব এক সদস্যের সাথে কথা বললে তিনি জানান, অবসরের পর মূলত বই পড়েই সময় কাটে তাঁর। এক্ষেত্রে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি অনেক বেশি সহায়ক বলে মনে করেন তিনি। কেননা নিজের বাসার কাছাকাছি একটি স্থান থেকে তিনি নিয়মিত বই নিতে পারছেন। যাতায়াত খরচ ও ভোগান্তি কোনোটাই নেই। মাসিক ফিও অনেক কম।

অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর নগরীর আরো বেশ কিছু এলাকাকে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরলে লাইব্রেরিয়ান জানান, নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির আলো ছড়িয়ে দেয়া গেলে ভালো হতো। এর জন্য ৪-৫ টি গাড়ি-লাইব্রেরি লাগবে। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান