সফলতার জন্য ব্যবসায় সততা অপরিহার্য : মাহীন মাজহার

ইনডেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহীন মাজহার, ব্যবসার প্রতি আগ্রহ তাঁর ছোটবেলা থেকেই। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে পড়াশনা শেষ করে সেখানেই ব্যবসা শুরু করেন। আমেরিকায় বড় চাকরি করার সুযোগ পেয়েও করেননি। দেশে ফিরে এসে নব্বই দশকে পোল্ট্রি ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার নানা প্রসঙ্গে আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন, এবি টিভির সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কথপোকথনের অনুলিন তাঁরই ভাষায় ছাপা হলো।

আমি ছোটবেলা থেকেই আমার বাবাকে ব্যবসা পরিচালনা করতে দেখেছি সেখান থেকেই মূলত অনুপ্রাণিত হয়েছি। বিবিএ শেষ করার পর আমি নিজের ব্যবসা শুরু করি। তখন আমি কন্সিপ্ট করলাম। এসময় টোফেল,আইইএলটিএস পরীাগুলো দিয়ে দিলাম। তখন অনেকরকম প্রসেসের মাধ্যমে আবেদন করতে হতো। এখনকার মতো অনালাইনেই সব শেষ করা যেতনা। জিপিও গাইড থেকে তথ্য জানতাম কোন ইউনিভার্সিটি ভালো আর তাতে আবেদন করতাম। আবেদনপত্র জিপিওতে ড্রপ করে দিয়ে আসতাম। আবার একটা চিঠিও বানাতাম এই বলে যে আমি গরিব দেশের একটা গরিব স্টুডেন্ট। আমার এপ্লিকেশন ফি দেওয়ার সামর্থ্য নাই। তোমরা ফি ওয়েভার দাও। একটা ওয়েভার চিঠি দিতাম কারণ প্রত্যেকটা এপ্লিকেশনে অনেক টাকা করে ফি দেওয়া লাগতো। চিঠি দিতাম এই ভেবে যে ওরা নিলে নিবে না নিলে না নিবে। আলহামদুলিল্লাহ, চারটা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন হলো। একটাতে পড়াশুনা শুরু করলাম। পাঁচ বছরের কোর্স পৌনে চার বছরেই শেষ করলাম। আমাদের এখানে যেমন সেশনজট হয় ওখানে আবার অতিরিক্ত কোর্স করার সুযোগ থাকে। আমরা আঠারোজন গিয়েছিলাম সেখানে মাত্র দুইজন ফেরত আসলাম, সেটা ১৯৯২ সাল । আর গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলাম নাইন্টি সিক্সে । ফিরে এসে ইন্টার্ন হিসেবে ঢুকলাম মেডিক্উইএসএ। তখনকার সময়ে এটা ছিল সবচেয়ে বড় ফার্ম। এর পর কাজ শুরু করলাম সাহানা নামক একটা জায়গায় । ওরা এই সময় মটিভেশনার স্পিকার হিসেবে একজনকে নিয়ে নিয়ে আসলো। তিন দিনের সেশন হলো। বক্তৃতার পর ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করলো,হোয়ার ডু ইউ ও্যান্ট টু বে ফাইভ ইয়ারস ডাউন দা রো । তুমি আমাদের কোম্পানিতে এখন ট্রেইনি ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করছো। এখান থেকে পাঁচ বছর পরে নিজেকে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দেখতে চাও কি না? আমি চিন্তা করে দেখলাম পাঁচ বছর এখানে কাজ করে আমি জেনারেল ম্যানেজার না হয় হলাম কিন্তু আমার জায়গা থেকে স্বপ্ন পূরণ তো হবে না। তাই পরেরদিনই চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। নিঃসন্দেহে এটা অনেক বড় চাকরি ছিল।

মানে হচ্ছে তখনকার সময় দেড়-দুই লাখ আর এই সময়ের আট লাখ টাকার চাকরি ছেড়ে দিলাম। মোটিভেশন স্পিচের পর আমি পরিচিত একজনসহ ক্যালিফোর্নিয়ার এক আমেরিকান ভদ্রলোকের সঙ্গে কাজ শুরু করলাম। কাজটা ছিলো, আমরা ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তাদেরকে ওয়েবসাইট বানিয়ে দিতাম। এর পর ওয়েবসাইটের সঙ্গে টেলিফোন বিল এ্যাটাচ করে দিতাম। কারণ ভয় ছিলো পরে টাকা পাবো কি না। প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট-টা করে ওয়েবসাইট বিক্রি করতাম।

নাইন্টিন নাইন্টি সিক্সে আমেরিকাতেও ওয়েবসাইট নতুন ছিল । প্রায় ছয় মাসের মধ্যে আমরা প্রায় তিন মিলিয়ন টাকার ব্যবসা করলাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বিজনেস ল সম্পর্কে ধারণা থাকায় আমার পার্টনাররা আমাকে ঠকালো। কারণ আমার নামটা আমি কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করাইনি । ওটা লিমিটেড লায়াবিলিটির একটা প্রতিষ্ঠান ছিলো। সেখানে আমি আমার নামটা ইনকুড করিনি। এভাবে কর্পোরেট পলিটিক্সের শিকার হয়ে গেলাম। আমাকে কোনোরকম পাওনা ছাড়াই অব্যাহতি দেওয়া হলো। এরপর সেখানে নতুন বড় বড় ইনভেস্টররা আসা শুরু করলো। আমি খুব আশাহত হলাম। কারণ কিছুদিন পরেই আমরা পাবলিক লিমিটেডে যেতে পারতাম। ব্যবসায়ের পরিমাণ একসময় তিনশ’ মিলিয়ন হতে পারতো। এর পর নতুন চাকরি করবো নাকি আবার পড়াশুনা করবো সেটা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম । নানা কিছু ভেবে দেশে ফিরে আসলাম। আমার বাবা তখন বেশ অসুস্থ। দেশ থেকে বাইরে যাওয়ার উদ্দেশে আমার বিজনেস ভিসা রিনিউ করাতে চাইলাম। সঙ্গত কারণে তা আটকে গেল। তাই আর যাওয়া হলোনা । এর পর চিন্তা করলাম এখানে আমার দেশে কেন ব্যবসা করতে পারবো না? তখন পোল্ট্রিতে ইনভেস্ট করলাম, সময়টা নাইন্টি এইট।

আসলে এত কিছু বলার উদ্দেশ্য হলো আমি সত্যিকার অর্থে ব্যবসা ভালোবাসি ও নিজেকে বৈধ ব্যবসার জন্য উৎসর্গ করেছি। দেশে এসে এখানকার বিজনেস কালচার বুঝতে কিছুদিন সময় লেগে গেল । কারণ এখানে নৈতিকতা বজায় রেখে ব্যবসা করাটা খুবই কঠিন ছিলো। যদি এখানে ব্যবসাটাকে সায়েন্সের পর্যায়ে না ফেলা যায় তাহলে ব্যবসা করাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে। আমার বাবা দাদারা ব্যবসা করতেন যাদের প্রফিট মার্জিন ছিল থারটি-ফোরটির মধ্যে। আমার ও তাই হবে হবে যদি না সায়েন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

পোল্ট্রি ব্যবসার পর অন্য ব্যবসা
পোল্ট্রি ব্যবসা শুরুর পর আমি আবাসন ব্যবসায় কিছু বিনিয়োগ করি । আমি নিজেও একজন বিনিয়োগকারী। দেশের বাইরেও কিছু ইনভেস্ট ছিল। আবাসন ব্যবসায় প্রায় বিশটির মতো প্রতিষ্ঠান আছে। পুঁজিবাজার ধসের পর রিয়েল এস্টেট খাতে যে ধস নেমেছিল সেটা কি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে? কাটিয়ে ওঠা বলতে আমি বলবো,এখানে কিছু সংশোধন করা হয়েছে। এ কারণে ডেভেলপাররা তিগ্রস্ত হয়েছে । যেমন ধরুন ভূমি মালিকদের কাছ থেকে ফিফটি পার্সেন্ট লাভের বিনিময়ে জমি নেওয়ার পর দেখা যাচ্ছে সংশোধন হওয়ার কারণে তা আর ফিফটি পার্সেন্ট থাকছে না। প্রকৃত আবাসন ব্যবসায়ীরা কোনোভাবে নিজের টাকা বা ঋণ নিয়ে প্রকল্প শেষ করছে কিন্তু বাস্তবে তাদের লোকসান হয়েছে । তবুও আমি বলতে চাই কারেকশন হওয়ায় অনেক ভালো হয়েছে। ফ্যাট মানুষের ক্রয় মতার মধ্যে চলে আসছে ।

ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি
প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করে লাভের জন্য কোনোট কম আর কোনোটা বেশি। প্রতিটি ব্যবসায় নমনীয় পর্যায়ে লাভ থাকতে হয়। যেহেতু এটা এনজিও বা চ্যারিটি হাউস নয় একটা বিজনেস হাউসে বাস্তবে মিনিমাম দশ শতাংশ প্রোফিট না করলে টেকা দায়। কিন্তু কেউ পঞ্চাশ পার্সেন্ট প্রফিট করলে তা সাধারণ প্রবণতা নয়। এটা ভুলভাবে হয়ে থাকে এবং আমি একে সমর্থন করবোনাা।

এখন আমাদের দেশে আবাসন খাতে ব্যবহার করা র’ম্যাটেরিয়ালাসের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই । এবছর শুনছি রডের দাম আরো বেড়ে যাবে । আমেরিকায় যেমন কাঁচামালের জন্য নীতিমালা করা যা ব্যবসায়-সম্পৃক্ত মানুষদের জন্য অনেক ধরনের সুকিধা এনে দেয়। এ কারণে ওরা ব্যবসায় অনেক দিক থেকেই এগিয়ে।

ধরুন, একটা ছোট্ট ইন্ড্রাস্ট্রি, লাইক টাইলস। এখানে ইমপোর্ট ডিউটি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারকে ধন্যবাদ যে একশো চৌষট্টিটা প্রটেক্টিভ প্রোডাক্টের মধ্যে টাইলস টাকেও রেখেছে। কিন্তু ইমপোর্ট ডিউটি দশ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। আমাদের এসোসিয়শনে প্রায় চল্লিশ জনের মত সদস্য আছে। বিনিয়োগ আছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। ধারণা করি, সিরামিক সেক্টরে অন্তত তিন লাখ মানুষ কাজ করে।

মাহীন মাজহার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইনডেক্স গ্রুপ