তেমন অগ্রাধিকার পায়নি প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি খাত

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে শাটডাউন চলাকালীন ক্ষতিগ্রস্থ বেসরকারি খাতের টেকসই পুনরুদ্ধারের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে তেমন অগ্রাধিকার দেয়া হয়নি।

তারা সরকারকে প্রণোদনা প্যাকেজগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন যাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোক্তারা বেঁচে থাকার জন্য তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেন।

বেকারদের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো সুসংবাদ নেই উল্লেখ করে, সরকারকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো বড় চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ইকোনোমিক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য (বিইএ) মতে, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ গত ২৬ মার্চ দেশব্যাপী শাটডাউনের প্রথম দিন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন।

সংস্থাটি জানায়, বর্তমানে দেশের চাকরির বাজারে কাজ করছেন প্রায় ৬ কোটি ১০ লাখ মানুষ। শাটডাউনের এ সময়ে প্রায় ৬ কোটি মানুষ বিভিন্ন শ্রেণি কাঠামোয় স্থানান্তরিত হয়েছে, যার মধ্যে অত্যন্ত দরিদ্র হয়ে পড়েছে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ।স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত করার পর গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জানায়, বাংলাদেশের মোট কর্মজীবী তরুণের ৮৯ শতাংশের কর্মসংস্থান হয় বেসরকারি খাতে। আর মহামারিজনিত কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যহত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ২ কোটিরও বেশি যুবক।

ইউএনবির সাথে আলাপকালে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট সহযোগী অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অবশ্যই বেসরকারি খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে অনেক বেসরকারি সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে তাদের কর্মচারীদের বেতন দিতে পারেননি। এমনকি, বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের শ্রমিকদেরকে ছাঁটাই করেছে। শাটডাউনের সময়ে বেসরকারি খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, শাটডাউনের প্রভাবে দেশে দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে ফিরে যেতে পারে। এর অর্থ, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করবে।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা এবং চলমান সংকট থেকে মানুষকে রক্ষা করতে সরকার এখন পর্যন্ত ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছ, যা জিডিপির ৩.৭ শতাংশ।

‘২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় উঠে আসলেও প্রয়োজন অনুযায়ী অগ্রাধিকার পায়নি বেসরকারি খাত। সরকার ক্ষুদ্র, কুটির এবং এসএমই শিল্পগুলোর জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার স্বল্প সুদের ঋণ ঘোষণা করলেও, এ খাতের চাহিদা অনুযায়ী তা যথেষ্ট নয়,’ যোগ করেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।

কর্মসংস্থান সংশ্লিষ্ট সমস্যা কমাতে সরকার পল্লী অর্থনীতি ও কৃষিতে জোর দেয়ার চেষ্টা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি ভালো তবে আমাদের এখন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। সরকার দেশের সাড়ে ৭ কোটিরও বেশি প্রান্তিক মানুষের প্রতিটি পরিবারের জন্য মাসিক নগদ ৮ হাজার ঠাকা বরাদ্দ করার কথা ভাবতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট একটি ‘দুর্বল কাঠামো’ নিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে কারণ বিদ্যমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যে বাজেটের এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত নয়।

গত ১১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল করোনাভাইরাস মহামারিজনিত কারণে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই ৮.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য রেখে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেন।

সামগ্রিক বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা।

বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে মোট ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি, বিলাসবহুল ব্যয়কে নিরুৎসাহিত করে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির সরকারি ব্যয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে চারটি মূল কৌশল নিয়ে একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা:-

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজেটে বেসরকারি খাতের জন্য সরাসরি কিছুই নেই। তবে এর আগে সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল।

তিনি বলেন, ‘প্যাকেজগুলোর যথাযথ প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি এখন সঠিকভাবে বিতরণ না করলে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাবে।’

ড. মনসুর বলেন, শাটডাউন চলাকালীন বেসরকারি খাত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। করোনাভাইরাস সংকট অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এর প্রভাব আরও বাড়বে।

তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে- সরকার স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা নেট এবং কৃষির উপর জোর দিয়েছে। বাজেট বাস্তবায়ন হবে সরকারের পক্ষে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সাফল্য মাঠ পর্যায়ের কাজের ওপর নির্ভর করবে।’

পরিবহণ ও যোগাযোগ খাত থেকে, গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখবে এমন খাতে তহবিল রূপান্তর করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ চেম্বার অফ ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ।

তিন বলেন, ‘জাতীয় বাজেটের প্রায় ১১.২ শতাংশ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে যা এই মুহুর্তে প্রয়োজনীয় নয়।’

আনোয়ারুল বলেন, বেকারত্ব দূরীকরণে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষি ও কুটির শিল্প ভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি সক্রিয় করার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা সবচেয়ে জরুরি। সূত্র-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান