নোয়াবের সাথে সুর মিলিয়ে সম্পাদক পরিষদের বিবৃৃতিতে সাংবাদিক নেতারা বিস্মিত

নোয়াবের সাথে সুর মিলিয়ে সম্পাদক পরিষদ বিবৃৃতি দেয়ায় বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নসহ ফেডারেশনভূক্ত দেশের সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা বিস্মিত হয়েছেন।

তারা বলেছেন, নোয়াব সংবাদপত্র শিল্পে বিনিয়োগকারি ব্যবসায়ী মালিকদের সংগঠন। আর সম্পাদক পরিষদ পেশাদার সাংবাদিকদের সংগঠন। নোয়াবের দাবি অনুযায়ী ওয়েজবোর্ড অবান্তর হলে সম্পাদকরাও অন্য শিল্পের শ্রমিক ও দিনমজুরের কাতারে নেমে যাবেন। কেননা, ওয়েজবোর্ড শুধুমাত্র সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারিদের বেতন কাঠামো নয়। এটা রাষ্ট্রের আইন। এ আইনে গণমাধ্যম কর্মীদের বেতন-ভাতার অধিকারের পাশাপশি মর্যাদাও সুরক্ষিত হয়েছে।

বিএফইউজে সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ডিইউজে সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু আজ এক যুক্ত বিবৃতিতে এসব কথা বলেন। তারা বলেন, ওয়েজবোর্ড আইনে একজন সম্পাদককে ইন্সটিটিউশন হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

ওয়েজবোর্ড আছে বলেই তিনি সম্পাদক। নোয়াবের দাবি অনুযায়ী ওয়েজবোর্ড যদি অবান্তর ও অযৌক্তিক হয়, তা হলে গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে অন্য শিল্পের শ্রমিক ও দিনমজুরের কোন পার্থক্য থাকে না। ওয়েজবোর্ড না থাকলে একজন পেশাদার সম্পাদক থেকে শুরু করে সংবাদপত্র শিল্পের পিয়ন পর্যন্ত সবাই এক কথায় মজুরে পরিণত হবেন।

নেতৃবৃন্দ বলেন, মালিকরা সরকারের কাছে অনেক কিছুই চাইতে পারে। তাই বলে দাবির আড়ালে সংবাদকর্মীদের দাসে পরিনত করার চাতুরি কোনভাবেই মেনে নেয়া হবে না।

তারা বলেন, নোয়াবের বিবৃতিতে সাংবাদিক ছাঁটাইয়ের একটি শব্দও নেই। অনুরূপভাবে সম্পাদক পরিষদও এ বিষয়ে কিছুই বলেনি। অথচ সাংবাদিকদের প্রাতিষ্ঠানিক অভিভাবক হচ্ছেন সম্পাদক। নোয়াব পরিবারের সদস্য সংবাদপত্রের নেতৃত্বাধীন সম্পাদক পরিষদ কি জানে না, ইতোমধ্যেই প্রথম আলো থেকে ৩৭ জন, ডেইলি স্টার থেকে ৩৫ জন, কালের কন্ঠ থেকে ৫৭ জন, আজাদীর ৫ জন এবং দৈনিক পূর্বকোনের ৪ জন সাংবাদিক চাকরিচ্যূত হয়েছেন।

সাংবাদিক নেতৃবন্দ আরো বলেন, করোনার এই দুঃসময়ে একজন সংবাদ কর্মীকে চাকরিচ্যূত করার মানে তাকে হত্যা করার সামিল। করোনার অজুহাত দেখিয়ে গণমাধ্যমে ছাঁটাই ও চাকরিচ্যূতির মহোৎসব শুরু হয়েছে। অথচ সরকার অন্যান্য শিল্পেরমতই সংবাদপত্র শিল্পের জন্য প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেছে। ব্যাংকে গেলেই নিয়মমাফিক প্রনোদনা পাওয়া যায়। এছাড়াও সংবাদপত্রের বকেয়া বিলের প্রায় ৮০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে বলেও জানি। দেশের এমন কোন সংবাদপত্র নেই যারা ওই টাকা নেয়নি। কিন্তু তারপরও সংবাদকর্মীরা তাদের ন্যায্য পাওনা পায়নি। সরকার সংবাদপত্রকে সহযোগিতা দেয় কারো ৬ তলাকে নয় তলা বানানোর জন্য নয়। সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারিদের বেতনভাতা দেয়ার জন্য। এ বিষয়ে প্রয়োজন হলে ইউনিয়ন যে কোন সময় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে নোয়াব এবং সম্পাদক পরিষদকে সংবাদপত্র শিল্পে সরকারি সহায়তার ফিরিস্তিটা ধরিয়ে দিতে পারে।

নেতৃবৃন্দ আশাকরে, ইউনিয়নসহ সকল পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সর্বজন গ্রহনযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহন করাই উত্তম। একদিকে ঢালাও ছাঁটাই আবার অন্যদিকে আয়-উপার্জনের দাবি-দাওয়া এক সাথে চলতে পারেনা।

এদিকে ওয়েজবোর্ডই যৌক্তিক নয়। নোয়াবের এই বিবৃতির প্রতিবাদে ইতোমধ্যেই বিএফইউজে ও ডিইউজে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। নেতৃবৃন্দ বলেন, নোয়াবের জন্মের বহু আগে থেকেই সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থায় সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারিদের জন্য ওয়েজবোর্ড কার্যকর রয়েছে।

নেতৃবৃন্দ জানান, ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের রুটি-রুজি ও মর্যাদা সুরক্ষা করে ‘নিউজ পেপার এমপ্লোয়িজ (কন্ডিশন অব সার্ভিস) এ্যাক্ট’ আইন প্রণয়ন করে দিয়েছিলেন। ওই আইনে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র কর্মীদের সুযোগ-সুবিধার বিধান রাখা হয়। দলমত নির্বিশেষে দেশের সাংবাদিক সমাজ ওই আইনের আওতায় সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থেকে দেশ ও জাতির সেবায় কাজ করেছেন। কিন্তু কোনও কারণ ছাড়াই ২০০৬ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার জাতির পিতা কর্তৃক প্রণীত আইনটি বাতিল করে সাংবাদিকদের অন্যান্য শিল্প কারখানার শ্রমিকদের কাতারে নামিয়ে দেয়। এরপর থেকে ওই আইনের বিরুদ্ধে এদেশের সাংবাদিক সমাজ লাগাতার আন্দোলন করে আসছে। সাংবাদিকদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় বর্তমান সরকার সাংবাদিকদের রুটি-রুজির অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষায় ২০০৬ সালের আইনকে সময়োপযোগি করে ‘গণমাধ্যম কর্মী আইন’ নামে একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে যা এখন জাতীয় সংসদে পাশ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, বিএফইউজে-ডিইউজে গত ২২ আগস্ট দেওয়া বিবৃতিতে বলেছে, ‘আগস্ট হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি চক্রান্তের মাস। দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে এ মাসেই চক্রান্তকারিরা বেশী তৎপর হয়। গত শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভয়াবহ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়ে বিএনপি নেতারা যে ভাষায় কথা বলেছে নোয়াবের বিবৃতিতে তার গন্ধ পাওয়া যায়’। মাত্র দু’ দিনের মাথায় বিএনপি নোয়াবের দাবির সমর্থনে বিবৃতি দিয়ে প্রমান করলো, গণমাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে একটা অস্থিরতা সৃষ্টির চক্রান্ত চলছে।

নেতৃবৃন্দ বলেন, দেশের সাংবাদিক সমাজের স্বার্থের বিরুদ্ধে নোয়াবের বিবৃতির সমর্থনে বিএনপির বিবৃতির যোগসূত্র কি সরকারকে তা খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ, নোয়াবের দাবি ও সমর্থনের সারাংশে সরকারকে জিম্মি করে স্বার্থ হাসিলের পাশাপশি সংবাদ কর্মীদের অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার বিষয় রয়েছে।

নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, নবম ওয়েজবোর্ডের বিরুদ্ধে নোয়াবের মামলার শুনানিতে সুপ্রীমকোর্ট বলেছে, “সাংবাদিক ছাড়া সংবাদপত্রের মালিকরা অস্তিত্বহীন”। তার মানে হচ্ছে, রাষ্ট্রের আইন মনে করে, সংবাদপত্রের অন্তপ্রাণ হচ্ছেন সাংবাদিকরা। আর এজন্যই রাষ্ট্র ওয়েজবোর্ড আইন দ্বারা সংবাদ কর্মীদের অধিকার ও মর্য়াদা সুনিশ্চিত করেছে। নোয়াব ও তাদের সমর্থকরা দীর্ঘদিনের সেই অধিকার ও মর্যাদা চিরতরে বিনষ্ট করে সংবাদকর্মীদের দিন মজুর বানানোর চক্রান্ত শুরু করেছে। এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিএফইউজে ও ডিইউজের নেতৃত্বে গোটা দেশের সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ। নেতৃবৃন্দ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আরো বলেন, কোন অশুভ শক্তিকে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে দেওয়া হবে না।

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন, বিএফইউজে সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ডিইউজে সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, সিইউজে সভাপতি মোহাম্মদ আলী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল ইসলাম, কেইউজে সভাপতি মুন্সী মাহবুব আলম সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক সায়েদুজ্জামান সম্রাট, জেইউজে সভাপতি সাজেদ রহমান বকুল, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান মিলন, বিইউজে সভাপতি আমজাদ হোসেন মিন্টু, সাধারণ সম্পাদক জিএম রউফ,আরইউজে সভাপতি কাজী শাহেদ, সাধারণ সম্পাদক তানজিমুল হক, এমইউজে সভাপতি আতাউল করীম খোকন, সাধারণ সম্পাদক মীর গোলাম মোস্তফা, সিবিএইউজে সভাপতি আবু তাহের, সাধারণ সম্পাদক জাহেদ সরওয়ার সোহেল, এনইউজে সভাপতি আবদুস সালাম, সাধারণ সম্পাদক আমির হোসাইন স্মীত, জেইউকে সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব, সাধারণ সম্পাদক জামিল হাসান খোকন। এছাড়াও বরিশাল, দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, গোপালগঞ্জ, বরগুনা, চাঁদপুর ও খাগড়াছড়িসহ, বিভিন্ন জেলার সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান