নতুন ভ্যাট আইনে পণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নেই:এনবিআর

নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও এ আইন নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সম্প্রতি নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতি এনবিআরের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এর ফলে আজ বৃহস্পতিবার এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ এ মু’মেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। এতে বলা হয়, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন ভ্যাট আইনের কিছু বিধান নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এ বিষয়ে এনবিআর গাণিতিক প্রমাণ দিয়েছে।

সৈয়দ এ মু’মেন বলেন, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে মূলত উল্লেখ করা হয়েছে যে, নতুন ভ্যাট আইনে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। যেসব ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধি পাবে সেগুলো হলো দেশি ব্র্যান্ডের কাপড়চোপড়, ভোজ্যতেল, চিনি, সুপার শপে বিক্রি, নির্মাণসামগ্রীর রড, বিদ্যুৎ, সোনার গয়না ইত্যাদি। বর্তমান ভ্যাট আইনেও অধিকাংশ আইটেমের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে। শুধুমাত্র ১৫টি সেবার ক্ষেত্রে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপিত আছে ১.৫% থেকে ১০% এর মধ্যে। কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে প্রকৃত বিক্রয়মূল্যের চেয়ে কম মূল্যের ওপর ভ্যাট পরিশোধ করতে হয় যা ট্যারিফ মূল্য নামে পরিচিত। বর্তমানে যেসব সেবার ক্ষেত্রে হ্রাসকৃত ভ্যাটের হার প্রযোজ্য রয়েছে এবং যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ট্যারিফ মূল্যের ভিত্তিতে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয় সেসব ক্ষেত্রে উপকরণ কর রেয়াত পাওয়া যায় না। বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান ১৫% ভ্যাট প্রদান করে এবং উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণ করে তাদের নিজ স্তরে ভ্যাট প্রদানের পরিমাণ ২ বা ৩ শতাংশের বেশি নয়। তাই, বর্তমানে যেসব ক্ষেত্রে হ্রাসকৃত মূল্য বা ট্যারিফ মূল্য রয়েছে, নতুন ভ্যাট ব্যবস্থায় সেসব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করে উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণ করা হলে ওই স্তরে ভ্যাটের প্রকৃত ভার ২ বা ৩ শতাংশের বেশি হবে না বিধায় মূল্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশংকা নেই। নানা কারণে মূল্য বৃদ্ধি ঘটে থাকে। মফস্বল থেকে শাক-সব্জি ঢাকায় পৌঁছাতে দুই-তিন গুণ মূল্য বেড়ে যায়। সেখানে ভ্যাটের কোনো প্রভাব নেই।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঠিকভাবে হিসাবপত্র রেখে উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণ করলে অনেক ক্ষেত্রে মূল্য কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঠিকভাবে হিসাবপত্র সংরক্ষণ করে উপকরণ কর রেয়াত নিয়ে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রদান করলে কোনো ক্ষেত্রে মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে; কোনো ক্ষেত্রে মূল্য অপরিবর্তিত থাকবে; আবার কোনো ক্ষেত্রে মূল্য হ্রাস পেতে পারে। যেসব ক্ষেত্রে বেশি উপকরণ কর রেয়াত পাওয়া যাবে, সেসব ক্ষেত্রে মূল্য হ্রাস পাবে।

এ মর্মে প্রচার করা হচ্ছে যে, অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা হিসাবপত্র রেখে রেয়াত নিতে অসমর্থ। একথা মোটেও ঠিক নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল উদ্দেশ্য হলো মূনাফা অর্জন করা। অতি ক্ষুদ্র, ক্ষ্রুদ, মাঝারি, বৃহৎ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই মুনাফার উদ্দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে থাকে এবং তাই নিজস্ব পদ্ধতিতে হলেও তাদের সকলের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখতে হয়। ভ্যাট ব্যবস্থায় কয়েকটি ফরম্যাটের মাধ্যমে এই হিসাবপত্র রাখতে হয় মাত্র, যা খুব সহজ। তাছাড়া, বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার এই যুগে সফটওয়্যার ব্যবহার করে হিসাবপত্র রাখা যায় যা আরো সহজ। নতুন ভ্যাট আইনে বার্ষিক ৩০ লক্ষ টাকা বিক্রয়কারী সব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটমুক্ত রাখা হয়েছে। তাই, নতুন ভ্যাট ব্যবস্থায় ছোটো ছোটো প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট সংক্রান্ত হিসাবপত্র রাখতে হবে না।

ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়, আমাদের আশে-পাশের কয়েকটি দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় ভ্যাটের হার ১০%, মালয়েশিয়া ৬%, নেপাল ১৩%, পাকিস্তান ১৭%, ফিলিপাইনস ১২% ও ১৮%, সিংগাপুর ৭%, শ্রীলংকা ১৫%, থাইল্যান্ড ৭%, ভিয়েতনাম ১০% ও মিয়ানমার ১০%।

ভারতে আগামী ১ জুলাই থেকে গুডস এন্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (জিএসটি) কার্যকর হতে যাচ্ছে। সেখানে চারটি করহার রয়েছে। সেখানে সাধারণ ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে রেয়াত গ্রহণ ছাড়া জিএসটি এর হার ৫%। অন্যদিকে, এধরনের খাদ্য সামগ্রীকে আমাদের দেশে আমরা ভ্যাটমুক্ত রেখেছি। ভারতের অন্য তিনটি হার হলো প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের ক্ষেত্রে ১২%, সাবান, টুথপেস্ট, রেফ্রিজারেটর, স্মার্টফোন ইত্যাদি ১৮% এবং গাড়ি, পান মসল্লা, পানীয় ইত্যাদি ২৮%।

কয়েকটি উন্নত দেশের ভ্যাটের হার ব্যাখ্যায় বলা হয়, যুক্তরাজ্য ২০%, সুইডেন ২৫%, স্পেন ২১%, পর্তুগাল ২৩%, পোল্যান্ড ২৩%, নরওয়ে ২৫% ও নিউজিল্যান্ড ১৫%। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ১৬০টি দেশে ভ্যাট ব্যবস্থা চালু আছে। সর্বনিম্ন ভ্যাটের হার আছে ৫%, সর্বোচ্চ ২৭%। পৃথিবীতে ভ্যাটের গড় হার হলো ১৬.৫%। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ ভ্যাট ফাঁকি হয়ে যায়। সব ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় এনে সন্তোষজনক পরিমাণ ভ্যাট আহরণ করা গেলেই ভ্যাটের হার নিয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা সম্ভব হবে। এজন্য প্রয়োজন সংস্কার, অটোমেশন এবং পরিপালন নিশ্চিতকরণ। সাপ্লাই চেইনের সকল স্তরে অর্থাৎ আমদানি থেকে শুরু করে উৎপাদন, পাইকারী, খুচরা সর্বত্র ভ্যাট প্রয়োগ তাই এখন সময়ের দাবি।

প্যাকেজ ভ্যাট নিয়ে বলা হয়, প্যাকেজ ভ্যাট কোনো ভ্যাট নয়। এটি একটি থোক কর। নতুন ভ্যাট আইনে ভ্যাটদাতাদেরকে প্যাকেজ ভ্যাটের তুলনায় অনেক বেশি সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রি সর্বোচ্চ ৭-৮ লাখ টাকা, শুধুমাত্র এ ধরনের প্রতিষ্ঠান প্যাকেজ ভ্যাট প্রদান করতে পারে। নতুন ভ্যাট আইনে বার্ষিক ৩০ লাখ টাকা বিক্রি হয় এমন সব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান প্যাকেজ ভ্যাট প্রদান করে নতুন ভ্যাট আইনে তার তুলনায় অনেক বড় প্রতিষ্ঠানকেও কোনো ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে না।

ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়, সরকারের রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করতে হলে সংস্কারের বিকল্প নেই। সরকারের রাজস্ব আহরণের মূল ‍উৎস কাস্টমস, আয়কর এবং ভ্যাট সব ক্ষেত্রেই সংস্কার চলছে। চলমান সংস্কারের দুটি মূল দিক হলো অটোমেশন এবং আইন সংস্কার। অটোমেশনের মাধ্যমে সব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের নেটওয়ার্কে নিয়ে আসতে পারলে ভ্যাটের ভার বিভিন্ন স্তরে বণ্টিত হবে। সবাই অল্প ভ্যাট দেবে; তবে, সবশেষে সরকার ভ্যাট পাবে অনেক বেশি। যা হবে জনগণের জন্য সহনীয় এবং সরকারের জন্য সুবিধাজনক।

আজকের বাজার:এলকে/ এলকে/৪ মে,২০১৭