জয়নুল-কামরুল-সুলতান-সফিউদ্দিনের সৃষ্টিকর্ম বুঝতে জাতির চিত্র স্বাক্ষরতা প্রয়োজন: মঈনুদ্দিন খালেদ

প্রখ্যাত শিল্প সমালোচনক মইনুদ্দীন খালেদ বলেছেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, এস এম সুলতান এবং সাফিউদ্দিন আহমেদরা আধুনিক শিল্পকর্মকে এমন এক অস্পৃশ্য পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, তাদের শিল্পকর্ম বোঝার জন্য জাতির চিত্র স্বাক্ষরতা (ইমেজ লিটারেসি) প্রয়োজন।

বুধবার রাতে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত কসমস-আতেলিয়ার৭১ আয়োজিত শিল্প সংক্রান্ত টক শো ‘কসমস আর্ট ইকো’র পঞ্চম পর্বে এ কথা বলেন তিনি।

চারজন কিংবদন্তি বাংলাদেশি শিল্পীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে যেয়ে অধ্যাপক মইনুদ্দীন খালেদ বলেন, ‘দেশের আধুনিক শিল্পকলার উন্নতির জন্য তাদের সহজ অথচ গভীর শিল্পকর্মের গভীর বিশ্লেষণ করা দরকার যা কেবলমাত্র অডিয়েন্স ও সহকর্মী শিল্পীদের উপযুক্ত চিত্রের সাক্ষরতার মাধ্যমেই অর্জন করা যেতে পারে।’

চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে অনলাইন প্লাটফর্মের জুমের মাধ্যমে রাজধানীর মালিবাগের কসমস সেন্টারে ‘শিল্পের চতুষ্কোণ: জয়নুল কামরুল সুলতান সফিউদ্দিন’ শীর্ষক শিল্প সংক্রান্ত টক শো’টির আয়োজন করা হয়।

আলোচনায় কিংবদন্তী ওই চারশিল্পী জীবদ্দশায় যে মূল্যবান শিল্পকর্ম ও নান্দনিকতার চিত্র তুলে ধরেছেন তার বিশদ আলোচনায় মঈনুদ্দীন খালেদ শিল্পীদের স্বতন্ত্রতা এবং কীভাবে তারা আধুনিক শিল্পের ইতিহাসে তাদের শিল্পকাহিনীকে বাংলাদেশি কিংবদন্তী হিসাবে দৃঢ় করেছিলেন তা বর্ণনা করেন।

জয়নুল আবেদীনকে দূরদর্শী শিল্পী হিসাবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, শিল্পাচার্য বাংলাদেশের সেরা শিল্পী হিসাবে তার উত্তরাধিকারকে সিলমেট করেছেন, যিনি ব্রিটিশ শাসনের অধিন ভারত কিংবা তাদের কলকাতা নয়, নদী-মার্তৃক বাংলাদেশে নিজেকে বস্তুগতভাবে ভারসাম্যযুক্ত করেছেন। তিনি তার কাল্পনিক অন্তর্নিহিত চোখের মধ্য দিয়ে বাংলার প্রকৃতি চিত্রিত করেছেন, যা বাইরের দর্শনের চেয়েও বেশি অন্বেষণ করেছিল।’,

উদাহরণের সাথে আরও ব্যাখ্যা করে খালেদ বলেন, ‘আমরা অনেকেই বৃহত্তর বাংলায় ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথা জানি যা ব্রিটিশ সরকারের জঘন্য কাজের কারণে ঘটেছিল। জয়নুলের শিল্পকর্মের কারণে আমরা সেই সময়ের ধ্বংসযজ্ঞের কথা জানি, যাতে পুরোপুরিভাবে চিত্রিত হয়েছিল তখনকার সামাজিক পরিস্থিতি।’

‘পটুয়া’ কামরুল হাসান নামে পরিচিত শিল্পী সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে খালেদ বলেন, ‘তার শিল্পকর্মের বেশিরভাগ চিত্রই প্রদর্শিত হয়নি বলে লোকেরা এখনও শিল্পীর সম্পর্কে কম বুঝতে পারেন। পিকাসো ছিলেন তার আইডল, তাই তার চিত্রকর্মগুলো পিকাসোর সাথে সাদৃশ্য রয়েছে এবং তার চিত্রকর্মগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি ছিল রূপকের ব্যবহার। যার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে ইয়াহিয়া খানের মতো স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।’

পেশীবহুল পেশাজীবী কৃষকদের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মের নিপীড়িত চিত্রের জন্য খ্যাত কিংবদন্তি শিল্পী এস এম সুলতান।

এই কিংবদন্তি শিল্পী প্রসঙ্গে খালেদ বলেন, ‘‘সুলতান সবসময়ই ‘আমি’ এর পরিবর্তে ‘আমরা’ ধারণার জন্যই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন…।তিনি সমস্ত মানুষের মিলনের চিত্রায়ন করতেন। তার চিত্রকর্মগুলোতে তিনি সমাজে লিঙ্গ এবং সামাজিক বাধা অতিক্রমের মাধ্যমে মানব প্রজাতিকে একত্রিত করেছেন।’’

আরেক চিত্রশিল্পী সাফিউদ্দিন আহমেদকে ‘স্টাইলাইজড আর্টের মাস্টার’ হিসাবে অভিহিত করে খালেদ তার লাইন অঙ্কনগুলোতে জ্যামিতিক রূপ ব্যবহার করার কৌশলটির প্রশংসা করেন।

সাফিউদ্দিন সম্পর্কে খালেদ বলেন, ‘তার চিত্রগুলো গ্রাফিককে সংশ্লেষিত করেছে… আমি প্রায়শই অনুভব করতাম যে তার চিত্রকর্মগুলোতে চিত্রিত গ্রাফিকাল মানের কারণে তার সাউন্ড সক্ষম হয়েছে।’

কসমস-আতেলিয়ার৭১ এর একিসিকিউটিভ আর্টিস্টিক ম্যাসেজার সৌরভ চৌধুরীর সঞ্চলনায় আলোচনায় আরও অংশ নেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ছোট ছেলে প্রকৌশলী মঈনুল আবেদীন এবং শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিক উল্লাহ খান।