চালের মূল্যবৃদ্ধিতে জাতিসংঘের সতর্কবার্তা

বাংলাদেশে চালের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)।

সম্প্রতি এফএও’র বিশ্বের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে।

‘খাদ্য বাজারের প্রবণতা’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন মাসে দেশে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এই সময়ে দেশে খাদ্যের দাম, খাদ্যের সহজলভ্যতা ও খাদ্যের মানÑএই তিন ক্ষেত্রেই পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। খাবার পাওয়ার সুযোগ কমেছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। এবারই প্রথম বাংলাদেশের জন্য এমন সতর্কবার্তা দেওয়া হলো। গত এক মাসে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, দামও কমেছে। বিশেষ করে চাল-গম বা দানাদার খাবারের দাম কমতির দিকে। তবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের আটটি দেশের বাজারে প্রধান খাদ্য চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।

প্রতিবেদনটি মূলত এফএওর রোমে অবস্থিত প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতি মাসে প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ এই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গত মে থেকে আগস্টের মধ্যে চালের মূল্যবৃদ্ধি (কেজিপ্রতি ৪৮ টাকা) সর্বকালের রেকর্ড ভাঙে। কিন্তু আগস্টে দাম কিছুটা কমলেও তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি ছিল।

চালের দাম নিয়ে একই ধরনের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলঙ্কাকে। প্রধান খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মারাত্মক ধরনের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে আফ্রিকার দেশ দক্ষিণ সুদান, নাইজার, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ও বুরুন্ডিকে। এসব দেশের প্রধান খাদ্যের দাম অভ্যন্তরীণ বাজারে উদ্বেগজনক জায়গায় পৌঁছেছে।

এফএও ২০১০ সালের অক্টোবর থেকে এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। ওই প্রতিবেদনে মূলত বিশ্বের চাল ও গমের দামের প্রবণতা বিষয়ে বিশ্লেষণ ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। সেখানে বিশ্বের কোনো দেশে চাল ও গমের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের খাদ্য নিরাপত্তায় সংকট দেখা দিলে তারা সতর্কবার্তা দিয়ে থাকে।

ওই প্রতিবেদনে মূলত আফ্রিকার সাব সাহারার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর নাম খাদ্যঝুঁকিতে থাকার কারণে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়ে থাকে। চলতি বছরের মে মাসে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে খাদ্যঝুঁকি বিষয়ে তারা সতর্কবার্তা দেয়। ওই মাসে পেরু, কেনিয়া ও উগান্ডার নামও ছিল। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসায় পরবর্তী মাসগুলোতে ওই তিনটি দেশের নাম বাদ পড়ে বা সতর্কবার্তা তুলে দেওয়া হয়। চলতি বছরের মে মাস থেকে বাংলাদেশকে সতর্কবার্তা দেয় এফএও। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে না আসায় চার মাস ধরে বাংলাদেশের নামের পাশে ওই সতর্কবার্তার কথা উল্লেখ করা আছে।

বাংলাদেশে চালের দাম নিয়ে এফএওর এই উদ্বেগ ও সতর্কবার্তা নিয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী একটি গণমাধ্যমকে বলেন, চাল নিয়ে এফএও যে সতর্কবার্তা দিয়েছে, পরিস্থিতি তার চেয়েও খারাপ। সরকারি চালের মজুত সময়মতো বাড়ানো হয়নি। এরপর হাওর ও বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়ে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে। এখন সাত লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য তিন বেলা নিয়মিত খাবার দিতে হবে। সেই চালের জোগাড় এখন থেকেই করতে হবে। নয়তো সামনে আরও অনেক বিপদ অপেক্ষা করছে।
এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চালের দাম বেড়েছে মূলত গত বোরো মৌসুমে বন্যার পর ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর থেকে। পরে দুই দফা বন্যায় ধানের উৎপাদন আরেক দফা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত টানা চালের দাম বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত দুই দফায় চালের শুল্ক কমিয়ে দেয়। এতে বেসরকারি খাতে চালের আমদানি কিছুটা বেড়ে গিয়ে দাম কমতে থাকে। সরকার চালের আমদানি শুরু করায় বাজারে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাবও পড়ে।

তবে গত মঙ্গলবার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্যবিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহে প্রতি কেজি চালের দাম আবারও ৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে তা ছিল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা। আরেক সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক মাসে মোটা চালের দাম পৌনে ৬ শতাংশ বেড়ে ৪৮ টাকা কেজি এবং সরু চালের দাম প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

অবশ্য এখনো পর্যন্ত দেশে চালের মজুত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারি গুদামে চালের মজুত দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩২ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে ওই মজুতের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৯ হাজার ৫৫ টন। গত তিন মাসে সরকারি গুদাম থেকে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ১ লাখ ৯০ হাজার টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ৩ লাখ টনের ওপরে চাল বিতরণ করা হয়েছিল।

দেশের চালের বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ বলেন, জেলায় জেলায় ব্যবসায়ীদের চালের গুদামে হানা দিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টা চলছে, তা আত্মঘাতী হবে। দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে ব্যবসায়ীরা যাতে বাজারে বেশি করে চাল বিক্রি করে, সে জন্য তাঁদের উৎসাহিত করা দরকার। আর সরকারের কাজ হবে সরকারি চালের মজুত বাড়িয়ে গরিব মানুষের জন্য অল্প দামে চাল বিক্রির ব্যবস্থা করা। এভাবে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ালেই দাম কমবে। এর কোনো বিকল্প নেই।