নিজেদের ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন

বাংলাদেশের বয়স ৫০ বছর। যুদ্ধবিধ্বস্ত শূন্য অর্থনীতির দেশটির গত পাঁচ দশকের অগ্রগতি বিশ্ববাসীর কাছে আজ বিস্ময়ের। সব সূচকেই অনেক বাঘা অর্থনীতির দেশ থেকে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাধা পেরিয়ে সমাজে মর্যাদার স্থানে প্রতিষ্ঠিত হতে সর্বদা সচেষ্ট নারীরাও।

আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন অনেকে। পরিবার ও সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, যা নারীর ক্ষমতায়নে একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এক সময় নারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। ফলে নানা অন্যায় সহ্য করতে হয়েছে তাদের। এখন তারা সচেতন। আত্ম-নির্ভরশীল হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছেন অনন্য উচ্চতায়।

কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) এর কারণে বিশ্ব এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে বিরাজমান। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা। দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন মানুষের, বিশেষ করে নারী, শিশু ও বয়স্কদের নানাবিধ মানসিক সমস্যা তৈরির আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি কর্মহীনতার জন্য পরিবারের আর্থিক উপার্জন কমে যাচ্ছে। এরপরও থেমে নেই নারীরা।

নিজেদের শিক্ষা, প্রতিভা ও মননশীলতা কাজে লাগিয়ে একেকজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠছেন। কেউ এককভাবে, অনেকে আবার দলবদ্ধ হয়ে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গড়ে তুলেছেন নেটওয়ার্ক, যা তাদের আয়ের উৎস হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই উদ্যোগ বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুগোপযোগী ও বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়ও বটে। এমন উদাহরণ অনেক।

তাদেরই একজন অদিতি ঋতু। ঢাকার মেয়ে হলেও স্বামীর চাকরিসূত্রে থাকছেন জাপানের টোকিও শহরে। শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনা করা এই গৃহিণী বরাবরই নিজে কিছু করতে চেয়েছিলেন। সেই ইচ্ছাসূত্রেই আউট সোর্সিংয়ের কথা চিন্তা করে দেশীয় উপকরণ দিয়ে গয়না বানানোর কাজ শুরু করেন। তার উদ্যোগের নাম ‘কাব্যে ষড়ঋতু (Kabbe Shororitu)’।

জানালেন, প্রথমে শখের বশে করলেও বিভিন্ন অনুপ্রেরণায় একে ক্ষুদ্র উদ্যোগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা মাথায় আসে। আর এ ক্ষেত্রে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) নামের পেজটা আমাকে আরও বেশি আগ্রহী করে তুলেছে। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে জানলাম, এটি বাংলাদেশের ৬৪ জেলার উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সবাই নিজ জেলার পণ্য বা তাঁদের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।

উই-এর মাধ্যমে প্রতিটি জেলার প্রায় হারানো পণ্যগুলোও নতুনভাবে পরিচিতি পাচ্ছে। এ ছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এখানে সদস্যদের ই-কমার্স সম্পর্কে বিশদভাবে শেখানো হয়। বিভিন্ন সময়ে সেমিনার, ওয়েবিনার ও প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে।

নারীদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে বিকশিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই উই-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, ‘একটা সময় ফেসবুক শুধুই একটা যোগাযোগমাধ্যম ছিল, যেখানে অনেক পুরোনো বন্ধু খুঁজে পাওয়া যেতো। দেশের বাইরের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা হতো। কিন্তু বর্তমানে ফেসবুক একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে উদ্যোক্তাদের জন্য। ফেসবুকের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা পণ্য কেনাবেচা করতে পারছেন, যাকে আমরা এফ-কমার্স নামে জানি।

‘সেই এফ-কমার্সের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে আমাদের উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, যাকে আমরা উই বলে জানি। উই হচ্ছে দেশীয় পণ্যের একমাত্র জায়গা, যেখানে আমরা হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তাকে একত্র করতে পেরেছি। তাঁরা তাঁদের পণ্য কেনাবেচা থেকে শুরু করে নেটওয়ার্কিং, নানা বিষয়ে কর্মশালা ও ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ পর্যন্ত করতে পারছেন। এই একটিমাত্র প্ল্যাটফর্মে থেকে অনেকেই তাঁদের হতাশা কাটিয়ে সুন্দর ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও করছেন।’

উই-এর উপদেষ্টা রাজীব আহমেদ বলেন, আমরা উই-এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে নানা উদ্যোগে সংগঠনটির পাশে রয়েছি। তিনি বলেন, আমরা উদ্যোক্তাদের স্টার্টআপ থেকে শুরু করে পণ্য ডেলিভারি দেয়া পর্যন্ত কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে, তা হাতে-কলমে বুঝিয়ে দেই।

রাজীব জানালেন, তাঁর সঙ্গে হেঁটে অনেক উদ্যোক্তাই এগিয়ে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন কাকলী রাসেল তালুকদার। তিনি বলেছেন, ‘উই হচ্ছে আমার জন্য একটা ভার্চুয়াল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আমি খুব লাকি যে জামদানি পণ্য নিয়ে আমার উদ্যোগ ‘কাকলীস অ্যাটায়ার’-এর পথ চলার শুরুতে উইয়ের মতো প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি। যে অবস্থানে যেতে আমার ৫ বছর লেগে যেতে, সেটা আমি ৯ মাসে অর্জন করতে পেরেছি। শুরু থেকে সংগঠনের সিনিয়রদের পরামর্শগুলো ফলো করে আসছি। প্রতিদিন শিখছি।’

‘উই হচ্ছে দেশীয় পণ্যের বিশাল প্ল্যাটফর্ম। দেশীয় পণ্যের ক্রেতা ও বিক্রেতার মিলনমেলা। উইতে শিখছি ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সব তথ্য, জানছি বাংলাদেশের ৬৪ জেলার পণ্যের কথা। আর উইয়ের পথ ধরেই হেঁটে যাচ্ছি একজন দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা হয়ে,’ বলছিলেন আরেক উদ্যোক্তা নিগার ফাতেমা।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে কাজ করছি ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে। আমার অনলাইন পেজের নাম “আরিয়াস কালেকশন”।

নারী উদ্যোক্তা অদিতি ঋতু বলেন, উই-এর সঙ্গে আমি আছি প্রায় দুই মাস হতে চলেছে। এই দুই মাসেই আমি আমার উদ্যোগের অনেক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। জাপানে বসেই বাংলাদেশ থেকে অনেকগুলো অর্ডার পাচ্ছি। তা ছাড়া বাংলাদেশের অনেক ই-কমার্স উদ্যোক্তা আমাকে এখন চিনতে পারছেন, যা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া।

‘মোট কথা উইয়ে জয়েন করে আমি অনেক লাভবান হয়েছি এবং তা শুধু আমার পণ্য বিক্রির জন্যই নয়, ই-কমার্স-সম্পর্কিত অনেক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পেরেও আমি আমার উদ্যোগ নিয়ে অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছি।’

ময়মসিংহ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আমিনুল হক শামীম বলেন, বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সাফল্য অর্জনের জন্য উই এক সম্ভাবনার দ্বার হিসেবে কাজ করছে বলে আমি মনে করি। আমি সংগঠনটির সাফল্য কামনা করি।

সংগঠনটির উপদেষ্টা রাজীব আহমেদের ভাষ্য, ই-কমার্সে দেশি পণ্যের প্ল্যাটফর্মের খুব দরকার ছিল। উই সেই শূন্যতা পূরণ করতে পেরেছে। এর ফলে অনলাইনে দেশি পণ্যের প্রতি আস্থা ও বিক্রি অনেক বাড়বে।

গর্বের সঙ্গে উই সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা জানান, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি ভাইবোনেরা দেশীয় পণ্যের কেনাকাটা করতে পারছেন, নিজেরা ব্যবহার করছেন এবং আপনজনদের উপহারসামগ্রীও পাঠাচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী নারী উদ্যোক্তাদের এই জোয়ারটা ছড়িয়ে পড়বে। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান