ট্যাক্সিক্যাব সেবা বন্ধের উপক্রম

অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাস্তায় থাকা ট্যাক্সিক্যাব সেবা। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিগগির এ সেবাটি বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। যাত্রী অনাগ্রহের কারণে সিলেট মহানগরীতে ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস চালুর প্রস্তাব চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেও সাড়া পায়নি বিআরটিএ।

উন্নত যাত্রীসেবার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকায় প্রথম ট্যাক্সিক্যাব সেবা চালু হয় ২০০২ সালের শেষের দিকে। কালো ও হলুদ রঙের ১১ হাজার ২৬০টি ট্যক্সিক্যাব নামানো হয় তখন। পরবর্তীতে আরও ট্যাক্সিক্যাব নামানোর কথা থাকলেও নানা অব্যবস্থাপনা আর নৈরাজ্যের কারণে তা সম্ভব হয়নি। যাত্রীরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় পরবর্তীতে এই সেবাটি একপ্রকার হারিয়ে যায়। এরপর ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে বিলাসবহুল ট্যাক্সি সার্ভিস চালু করতে ‘তমা কনস্ট্রাকশন’ ও ‘ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসেস’ নামের দু’টি কোম্পানিকে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ট্যাক্সিক্যাব নামানোর অনুমতি দেয় সরকার। বর্তমানে রাজধানীতে তমা সার্ভিসের ২৫০টি এবং ট্রাস্টের ১৭৫টি ট্যাক্সি চলছে। ট্রাস্টের ১৭৫টি ট্যাক্সির মধ্যে প্রথমে ঢাকায় ১০০টি ও চট্টগ্রামে ৫০টি চালু করা হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় আরও ২৫টি এবং চট্টগ্রামের ৫০টি ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। প্রথম দিকে যাত্রীদের কিছুটা আগ্রহ থাকলেও এখন বাধ্য না হলে কেউ আর এ সেবা নেন না। ঢাকার রাস্তায় এসব ট্যাক্সিক্যাব দেখাও মেলে খুবই কম।

কেন এই পরিনতি? কারণ খুঁজতে কথা হয় একাধিক যাত্রী, বিআরটিএ’র কর্মকর্তা ও ট্যাক্সিক্যাব পরিচালনাকারীদের সঙ্গে। আলাপকালে বেশ কিছু কারণ জানা গেল। প্রথম কারণটি হলো- ভাড়ার পরিমান তুলনামূলক অনেক বেশি। এসব ট্যাক্সিক্যাবে প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ৮৫ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৩৪ টাকা, প্রতি দুই মিনিট অপেক্ষমাণ সময়ের (যানজট, যাত্রাবিরতি ও সংকেত) জন্য সাড়ে আট টাকা, ফোনে ট্যাক্সিক্যাব বুকিং দিলে বাড়তি ২০ টাকা হিসেবে ভাড়া আদায় করা হয়। যাত্রীদের কাছে এই ভাড়া অনেক বেশি। তারচেয়ে বেশি বিরক্তি হলো-ফোন করার পর চালক যে স্থানে থাকেন, সেখান থেকেই মিটার চালু করেন। এতে যাত্রী ওঠার আগেই মিটারে ১০০ টাকার ওপর ভাড়া উঠে যাচ্ছে। এ অবস্থায় যাত্রীরা ট্যাক্সিক্যাবে চড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এছাড়া বর্তমানে মোবাইল অ্যাপভিত্তিক বিভিন্ন পরিবহন সেবায় বেশি সুবিধা পাওয়ায় যাত্রীদের ঝোক সেদিকে। ফলে ট্যাক্সিক্যাবে আর আগের মত ভাড়া হচ্ছে না।

অপর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-পুলিশের অযথা হয়রানি, বিমানবন্দর এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, পার্কিংয়ের জায়গার অভাব, ঢাকার বাইরে যাওয়ার অনুমতি না থাকা ইত্যাদি।

সার্ভিসটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গেল বছরের এপ্রিলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠায় তমা ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস। চিঠিতে বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি ভাড়া বৃদ্ধির দাবিও জানানো হয়।

চিঠিতে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো- বিমানবন্দরে পার্কিং এবং প্রবেশে বাধা নিরসন, ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ট্যাক্সিক্যাব স্ট্যান্ডের ব্যবস্থা করা, ট্যাক্সিক্যাবের বিরুদ্ধে মামলার সুরাহা করা ইত্যাদি। এ ছাড়া বিশেষ ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরে যাত্রী পরিবহনের অনুমতি এবং অসময়ে সেবা প্রদানে অতিরিক্ত ভাড়ার সিদ্ধান্ত আদায়। অসময় বলতে রাত ১১টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ট্যাক্সিভাড়া সাধারণ সময়ের চেয়ে দেড়গুণ বেশি ভাড়া আদায়ের কথা বলা হয়।

চলতি বছরের শুরুর দিকে এবং এর আগেও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বিআরটিএ’কে বিভিন্ন সমস্যার কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েও কোনও লাভ হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।

তবে বিআরটিএ’র কর্মকর্তারা বলছেন, এমনিতেই যে ভাড়া আদায় করা হয় তা অস্বাভাবিক। আবার ভাড়া বৃদ্ধি করলে জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। ট্যাক্সিস্ট্যান্ড সমস্যার সমাধানে একাধিকবার স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমাধান হয়নি। একই সমস্যা মামলার ক্ষেত্রেও। অবৈধ পার্কিংয়ের দায়ে গাড়ি রেকারিং না করতেও অনুরোধ করা হয়েছে ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগকে। আর বিমানবন্দরে পার্কিং এবং প্রবেশে বাধার সমাধানে সিভিল এভিয়েশন অথরিটিকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। তবে ঢাকার বাইরে যাওয়ার অনুমতির বিষয়টি রুট পারমিটের বিষয়। এ ব্যাপারে আলোচনা সাপেক্ষে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ মহাসড়কে এসব ছোট গাড়ি চললে ঝুঁকিও থাকবে।

বিআরটিএ’র একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা তাদেরকে এই সেবা দেওয়ার জন্য অনুমতি দিয়েছি। যাত্রী তো আর এনে দিতে পারি না। এর দায় পুরোটায় তাদের। অন্যান্য যেসব প্রতিষ্টান যাত্রী সেবা দিচ্ছে তাদের সঙ্গে যদি প্রতিযোগিতায় না পারে, বেশি ভাড়া দিয়েও যদি কাঙ্খিত সেবা না পাওয়া যায় তাহলে যাত্রীরা তো মুখ ফিরিয়ে নেবেই। এখানে বিআরটিএ’র তো কিছুই করার নেই। তারা ব্যবসা করছে, সুতরাং কিভাবে সেবা দিলে তারা লাভবান হবেন সেই ‘পলিসি’ তাদেরকেই নিতে হবে।

এসব ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে যাত্রীদেরও রয়েছে নানা অভিযোগ। শুলশানের বাসিন্দা আতিয়ার রহমান বলছিলেন, ঢাকায় যতগুলো পরিবহন সেবা রয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাড়া এই ট্যাক্সিক্যাবে। সবচেয়ে অদ্ভুদ কান্ড হলো-ফোন করে ট্যাক্সি ডাকলে আমি গাড়িতে উঠার আগেই মিটারে এক দেড়শো টাকা উঠে বসে থাকে। আগে অনেকসময় বাধ্য হয়ে এতে উঠতাম। কিন্তু এখন অ্যাপভিত্তিক নানারকম সেবা চালুর পর এগুলোই ব্যবহার করা হয়।

‘সেবার মান ভাল করুক, ভাড়া কমিয়ে দিক তাহলে তো তারাও লাভজনকে থাকবে’-যোগ করেন আতিয়ার।

সোহেল মিয়া নামের একজন ট্যাক্সিচালক বলছিলেন, প্রথমদিকে অনেক বেশি ভাড়া পাওয়া যেত। বেতনের বাইরেও কমিশন দিত। কিন্তু এখন আর তা পাওয়া যায় খুবই কম। কোম্পানিরও আয়রোজগার আর আগের মতো নেই। বিশেষ করে উবার, পাঠাও এসব চালু হওয়ার পর অবস্থা আরও করুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তমা গ্রুপের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ভুঁইয়া বলেন, ‘নানা সমস্যার কারণে প্রতিমাসেই আমাদেরকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তারপরও সেবাটি চালু রেখেছি সমাধানের আশায়। মন্ত্রনালয় ও বিআরটিএর কর্মকর্তাদের এসব বিষয় একাধিকবার জানানো হয়েছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এভাবে চললে এর ভবিষ্যৎ ভাল হবে না।’

আজকের বাজার : এনএল/ এলকে/ ১০ জানুয়ারি ২০১৮