বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

জাতীয়করণে বাড়তি বরাদ্দের প্রয়োজন নেই!

জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার বা এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গত ১০ জানুয়ারি থেকে অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে এ আন্দোলন শুরু হয়। পরে এই আন্দোলন রূপ নেয় আমরণ অনশন কর্মসূচিতে। এতেও দাবি আদায়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারায় সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘট পালন করে শিক্ষকরা। তাদের দাবি, শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে সরকারের বিশেষ কোন বরাদ্দ লাগবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করলে কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে তা এখনো হিসাব করা হয় নাই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। একই বছর বেসরকারী শিক্ষকদের ৭৩ দিনের আন্দোলনের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বেতন ৭৫ টাকা নির্ধারণ করেন। আর সহকারী শিক্ষকদের বেতন নির্ধারিত হয় ৫০ টাকা। পাশাপাশি চালু ছিলো রেশনিং ব্যবস্থাও। তৎকালীন সময়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে বেসরকারী মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হবে এবং পর্যায়ক্রমে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করা হবে।

১৯৭৩ সালের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়েছে। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট নয় এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। তাদের দাবি একটি সুর্নিদিষ্ট নীতিমালা  তৈরির মাধ্যমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে হবে। সর্বশেষ এ সরকারের আমলে জাতীয়করণ করা হয়েছে ৩৩৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

দেশে বর্তমানে মাধ্যমিক স্কুল, মাদ্রাসা, কারিগরি এবং কলেজ মিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে মোট ৩৮ হাজার ৪৭৮টি। এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষক রয়েছে ৫ লাখ ২২ হাজার ৬৭৭ জন। আর শিক্ষার্থী রয়েছে ১ কোটি ৬২ লাখ ৬৩ হাজার ৭২৪ জন। এ সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন প্রায় ৪ লাখ। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমপিও খাতে প্রতি মাসে সরকারের ৯ শত ২৫ কোটি থেকে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হয়।

আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মতে, জাতীয়করণ করলে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি বছরে ১ হাজার ৪৬৩ কোটি ৭৩ লাখ ৫১ হাজার ৬০০টাকা আয় হবে। এছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রিজার্ভ টাকা রয়েছে ৯৬ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার। ৪ হাজার ৭টি কলেজে রিজার্ভ আছে ৪০ কোটি ৭ লাখ টাকা, ৯ হাজার ৩৪১টি মাদ্রাসায় ন্যূনতম ৭০ কোটি ৫ লাখ টাকা রিজার্ভ রয়েছে। আবার মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যাদের নিজস্ব জমি, পুকুর, দোকান-পাঠ ইত্যাদী আছে তাদের বাৎসরিক আয় হবে ন্যূনতম ৩০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আয় ৪০২ কোটি ৪৯ লাখ ৪ হাজার ৩০০টাকা।

৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিগ্রী পর্যন্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন খাতে প্রতিমাসে সরকার ৯ শত ২৫ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার কোটি টাকা দিয়ে থাকে। আর বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সরকারী সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে ৫ হাজার টাকা নেওয়ার আইন রয়েছে। শিক্ষকদের দাবি, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যদি এই হারে টাকা নিয়ে সরকারী কোষাগারে জমা দেওয়া হয় তাহলে বর্তমান সময়ে ৬ষ্ঠ থেকে ডিগ্রী পর্যন্ত শিক্ষা ব্যববস্থা জাতীয়করণ করলে সরকারের কোন অতিরিক্ত বরাদ্দ লাগবেনা।

বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিটি বেশ পুরনো। তবে ৮০ ও ৯০ দশকে আন্দোলনের সময় প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের চেয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের স্কেল অনুযায়ী শতভাগ বেতন প্রদান এবং অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব পায়।

 ১৯৮০ সালে তৎকালীন সরকার প্রথমবারের মতো বেসরকারী শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করে। সে সময় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রতি ৩ মাস অন্তর যার যার স্কেল অনুয়ায়ী ৫০ ভাগ বেতন দেয়া শুরু হয়।

পরে এরশাদ সরকারের সময় ২০ ভাগ বাড়িয়ে ৭০ ভাগে উন্নীত করা হয়। খালেদা জিয়া সরকার তার প্রথম মেয়াদে (১৯৯১-১৯৯৬) বেতনের পরিমান বাড়িয়ে ৮০ ভাগ করেন। শেখ হাসিনা সরকার তার প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) আরও ১০ ভাগ বাড়িয়ে তা ৯০ভাগ করেন। সর্বশেষ খালেদা জিয়া সরকার (২০০১-২০০৬) সব ভগ্নাংশ উঠিয়ে দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন স্কেলের ১০০ ভাগ করেন। এছাড়া কল্যাণ তহবিল ও এককালীন অবসর ভাতাও শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। বর্তমানে শিক্ষকরা জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী মূল স্কেলের শতভাগ বেতন পাচ্ছেন।

এদিকে শিক্ষকরা বলছেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেসরকারী শিক্ষক সমাজ শিক্ষার ৯৭ শতাংশ দায়িত্ব পালন করে। আর সরকারী শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করে ৩ শতাংশ। এরপরও সরকারী শিক্ষকদের সঙ্গে বেসরকারী শিক্ষকদের আর্থিক বৈষম্য রয়েছে।

বেসরকারী শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরামের ব্যানারে  আন্দোলন চলছে। শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে মাঠে রয়েছেন তারা। এ অবস্থায় আন্দোলনরত শিক্ষকদের জাতীয়করণ করতে হলে প্রতি বছর সরকারের কি পরিমান অর্থ ব্যয় হবে তার কোন হিসেব করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ (মাধ্যমিক শাখা) আজকের বাজারকে বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করতে কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে বা বরাদ্দ দিতে হবে তা এখনো হিসেব করে দেখা হয় নাই।

বেসরকারী শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরামের আহ্বায়ক মো. আব্দুল খালেক বলেন, দেশের বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত। অথচ আমাদের জাতীয়করণের আওতাভুক্ত না করে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করলে সরকারের বিশেষ কোন বরাদ্দও দিতে হবে না। বাৎসরিক ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেই হয়তো হয়ে যাবে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে আয় তা সরকারী কোষাগারে নিয়ে নিলেই আর বরাদ্দ নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবেনা।

শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এর আগে গণমাধ্যমকে বলেন, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা সম্ভব নয়। যদি আমাদের এমন সুযোগ আসে তবে তা বিবেচনা করা হবে। আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। রাতারাতি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা সম্ভব নয়।

এদিকে শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের ১৪তম দিনে (রোববার পর্যন্ত) এসে ১৫৪ জন শিক্ষক অসুস্থ হয়েছেন। এদের মধ্যে ৫ জন শিক্ষককে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।  সরকারের পক্ষ থেকে কোন ঘোষণা না আসায় সোমবার ২৯ জানুয়ারি থেকে সারাদেশের বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাগাতার ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দিয়েছে বেসরকারী শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরাম।

আজকের বাজার : আরএম/এলকে ২৮ জানুয়ারি ২০১৮