নির্মাণ শিল্প প্রসারে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য অপরিবর্তিত চাই-মুহম্মদ শহীদ উল্লাহ

নির্মাণ শিল্প সম্প্রসারণে কী কী সমস্যা : আমরা মূলত নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদন করি। এ ছাড়া বাংলাদেশে আমরা সিমেন্ট ম্যানুফেকচার করে থাকি। বিশ^মানের স্টিল, পরিবেশ বান্ধব ইট উৎপাদন করি। ধারাবাহিকভাবে আমরা টেকনোলোজিক্যাল ব্যবসায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছি। যেমন বিশে^র অন্যতম নামকরা মোবাইল ব্র্যান্ড এলজি’র বাংলাদেশের ডিস্ট্রিবিউটর হয়ে কাজ করছি আমরা।

এখন যদি নির্মাণ সামগ্রীর দিকে আসি তাহলে বলবো, এই পণ্যগুলো এমন একটি উপাদান যে রাষ্ট্রের উন্নয়নের সাথে সাথে এসবের চাহিদা ও ব্যবহার বাড়তে থাকে। আমাদের এই ১৬ কোটি মানুষের দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি, আবকাঠামো উন্নয়নে নির্মাণ সামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিগত ৫ থেকে ৭ বছরের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে, আমাদের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারা কিন্ত ব্যাপক। পাশাপাশি দেশে যেভাবে শিল্পায়ন হচ্ছে সেক্ষেত্রে সিমেন্টের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক একইভাবে স্টিলেরও চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা শুরু থেকেই গুণগত মানের সিমেন্ট উৎপাদন করে আসছি। আমরা ২০০০ সালে যখন প্রথম ইউনিট বসাই, তখন থেকেই দেশের প্রতিটি প্রান্তে আমরা আমাদের সিমেন্ট পৌঁছে দিচ্ছি। যারা আমাদের সিমেন্ট ব্যবহার করছেন তাদের চাহিদার কারণেই আমাদের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন করতে হয়েছে। ফলে আমরা একইসঙ্গে এই দুই ইউনিট থেকেই সিমেন্ট উৎপাদন করছি। দেশের অবকাঠমো নির্মাণের সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব সেক্টরেই আমাদের সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমরা ইট উৎপাদনের দিক দিয়েও এগিয়ে যাচ্ছি। ঢাকা শহর ছাড়াও এর আশে পাশে আমরা পরিবেশ বান্ধব ইট নির্মাণ কাজ হাতে নিয়েছি। এ ছাড়া দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতেও এমন পরিবেশ বান্ধব ইট উৎপাদনের পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি। সার্বিকভাবে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন। তার মধ্যে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ইকোনোমিক জোন করা হয়েছে। যেখানে স্থানীয়রাসহ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ নিয়ে আসবেন । এই শিল্পের সাথে অনেক স্টেকহোল্ডার জড়িত। যার ধারাবাহিকতায় সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের বিভিন্ন উইংসের মাধ্যমে উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে যাবে এবং সেভাবেই যাচ্ছে। আপনারা জানেন, আরএমজির মাধ্যমে আমরা সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকি। অনেকের ধারণা ছিল যে এর নেগেটিভ গ্রোথ আসবে। কিন্ত আমরা কী বাস্তবতা দেখছি? এই সেক্টর দিনকে দিন অনেক ডেভলপ করে যাচ্ছে। একই সাথে আইটি সেক্টরও এগিয়ে যাচ্ছে।

শিল্পায়নে সমস্যা সম্ভাবনা: শিল্পায়নের সম্ভাবনার সাথে এর কিছু সমস্যা রয়েছে। কিন্ত এক্ষেত্রে সমস্যার চাইতে সম্ভাবনাটাই বেশি। যেখানে অনেক সম্ভাবনা সেখানে কিছু লিমিটেশন তো থাকবেই। আমি মনে করি বর্তমান সরকার এসব সমস্যা সমাধানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আপনারা জানেন যে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার কিছুদিন আগে নতুন ভ্যাট আইন চালু করে। কিন্ত শিল্পের উন্নয়নের স্বার্থে, শিল্প বিকাশের জন্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বিশেষ অনুরোধে, সরকার অনেক এগিয়ে যাবার পরও সিদ্ধান্ত স্থগিত করে। এ জন্য সরকারসহ ভ্যাট আইন স্থগিতের পেছনে যারা কাজ করেছেন তাদের আমি ধন্যবাদ জানাই। আসলে শিল্পের স্বার্থ মানে দেশের স্বার্থ। আর শিল্প উন্নয়ন মানে দেশের উন্নয়নের চাকা দ্রুত এগিয়ে যাওয়া।

সরকারের ভ্যাট আইনকে আমরা শ্রদ্ধা করি। আমরা যারা শিল্প উদ্যোক্তা বা পণ্য উৎপাদন করি, আমরা যদি ভ্যাট, ট্যাক্স না দিই তাহলে দেশের উন্নয়ন হবে কী করে? আমরা সরকারকে সহযোগিতা করবো, করতে চাই। এর জন্য আমাদের একটু সময় দিতে হবে। শিল্পায়নের জন্য বিদ্যুৎ, গ্যাস অপরিহার্য। কিন্ত কিছুদিন হলো এক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। চাহিদার তুলনায় আমরা গ্যাস পাচ্ছি না। সরকার এই গ্যাস, অল্প কয়েকটা সেক্টর ছাড়া সবাইকে দিতে পারবে না, সেটা আমরা জানি। এজন্য আমরা যারা গ্যাসের উপর নির্ভর ছিলাম তারা এখন গ্যাসের বিকল্প হিসেবে বিদ্যুতের উপর নির্ভর করছি। সরকারও এখন বিদ্যুতের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করছে। যা অবশ্যই আমাদের জন্য একটা সুখবর। এজন্য নতুন উদ্যোক্তারা তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুতের ব্যবহারের কথা মাথায় রেখেই প্রতিষ্ঠা করছে।

বিদ্যুতের মূল্য বিবেচনা করা দরকার: একটা বাসা বাড়িতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়, একটা শিল্প প্রতিষ্ঠানে কিন্ত তার তুলনায় বহুগুণ বেশি প্রয়োজন। সিমেন্ট, স্টিলের মতো এমন ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে তো বিদ্যুতের চাহিদা বলাই বাহুল্য। কিন্ত দেখেন, এখন আবার বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর চিন্তা করা হচেছ, তাহলে কেমনে হবে? আমি মনে করি, আমরা যারা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি তাদের জন্য আলাদা করে বিদ্যুতের রেট করা উচিত আর বাসা বাড়ির জন্য আলাদা। এভাবে একসাথে বিদ্যুতের মূল্য না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ালে ভালো হবে। না হলে এর প্রভাব গিয়ে পড়বে পণ্যের উপর। তার পর বর্তমানে সরকার যে ইকোনোমিক জোন তৈরি করছে তাতে যদি নতুন কোনো উদ্যোক্তা শিল্প প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন, তখন প্রথমেই চিন্তা করবেন, বিদ্যুতের মূল্যের সঙ্গে তার বিনিয়োগের রিটার্নের কথা। তখন উদ্যোক্তা ভাববেন তার লাভ হবে না লস হবে। সেটাও কিন্ত সরকারের মাথায় রাখতে হবে।

ফাইন্যান্সিয়াল কস্ট অফ ইনভেস্টম্যান্ট রেইট: আমরা আরেকটা ব্যাপার নিয়ে বিভিন্ন সময় জোর দিয়ে কথা বলে আসছি। আর তা হচ্ছে ফাইন্যান্সিয়াল কস্ট অফ ইনভেস্টম্যান্ট রেইট সিঙ্গেল ডিজিটের মধ্যে রাখার কথা। এটা শুধু সিঙ্গেল ডিজিটে না, সিঙ্গেলে আসার পরও ডাউন অবস্থায় আছে। এজন্য ফাইন্যান্সিয়াল কস্টের ক্ষেত্রে ব্যাংক রেইট যেটা কমে আসছে সেজন্য আমরা খুশি। কিন্ত বর্তমানে পাওয়ারের ক্ষেত্রে যে মূল্য বৃিদ্ধর কথা বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে বলবো, শিল্পের বিকাশে একটু সময় নিয়ে ভালো করে চিন্তা করা উচিত। কারণ একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে নিরুপণ করবো তার মাপকাঠি হলো বিদ্যুৎ কনজামশন, স্টিল পার ক্যাপিটা ইউজ, সিমেন্ট পার ক্যাপিটা ইউজ। এই প্যারামিটার কিন্ত আপনাকে ইন্ডিকেশন করে। আশপাশের দেশগুলোতে এখন আমাদের সিমেন্ট অলমোস্ট ওয়ান থার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। আপনারা শুনে অবাক হবেন, আমাদের সিমেন্ট ইউজ হয় পার ক্যাপিটা মাত্র ১১০ কেজি। যেখানে উন্নত দেশগুলোতে ২০০ কেজি থেকে ৩০০ কেজি। এমনকি ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটানেও আমাদের চেয়েও অনেক বেশি সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। সুতরাং আমাদের সিমেন্ট ব্যবহারের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে স্টিল, আমরা যাকে রড বলি, এ রড এখনও ২৮ কেজি পার ক্যাপিটা ইউজ হচ্ছে।

সারা দেশে ফায়ার বার্ন ইটভাটা: আরেকটা ব্যাপার বলতে হবে, আমাদের সারা দেশে যত্রতত্রভাবে ফায়ারবার্ন ইটভাটা গড়ে উঠেছে, যেগুলোতে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। যার ফলে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। আমি সরকারকে বলবো, এ ব্যাপারে এখনই কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশ বান্ধব ইট তৈরির প্রক্রিয়াকে প্রমোট করতে হবে। তা না হলে আমাদের উর্বর কৃষি জমির উপর চাপ পড়বে। কমে আসবে কৃষি জমি। আমার পক্ষ থেকে সরকারের কাছে এজন্য একটা প্রস্তাব থাকবে, যাতে ফ্লাই অ্যাশ, সেন্ট ও সিমেন্ট দিয়ে ইট তৈরির জন্য যেন সবাইকে নির্দেশনাসহ উৎসাহিত করা হয়। তাহলে পরিবেশের উপকার হবে এবং আমাদের জমিগুলো রক্ষা পাবে। সরকার যদি আমাদের বিনা শুল্কে ফ্লাই অ্যাশ আমদানি করার অনুমোদন দেয়, তাহলে এই উপাদানে তৈরি ইট আমরা সারা দেশে সাপ্লাই দিতে পারবো।

মুহম্মদ শহীদ উল্লাহ
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মেট্রোসেম গ্রুপ