দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ অবশ্যই পুঁজিবাজার থেকে হতে হবে

যেহেতু চায়না অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের অন্যতম অংশিদার হয়েছে সেহেতু আশা করা যায় আগামি দিনগুলোতে আমাদের পুঁজিবাজার ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করবে। পুঁজিবাজার হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির দর্পন। আমরা জানি, দেশের অর্থনীতি কতটা ভাল করছে বা খারাপ করছে তা নির্ভর করে তালিকাভুক্ত কোম্পানীগুলোর পারফর্মেন্সের উপর। পাশাপাশি আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সচেতন বিনিয়োগকারীই বাজার উন্নয়নের পূর্বশর্ত। বাজারের উন্নয়ন করতে হলে আমাদের বিনিয়োগকারীদেরকে সচেতন হতে হবে। পৃথিবীতে যতগুলো শেয়ারমার্কেট রয়েছে সেগুলোর সাথে তুলনা না করলেও আমরা বলতে পারি বাংলাদেশের শেয়ারমার্কেট এখনও খুব ছোট। এটির আরও বিস্তৃতি দরকার।

পুঁজিবাজারের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নির্ভর করে লেনদেন হওয়া সিকিউরিটজসমূহের প্রকৃত উপার্জনক্ষমতা-আর্নিং ক্যাপাসিটি বা এবিলিটি কতটুকু, নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহের সক্ষমতা, বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্পর্কে সম্মক ধারণা ও জ্ঞান এবং দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উপর। এই সবগুলি বিষয় যখন একত্রে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে যাবে তখন আমরা বলতে পারবো যে, দেশের পুঁজিবাজার এগিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে আমাদের শেয়ারবাজারে প্রায় ৩৫০ টি তালিকাভুক্ত কোম্পানী রয়েছে। এ সংখ্যা খুবই কম। এই সংখ্যা কমপক্ষে তিন থেকে সাঁড়ে তিন হাজার হওয়া উচিৎ। অন্যদিকে আমাদের সর্বমোট মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন হলো তিন লক্ষ ষাট হাজার কোটি থেকে তিন লক্ষ আশি হাজার কোটি টাকার মধ্যে। যদি এর নূন্যতম ১০% লেনদেনও হয় তাহলে লেনদেন আরও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু সেটি কি হচ্ছে? হচ্ছে না। এখানে একটি আস্থার সংকট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই আস্থা ও বিমুখতার কারণ হচ্ছে ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালের বিরূপ অভিজ্ঞতা এবং বিচারহীনতা। এই সময়ের যারা কুশিলব ছিল, তাদের যথার্থ বিচার হলে ভবিষ্যতে এই ঘটনার পূনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকবে, এটি একটি দিক। আরেকটি দিক হলো, বাজার বিমুখ বিনিয়োগকারী। লক্ষ করলে দেখবেন আমাদের বেশিরভাগ ছোট ছোট বিনিয়োগকারী। অথচ আমরা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর উপর বেশি পরিমানে নির্ভর করছি। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর মধ্যেও আবার আমরা ব্যাংক এবং অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করি। ব্যাংক এবং অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল কাজ পুঁজিবাজারে নয়। তাদের কাজ দেশের মানি মার্কেটে। তারা মানি মার্কেটের প্লেয়ার, মানি মার্কেটে কাজ করবে। কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তারা এখন পুঁজিবাজারে বড় ধরনের অংশগ্রহণ করছে বা করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে যদি সেক্টর অনুযায়ী ভাগ করে নেয়া যায়, কারা পুঁজিবাজারে আসবে, কোন কোন প্রজেক্ট পুঁজিবাজারে আসবে, কারা ব্যাংকে কাজ করবে, কারা এনবিএফআই-এ আসবে তাহলে ভাল হয়।

পুঁজিবাজার শুধুমাত্র দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান্য দেওয়া উচিৎ। যেমন ধরুন পদ্মা সেতুর মত বড় প্রকল্প, মেট্রো রেল, মনো রেলের মত প্রকল্প, পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মত বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যেগুলো দীর্ঘ মেয়াদী, সেগুলোর অর্থায়ন অবশ্যই পুঁজিবাজার থেকে হতে হবে। এখন কি হয়, আমাদের ব্যাংকগুলো আমরা আট বছর দশ বছর পযন্ত বিনিয়োগ করে ফেলি। করা হয়, এই জন্য যে, অল্টারনেটিভ সোর্স নেই, উদ্যোক্তারা আসছে, ব্যাংকগুলোও মনে করে লাভ হবে। এটি কিন্তু ব্যাংকের কাজ নয়। ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগ করবে, ছোট ছোট ওয়ার্কিং ক্যাপিটালে বিনিয়োগ করবে। আর এনবিএফআই বা অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান মধ্যমেয়াদী বিনিয়োগ করবে, ছোট প্রজেক্টগুলোতে বিনিয়োগ করবে। আর সকল বড় প্রকল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করবে ক্যাপিটাল মার্কেট, এটাই স্বাভাবিক। এভাবে আলাদা আলাদা কর্মপদ্ধতি চিহ্নিত করে, যার যার সেক্টর ভাগ করে দিলে স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাজার চাঙ্গাঁ হয়ে যাবে।

যদিও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এখন কম্পিউটারাইজড এবং এখানে ইলেকট্রনিক্স পদ্ধতিতে শেয়ার হস্তান্তর হয়। এটিকে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে হস্তান্তরের একটি প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে চলছে। এটি নিশ্চিত করতে হবে। ইনফরমেশন টেকনোলজিকে (আইটি) আরও সংযুক্ত ও সুদৃঢ় করতে হবে এবং শেয়ারমার্কেট সম্পর্কিত তথ্য বা ডিসক্লোজার বিনিয়োগকারীদের মাঝে দ্রুতগতিতে কম সময়ের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে। ডিসক্লোজার পৌছাতে যদি বেশি সময় লেগে যায় তাহলে, এই বেশি সময় লাগার সুযোগটাকে কেউ কেউ অন্যভাবে কাজে লাগায়। এই সুযোগটাকে বন্ধ করতে হলে আইটি বিভাগকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে। দেশের স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকে আরও বড় জায়গায় স্থানান্তরিত করতে হবে, যেখানে একসাথে বেশি সংখ্যক মানুষের অবস্থান করার সুযোগ থাকবে, স্ক্রীনগুলো আরও বড় করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সার্ভিল্যান্স টিমকে আরও ব্যাপকভাবে মাঠে নামাতে হবে, তাদের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। দুই দিন বা তিন দিনের পরিবর্তে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। যার ফলে আমাদের পক্ষে বুঝতে সহজ হবে যে কিভাবে একটি জেড ক্যাটাগরির শেয়ার রাতারাতি দশগুন, বিশগুন বা ত্রিশগুন হয়ে যাচ্ছে। তখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ, যখন ত্রিশগুন হয়ে গেল তখন নিলে তো দেরি হয়ে গেল। এগুলো নিশ্চিত করার জন্য আমাদেরকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে আরও নজর দিতে হবে। আমি বিশ্বাস করি যে, চীনা কোম্পানী যারা পুঁজিবাজারের অংশিদার হয়েছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই শেয়ারমার্কেটের উন্নয়নে যথাপোযুক্ত ভুমিকা পালন করবে। তখন শেয়ারমার্কেট আরও বেশি বিস্তৃত হবে এবং বিনিয়োগকারীরা মার্কেটে আসতে আরও বেশি আগ্রহী হবে।

মানি মার্কেট এবং ক্যাপিটাল মার্কেট দুটিই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। বিশ্বাস একবার চলে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে এটি ফিরে আসতে সময় লাগে। এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হলে এই সেক্টরে পরিবর্তন আনতে হবে এবং পরিবর্তনগুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে দৃশ্যমান হতে হবে।

দেশের বেশিরভাগ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী উচ্চ শিক্ষিত নয়। তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা স্বল্প আকরে যদিও আছে, এটাকে আরও ব্যাপকভাবে করা দরকার। শুধুমাত্র ঢাকা বা চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক নয়, এসকল ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য বিস্তৃত আকারে জেলাশহরকেন্দ্রিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে তাদেরকে বিশ্ব পুঁজিবাজারের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। যার মাধ্যমে তারা আরও বেশি সচেতন হবে। একসময় বিশ্বের পুঁবাজারের সাথে আমাদের খুব একটা সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এখন অনেক সম্পর্ক রয়েছে। এজন্য বিশ্ববাজারের সাথে বিনিয়োগকারীদের একটা সমন্বয় দরকার। এক্ষেত্রে ইনফরমেশন টেকনোলজির একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কারণ আজকে আমরা বিশ্বের সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরেছি ইন্টারনেটের মাধ্যমে।

আমাদের অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকতে হবে। আমাদের পুঁজিবাজারের কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আছে বলে আমার জানা নেই। আমরা আগামী দশ বা পনের বছর পর কোথায় যাব, তার একটি পরিকল্পনা থাকা উচিৎ। কারণ পুঁজিবাজার হচ্ছে একটি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জায়গা। এখানে আজ বিনিয়োগ করে কালকেই রিটার্ন পাওয়ার আশা করা ঠিক নয়।

আমাদের পুঁজিবাজার পুরোপুরি ইকুইটি ভিত্তিক। এখানে অধিকাংশই শেয়ার। হাতে গোনা কিছু ডিবেঞ্চার রয়েছে। আর বন্ড নাই বললেই চলে। ডিবেঞ্চার, বন্ড এবং মিউচুয়াল ফান্ড থাকলে মার্কেট বৈচিত্রপূর্ণ হবে। মার্কেট বৈচিত্রপূর্ণ হলে বিনিয়োগকারীর সুবিধা হবে। তাছাড়া, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আসার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের বড় বড় গ্রপের ভাল ভাল কোম্পানিও বাজারে আসতে চায় না। কোথাও না কোথাও সমস্যা আছে, সেটা খুজে বের করতে হবে এবং এসব কোম্পানিকে বাজারে আনতে হবে। আরও বেশি বেশি আইপিও আসা উচিৎ। এক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয়-তা হলো, আমাদের বাজারে অনেক কোম্পানি এসে তিন চার বছরের মধ্যেই ডিভিডেন্ট দিতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং জেড ক্যাটাগরিতে চলে যাচ্ছে। তাহলে আমরা আইপিওতে আসার আগে তার প্রজেকশনে কী দেখেছিলাম? যদিও আমাদের অডিটররা বলে থাকেন, তারাতো কোম্পানির প্রজেকশন করেন না, প্রজেকশন করে কোম্পানির লোকেরা। সেক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনে কোম্পানির প্রজেকশন বুঝার মত এক্সপার্ট থাকতে হবে। তাহলে ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনা সম্ভব হবে। অতি স¤প্রতি আমরা দেখেছি, বাজার থেকে টাকা তুলে কোম্পানি অন্যখাতে ব্যয় করে। এটা হতে দেয়া ঠিক নয়। জনগনের টাকার একটা জবাবদিহিতা থাকতে হবে।

আমদের দেশের বিনিয়োগারীরা কিন্তু উদ্বৃত্ত অর্থ নিয়ে বাজারে আসে না। দৈনিন্দন প্রয়োজন মেটানোর টাকাটা নিয়ে তারা পুঁজিবাজারে আসে। ভাবটা এমন যে, এখান থেকে লাভ করতে পারলে একটা গাড়ি কিনবে। আরেকটু লাভ করতে পারলে বাড়ি কিনবে। আরেকটু ভালো করতে পারলে ছেলেটাকে বিদেশ পাঠাবে। এটা কিন্তু পুঁজিবাজারের রিটার্ন থেকে আসা করা উচিৎ নয়। অথচ আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা করছে, কারণ তাদের বেশিরভাগই দরিদ্র এবং ছোট বিনিয়োগকারী, তাই তারা এই আশা নিয়ে আসছে। শুধু তা-ই নয়, একটা সময় কিন্তু অনেকে ঘরবাড়ি বিক্রি করেও বাজারে বিনিয়োগ করেছে, বিগত ধশের সময়। তারা মনে করেছে আজ কিনবো কদিন পরে তা বেড়ে দুগুন তিনগুন হয়ে যাবে। এটা অস্বাভাবিক। বিশ্বের কোথাও এমনটা হয় না। এটা হবার নয়। আমরা যদি ১৯৯৬ এবং ২০১০ সাল থেকে শিক্ষা নিই, তাহলে ভবিষ্যতে যাতে এর পূনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে আমাদের তিক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। আরও একবার যদি বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারিয়ে যায়, আস্থা হারিয়ে ফেলে তাহলে যত বিদেশি আসুক আর যাই আসুক, সহজে কিন্তু বিনিয়োগকারীকে আর বাজারে আনা যাবে না। আর ছোট ছোট বিনিয়োগকারী ছাড়া কেবল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী দিয়ে কিন্তু শেয়ার বাজার চলে না।

আমাদের দেশের যারা অবসর নেয়া মানুষ আছেন, তারা তাদের জীবনের শেষ সম্বলটা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনেন। কেননা ওখান থেকে যা আসে সেটা দিয়ে তারা তার নিত্য দিনের খরচ মেটান। দেখেন আমাদের সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো নিয়ে একটা বেকায়দা অবস্থায় আছে। ব্যাংক রেট কমিয়েছে, এনবিএফআইয়ের রেট কমিয়েছে, কিন্তু সঞ্চয়পত্রের রেট কমাতে পারছে না। একটা মানবিক কারণে। অথচ ওইসব অবসর নেয়া মানুষগুলোর জন্য কিন্তু পুঁজিবাজার, সঞ্চয়পত্র নয়। অথচ তারা তা করছে না। কেউ তার সারা জীবনের অর্জিত সঞ্চয় কখন এখানে বিনিয়োগ করবে? যখন দেখবে এখানে বিনিয়োগ করলে প্রতারিত হবে না, লস হলেও রিজিনেবল লস হবে। এমন একটা আস্থাশীল শেয়ারবাজার হবে সেই চেষ্টা আমাদের সবার করা উচিৎ।

আবু জাফর মো. সালেহ
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকতা,
ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড