দেশে বাণিজ্যিক গাড়ির বাজার বাড়ছে

বাংলাদেশের অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি মূলত রিকন্ডিশন এবং নতুন যানবাহন আমদানি দ্বারা প্রভাবিত। এসব গাড়ি আসে জাপান, চীন, ভারত, ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে। ৯০ এর দশকে আমদানিকারকের তালিকায় জাপানের আধিপত্য ছিল। কিন্তু এখন তা ভারতের দখলে। ভারতীয় বাণিজ্যিক যানবাহন নির্মাতারা তুলনামূলক কম দাম, জ্বালানি দক্ষতা এবং খুচরা যন্ত্রাংশের প্রাপ্যতার কারণে এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় টাটা, আয়সার, অশোক লেল্যান্ড এবং মাহিন্দ্রা এই বিভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছে। উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত কাঁচা মাল এবং যথাযথ যোগাযোগের অভাবে বাংলাদেশে গত তিন দশকে অটোমোবাইল উৎপাদন ও এসেম্বলিং শিল্পের তেমন একটা প্রসার ঘটেনি। কিন্তু বর্তমান চিত্র ভিন্ন।

বাড়ছে বাজার: দেশে গত এক দশকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বিকাশ ও চলমান পরিবহন কার্যক্রমগুলি বাণিজ্যিক যানবাহনগুলির জন্য একটি সম্ভাব্য বাজার তৈরি করেছে। আর বাংলাদেশে বাণিজ্যিক যানবাহন বিক্রি বেড়ে চলেছে ২০১৪ সাল থেকে। বর্তমানে, বাণিজ্যিক গাড়ির বাজার প্রায় ৪,২০০ কোটি টাকা, অথচ এটি এক দশক আগেও প্রায় ২০০০ কোটি টাকা ছিল। এভাবেই বাজারের চাহিদা ও প্রপ্তির ঘাটতি মিটিয়ে চলতে থাকলে শীঘ্রই ৫০০০ কোটিতে পৌছাবে বাণিজ্যিক গাড়ির বাজার।
গেল বছর অন্তত ৩৫,০০০ ইউনিট বাস, ট্রাক, অটো-রিক্সা, কারগো ভ্যান, পিক-আপ ও ট্যাঙ্কার বিক্রি হয়েছে, যেখানে ১০ বছর আগেও এই পরিমার ছিল ২০০০ ইউনিট।
এছাড়া গত দশকে বাণিজ্যিক যানবাহনগুলির বাজারের আকার প্রতি বছর বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫% থেকে ২০%।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাণিজ্যিক যানবাহনগুলোর বিক্রি বছরে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে বেড়েছে এবং ২০১৮ সালে এই বিক্রি বেড়ে দাড়ায় ২৫, ৯৮০ ইউনিট। আর এদের মধ্যে ট্রাকের বিক্রয় হার সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর ১২,৬৬৩ ইউনিট ট্রাক বিক্রি হয়েছিল, ২০১৭ সালে ছিল ১০,৩৬৩ ইউনিট। অর্থাৎ বিক্রি বেড়েছে ২২.৩১ শতাংশ। লরির বিক্রিও বেড়েছে ১০.৬৮ শতাংশ। গেল বছর ৫,৭২৯ ইউনিট বিক্রি হয়, যেখানে ২০১৭ সালে ৫ ১৭৬ ইউনিট। ট্র্যাক্টরের বিক্রি বেড়েছে ২৮ শতাংশ। গতবছর বিক্রি হয় ৩,৫৫৩ ইউনিট সেখানে ১০১৭ সালে ২৭৭৭ ইউনিট বিক্রি হয়েছিল। তবে বাস বিক্রি হ্রাস পেয়েছে ২৬.৭২ শতাংশ। ২০১৮ সালে মোট বিক্রি হয় ২৭৫৫ ইউনিট যেখনে ২০১৭ সালে ছিল ৩৭৬০ ইউনিট। কারগো ভ্যানের বিক্রিও কমেছে ৯.৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে বিক্রি হয় ১,২৮০ ইউনিট, আর ২০১৭ সালে বিক্রি হয় ১৪১৩ ইউনিট।

ক্রমবর্ধমান চাহিদাটি বর্তমান গতিতে আগামী ১০ বছরে আরও বাড়তে থাকবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশি উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী: বাংলাদেশে এখন ১৪ থেকে ১৫ টি বড় অটোমোবাইল খুচরা বিক্রেতা রয়েছে। তাদের মধ্যে পাচ ছয়টি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে এসেম্বল সুবিধা। বাকিরা শুধুমাত্র পরিবেশক বা আমদানিকারক। বাংলাদেশে অটোমোবাইলের প্রধান প্রধান পরিবেশক হলো ইফাদ অটোস, আফতাব অটো, নাভানা, র‌্যাংকস, রনকন মটরস, নিটোল মোটর, রানার মোটর এজি অটোমোবাইল। স¤প্রতি এ ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে এসিআই মোটরস। একটা বেসরকারি অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পর্যালোচনা অনুযায়ী বাণিজ্যিক গাড়ির সেক্টরে নিটল ৪০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার, ইফাদ অটোজ ৩৮ শতাংশ এবং রানার মোটর ১০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে আছে। এদিকে রানার মোটর, নিটল টাটা, ইফাদ অটোস এবং র‌্যাংকস ছোট আকারের এসেম্বল প্লান্ট স্থাপন করেছে। বিদেশী কোম্পানির হীনো, মিত্সুবিশি, টাটা মোটরস এবং অশোক লেল্যান্ডের সহযোগিতায় ট্রাক, পিকআপ এবং বাস এসেম্বল শুরু করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রানার অটোমোবাইল এবছর নিজস্ব কারখানাতে বাণিজ্যিক যানবাহন এসেম্বল শুরু করবে। ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা কারখানাটিতে ট্রাক এসেম্বল করা হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে লাইট কমার্শিয়াল ভেহিকেলে ৩০ শতাংশ বাজার দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ইফাদ অটোস।
সম্প্রতি এ ব্যবসায় যোগ দিয়েছে এসিআই মটরস। চায়নার বিখ্যাত ফোটন ব্র্যান্ডের বাণিজ্যিক গাড়ি বাংলাদেশের বাজারে এনেছে এসিআই। এসিআই মটরস্-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, আগামী দুই তিন বছরের মধ্যে বাণিজ্যিক গাড়ি উৎপাদনের প্লান্ট স্থাপন করবে এসিআই।

আশার কথা: এখাত সংশ্লিষ্ট ও উদ্যোক্তাদের মতে, অর্থনীতির গতি বাড়ছে বলে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক যানবাহনের জন্য একটি সম্ভাব্য বাজার তৈরি হয়েছে। বাণিজ্যিক যানবাহনগুলির চাহিদা দিন দিন বাড়বে কারণ, পণ্য পরিবহন ও মানুষের গতিবিধির জন্য যানবাহন দরকার। তাদের মতে, যখনই রাস্তাঘাট ও নতুন সংযোগ হবে তখনই গাড়ির চাহিদা বাড়বে। শহরকেন্দ্রিক যোগাযোগে ছোট গাড়ি আর দূরপাল্লার ক্ষেত্রে বড় গাড়ির প্রয়োজন। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগে চাহিদা আরো বাড়বে। বাড়বে গাড়ির চাহিদাও। বাংলাদেশে সড়ক ও বড় বড় সেতুর মতো অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর যোগাযোগ আরো বেড়ে যাবে। ফলে সামনের দিনগুলোয় বাংলাদেশে বাণিজ্যিক যানের বাজার আরো বেশি হারে বৃদ্ধি পাবে।

এখাত সংশ্লিষ্টদের মতে, এ খাতকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। এই শিল্পের উন্নয়নে যেমন অনেক মূলধন প্রয়োজন তেমনি সরকারের নীতিমালাও প্রয়োজন।

চীনসহ সারা বিশ্বেই সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিকের সংকট ও শ্রমিক ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। এ কারণে আগামী দিনগুলোয় বিশ্বের বড় বড় যানবাহন উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর নজর থাকবে বাংলাদেশের দিকে। বাণিজ্যিক যান উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমিক সংকটও রয়েছে। এখাতে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে কিছু উদ্দোগ নিয়ে শ্রমিকদের আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হলে দক্ষ শ্রমিক গড়ে উঠবে। তখন এখাতেও বিশ্বে মাথা উচু করে দাড়াতে পারবে বাংলাদেশ।