নাটোরে সহজলভ্য সজিনা

পুষ্টি ও ওষুধী গুণাগুণের কারণে অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ হিসেবে পরিচিত সজিনার আবাদ বেড়েছে নাটোরে। অনাবাদি ও পতিত জায়গাতে বেড়েছে সজিনা গাছের সংখ্যা। সাম্প্রতিক সময়ে ঝড়-বৃষ্টি না থাকার কারণে এখন গাছে গাছে সজিনার প্রাচুর্য। তাই এবার সজিনার ফলন বাড়বে। বাজারে এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে সজিনা। হাট-বাজারে গড় মূল্য ৫০ টাকা প্রতি কেজি।

চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, সজিনার পুষ্টিগুন ব্যতিক্রমধর্মী। সজিনা পাতায় ৩৮ রকম অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিডসহ ৩৮ শতাংশ আমিষ রয়েছে। সজিনার পাতা পুষ্টিগুনের আঁধার। পরিমাণের ভিত্তিতে তুলনা করলে একই ওজনের সজিনা পাতায় কমলা লেবুর সাতগুণ ভিটামিন সি, দুধের চারগুণ ক্যালসিয়াম এবং দুইগুণ আমিষ, গাজরের চারগুণ ভিটামিন ‘এ’, কলার তিনগুণ পটাসিয়াম, পালংশাকের তিনগুণ লৌহ বিদ্যমান। পুষ্টি ও ওষুধী গুন বিবেচনায় এ গাছকে অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ বলা হয়। বাড়ির আঙ্গিনায় এটি একটি মাল্টিভিটামিন বৃক্ষ।

ডাঃ মোঃ সাইফুল ইসলাম আরো জানান, ভারতীয় আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্র মতে সজিনা গাছ ৩০০ রকমের রোগ প্রতিরোধ করে এবং আধুনিক বিজ্ঞানও এ ধারণাকে সমর্থন করে। সজিনার কচি ডগা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সজিনার বাকল, শিকড়, ফুল, ফল, পাতা, বীজ এমনকি এর আঠাতেও ওষুধী গুন আছে। সজিনা বাতজ্বর চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। পোকার কামড়ে এন্টিসেপটিক হিসেবে সজিনা পাতার রস ব্যবহার হয়। মাথা ব্যথায় সজিনার কচিপাতা কপালের দুই পাশে ঘষলে ব্যথা উপশম হয়। সজিনা গ্যাস্টিক রোগের বায়ুনাশক হিসেবে কাজ করে। পাতার রস হৃদরোগ চিকিৎসায় এবং রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যবহার হয়। শ্বেতীরোগ, টাইফয়েড জ্বর, প্যারালাইসিস এবং লিভারের রোগে সজিনার রস উপকার। ক্ষতস্থান নিরাময়ের জন্য সজিনা পাতার পেষ্ট কার্যকরি। খাদ্যাভাসে সজিনা গাছের পাতা বা সজিনা থাকলে চোখের ছানি পড়া রোগ কম হয়। সজিনা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। শ্বাসকষ্ট, মাথাধরা এবং মাইগ্রেন চিকিৎসায় সজিনা ভালো কাজ করে। ভারত, চীনসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে সজিনা পাতার পাউডার দিয়ে তৈরি ক্যাপসুল বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হচ্ছে। আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ পীড়িত অনাহার ও অপুষ্টি শিকার মৃতপ্রায় রোগাক্রান্ত শিশুদের দ্রুত আরোগ্যের জন্য সজিনার পাতা ও পাতার গোড়া খাওয়ানোর কর্মসূচি চলমান রয়েছে।

সজিনার ফলন শেষ হলে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গাছ থেকে ডাল সংগ্রহ করে কার্টিং রোপণ করা হয়। বসতবাড়ি, রাস্তার ধারসহ যে কোন স্থানের মাটিতে তিন মিটার দূরত্বে কার্টিং রোপণ করা যায়। ৪০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ডাল কাটলে ও একইভাবে রোপণ করলে শেঁকড় গজানো ও ঝড়ের প্রভাবমুক্ত থাকা সম্ভব বলে কৃষিবিদদের ধারণা। রোপণকালে গোবর সার এবং দ্রুত শিকড় গজানোর জন্য সামান্য ফরফরাস সার ও ছাই ব্যবহার করা উত্তম। আর গাছের উচ্চতা এক মিটার হলে ডগা কেটে এর আকৃতি ঝোপালো করা হলে ফলন বৃদ্ধি পায় এবং সজিনা সংগ্রহে সুবিধা হয় বলে জানান নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ মেহেদুল ইসলাম।

নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ২২০ হেক্টর আবাদি এলাকা থেকে প্রায় চার হাজার টন সজিনা উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির ফলে সজিনার আবাদ বাড়ছে। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে বিগত বছরের চেয়ে ফলন অনেকটা বাড়বে।

বসতবাড়ি ছাড়াও রাস্তার দু’ধারে সজিনার গাছ চোখে পড়ে। নাটোর সদর উপজেলার বড়হরিশপুর ইউনিয়নের দত্তপাড়া, ফতেঙ্গাপাড়া এলাকায় সজিনা গাছের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। শহরতলীর বলারিপাড়া, হাজরা নাটোর এলাকার রাস্তার দু’ধারে শোভিত অর্ধ শত গাছ নজর কাড়ে। শহরের ঝাউতলা সড়কেও এখন গাছে গাছে সজিনা।

সাম্প্রতিক সময়ে ঝড় ও বৃষ্টি না থাকায় সজিনা ফুলের কোন ক্ষতি হয়নি বলে এবার ফলন ভালো হবে বলে জানালেন সিংড়া উপজেলার বড়সাঁঐল গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম। এ কৃষকের বাড়ির আঙিনায় শোভা বর্ধন করছে চারটি সজিনার গাছ। তিনি এবার বাড়িতে খেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনদের বিতরণ করার পরও কিছু সজিনা বিক্রি করছেন।

নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মেহেদুল ইসলাম জানান, গাছে গাছে এখন সজিনার প্রাচুর্য। ঝড়-বৃষ্টিমুক্ত আবহাওয়া থাকায় এবার ফলন হবে আশাতীত। একটি গাছ থেকে দুই মণ সজিনা সংগ্রহ করা সম্ভব। সজিনার আবাদ বাড়াতে নতুন কার্টিং রোপণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে ব্লক কর্মকর্তাবৃন্দ প্রতি বছরের মত এবারও ভূমিকা রাখবেন বলে জানান এ কর্মকর্তা। বাণিজ্যিকভাবে বারোমাসী সজিনা চাষে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন নাটোর সদর উপজেলার তেবাড়িয়া এলাকার কৃষক মোঃ খোকন এবং নলডাঙ্গা উপজেলার রামশার কাজীপুর এলাকার কৃষক জহুরুল ইসলাম।

নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক মাহমুদুল ফারুক বলেন, নাটোরে অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ সজিনার আবাদ ও উৎপাদন ক্রমশঃ বাড়ছে। সজিনা চাষ বৃদ্ধি পাওয়াতে বাজারে বিক্রির মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক সংগতিও বেড়েছে। সজিনার সকল উপাদান অর্থাৎ সজিনাসহ এর ফুল ও পাতার যথাযথ এবং বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে সুফল প্রাপ্তির পরিধি আরো বাড়বে। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান