পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির জন্য এককভাবে ব্যবসায়ীরা দায়ি নয়

নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। একদিকে বিক্রেতা, আরেকদিকে ক্রেতা। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমিসহ সকল ব্যবসায়ীকেই কিনতে হয়। বলতে বাধ্য হচ্ছি, চিনির দাম এখন ১৩০ টাকা কেজি। অনেক জায়গায় আরো বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের দাম ১৪০ টাকা ডজন। ব্রয়লার মুরগির দাম ২০০ টাকার উপরে। আটার দাম আগে থেকেই বেড়েছিল। তেলের দামও বেড়ে গেছে। আমরা যেহেতু ব্যবসায়ী, দোষটা আমাদের উপরেই প্রথম আসে যে, কেনো পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে ? আসলে এটাতো বাজার অর্থনীতির প্রভাব। বাজার অর্থনীতিতে একজনের পক্ষে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। কেননা, অনেকে মিলেইতো সমষ্টিগতভাবে ব্যবসা করছে। যে পণ্যগুলোর নাম আমি উল্লেখ করেছি, এগুলোতো একজন ব্যবসায়ী করেন না, বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা এই ব্যবসা করছেন। প্রশ্ন হলো, কেন দাম বাড়ছে? তাহলে সব ব্যবসায়ীরা কি এক হয়ে সিন্ডিকেট গেল? না, সেটা সম্ভব না।

বিষয়টা খতিয়ে দেখা যাক। প্রথম সমস্যা হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে সব পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আর বিশ^বাজারে দাম বেড়ে গেলে তা আমাদের উপর অবশ্যই প্রভাব ফেলবে, আমাদের কোনো উপায় থাকে না। কারণ বাংলাদেশে ধান, সবজি, মাছ, মুরগি ছাড়া বাকি সব আমদানি করতে হয়। গম, ভোজ্য তেল, সব ধরনের মসলা আমাদেরকে আমদানি করতে হয়। এসব পণের দাম আন্তর্জাতিক বাজারেই বেড়ে গেছে। দ্বিতীয়ত ডলারের মূল্য অতি বৃদ্ধি। এ দুটোই বাজারকে প্রভাবিত করেছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়াতে আমাদের আমদানি খরচ বেশি হচ্ছে। আরেকটি বড় সমস্যা, সবাই এখন এলসি করতে পারছে না। ব্যাংক এলসি দিতে পারছে না। ব্যাংকে ডলার সংকট তীব্র। আগে যদি ১০০ জন ইমপোর্ট করতে পারত, এখন সেখানে ৫ থেকে ১০ জনের বেশি ইমপোর্ট করার সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাজারে যে পরিমাণ সাপ্লাই থাকার কথা সেটা নেই। ডিমান্ডের তুলনায় সাপ্লাই কম থাকলে পণ্যের দাম অবশ্যই বাড়বে, আর তা-ই ঘটেছে আমাদের বাজারে। আসলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওভারঅল একটা ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পুরো বিশ্ব।

আমাদের বিস্কিটের ব্যবসা রয়েছে। বিস্কিটের প্রধান কাচামাল হচ্ছে আটা, চিনি, তেল। এ তিনটা পণ্যের মূল্য গত এক বছর আগে যা ছিল, তা বেড়ে এখন দ্বিগুনেরও বেশি হয়েছে। এখনও ৫ টাকা দামের বিস্কুটের প্যাকেট বাজারে খুঁজলে পাওয়া যাবে। কিভাবে সম্ভব হচ্ছে তা বিশ্লেষণের ভার আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম। দাম কম রাখতে পারছি না, সেজন্য আমাদের বিক্রি কমে গেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ২০২৩ সাল আমাদের সবাইকে কষ্ট করতে হবে। সবাইকে এই ধাক্কা সামলাতে হবে। আমরা সবাই জানি, আমাদের ফরেন কারেন্সির উৎস দুটো। প্রথমতঃ যেটা আমাদের শ্রমিকরা পাঠায় বিদেশ থেকে, সেই রেমিটেন্স। দ্বিতীয়তঃ আমাদের রপ্তানি আয়। বিদেশে আমাদের শ্রমিকদের কাজ করে পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ এখন কিছুটা কমে গেছে। ক্রাইসিস চলছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড। বিদেশেও চাকরির বাজার ছোট হয়ে গেছে। বিদেশেও পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের শ্রমিকদের বেতন বাড়েনি, অথচ তাদের খরচ বেড়ে গেছে। শ্রমিকদের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে তারা আগের মত রেমিটেন্স পাঠাতে পারছেন না।

দ্বিতীয়তঃ আমাদের রপ্তানিও কমে গেছে। আমাদের ফরেন রেমিটেন্সের উৎস এ দুটোই এখন মাইনাসের দিকে চলে যাচ্ছে। এর ফলে ডলার আসছে না। আমদানি নির্ভর আমাদের অর্থনীতি। আমার মনে হচ্ছে, কঠিন একটা পরিস্থিতির দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

এখন করণীয় নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। পণ্য সাধারণত তিন রকমের। প্রথমত প্রয়োজন, যেটা ছাড়া মানুষ চলতে পারবে না। দ্বিতীয়ত মিড লেভেল, যেটা প্রয়োজন কিন্তু এটাকে ডাইভার্ট করা যায়। যেমন ধরুন গম। আপনি গম ছাড়া চলতে পারবেন না, এটা আনতেই হবে। আবার ধরুন অলিভ অয়েলও প্রয়োজন। কিন্তু চাইলে আপনি এটা পরিবর্তন করতে পারবেন। অলিভ অয়েল না খেয়ে আমরা সরিষার তেল খেতে পারি। তৃতীয়ত এমন অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলো প্রয়োজন, কিন্তু এখনই না হলেও চলে যাবে। যেমন জুয়েলারি, দামি বিদেশি কাপড়, জুতা। এগুলো ছাড়াও আমাদের চলে যাবে। এই তিনটা সেক্টরে সরকারকে এখন নজর দেয়া উচিৎ। কোনভাবেই এগুলো আমাদানির অনুমতি বা এলসি করতে দেয়া যাবে না।

মানুষের বেসিক বলতে প্রথমত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান। আমাদের ৫% মানুষ ছাড়া বেশির ভাগেরই বাসস্থান রয়েছে। বাংলাদেশের কোথাও আপনি বস্ত্র ছাড়া মানুষ খুঁজে পাবেন না। চাইলে একটা শার্ট দুই বছর পরা যায়। আবার এমনও লোক আছে দিনে তিনটা শার্ট পরে। কিন্তু খাদ্যে রিসাইকেলিং করা সম্ভব না। আপনি ভাত খেয়ে ফেললে শেষ। ফুড আইটেমে সরকারের উচিৎ যেগুলো বেসিক আইটেম এগুলোর এলসিতে বাধা না দেয়া। সরকার থেকে রেগুলেশন করা, যে পণ্যের প্রয়োজন নেই, সেগুলো আমদানি বন্ধ করে দেয়া।

এই মুহূর্তে উন্নয়নমূলক কাজ যেগুলো আছে, ওগুলো চলুক। নতুন বড় ধরণের কোনো উন্নয়নমূলক কাজে হাত না দেয়া। আমাদের যে রিজার্ভ আছে তার সাথে যায় না। কারণ একটি উন্নয়নমূলক কাজ করতে গেলে প্রচুর ডলার দেশের বাইরে চলে যাবে। এই মুহূর্তে আমাদের এমন উন্নয়ন করার দরকার নেই, যেটা না করলেও হয়। একটা বড় বিল্ডিং বানানো দরকার, আমি এই মুহূর্তে না করলাম, চলছে তো। যেটা না করলেই নয় যেমন, ব্রিজ-রাস্তা, এগুলো দরকার আছে। এখনই প্রয়োজন নেই যেমন মনুমেন্ট, এক্সিবিশন সেন্টার। এগুলো একটু স্লো যাওয়াই বেটার আমি মনে করি। দিনশেষে মানুষ যদি পেটে খাওয়া পায়, তাহলে ওগুলো ভুলে যাবে। পেটে খাওয়া না পেলে, স্বর্ণ দিয়ে বাড়ি বানিয়ে দিলেও থাকবে না। মানুষ তখন রাস্তায় নামবে। তাহলে আগে পেটে খাওয়া এনসিওর করতে হবে।

বাজেট ও নির্বাচন: নির্বাচনের সাথে ব্যবসার একটি সম্পর্ক আছে। ব্যবসায়ীরা সাধারণত পাঁচ বছর পর যখন নির্বাচন আসে, নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বিনিয়োগ করেন না। দেখতে চান, কে বা কারা সরকারে আসছে। চলতি সরকার আসলেও সরকারের কিছু পলিসি পরিবর্তন হয়। যদি স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচন হয়, তাহলে প্রোডাক্টের বিক্রি বাড়ে। কারণ পুরো ইকোনমিতে মানি সার্কুলেশন হয়। আবার নির্বাচনে সহিংসতা হলে, উৎসবমুখর না হলে এর উল্টোটা হয়।

বর্তমান সরকার যে কয়টা বাজেট দিয়েছে সবগুলো মোটামুটি ব্যবসা বান্ধব ছিল। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই, ব্যবসা বান্ধব বাজেটের জন্যেই বাংলাদেশের এই গ্রোথ সম্ভব হয়েছে। কিছু জায়গায় শতভাগ সবসময় হবে না। শতভাগ ব্যবসায়ীরাও পাবে না। জনগণও পাবে না। জনগণকে ১০০ ভাগ দিয়ে দিলে ব্যবসায়ীরা কলাপ্স করবে। ব্যবসায়ীদের ১০০ ভাগ দিয়ে দিলে জনগণ সাফার করবে। এটার ব্যালান্সিং একটা ইস্যু আছে। আমি মনে করি, বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা বিবেচনা করে উন্নয়নমূলক কাজগুলোর কস্ট কাটিং করা। কারণ যে ট্যাক্স ব্যবসায়ীরা দিচ্ছে, ব্যবসার অবস্থা কিন্তু সেই তুলনায় বেশি ভালো না, এটা বুঝতে হবে। ব্যবসায়ীদের যদি ভ্যাট ট্যাক্সে অতিরিক্ত চাপ দেয়া হয় বাজেটে, তাহলে একসময় ব্যাসায়ীরা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হবে। ব্যবসা বন্ধ হলে এর দুটো এফেক্ট হবে। পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাবে এবং কর্মসংস্থান হারাবে। একটা বড় গ্রুপ যদি তাদের ভোগ্য পণ্য ব্যবসা বন্ধ করে দেয়, সেখানে হাজার হাজার লোকের চাকরি চলে যাবে। আমি মনে করি এবারের বাজেটে ট্যাক্স কমিয়ে, খরচ কমিয়ে একটি রক্ষণশীল বাজেট হওয়া দরকার।

ভাইয়া গ্রুপ: আমাদের মূলত ব্যবসা ফুড আইটেম। ভাইয়া গ্রুপের ৬৮ টি আইটেম রয়েছে। আমাদের প্রোডাক্টগুলো উচ্চমানের। আমাদের মূল আইটেমগুলো এক্সপোর্ট হয়। লোকাল মার্কেটে অল্প কিছু প্রোডাক্ট দিয়েছি। আমাদের প্রোডাক্ট এর দাম মার্কেট থেকে একটু বেশি। আপনি যখন কোয়ালিটি ভালো দিবেন, প্রোডাক্টের দামও তখন বেশি হবে। যেসব ভোক্তা ভালো পণ্য খেতে চাইবে, তারা আমাদের পণ্য ক্রয় করবে। আমরা কোয়ালিটিতে কম্প্রোমাইজ করি না। আমি ভোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, মাত্র কয়েক টাকা দামের পার্থক্যের জন্য আপনারা লো কোয়ালিটি পণ্য খাচ্ছেন। যেমন আমাদের পণ্যের একটা বিস্কিটের প্যাকেট ২০ টাকা। একটু লো কোয়ালিটি সেটা ১৮ টাকা। এই বিস্কিট খাওয়ার ফলে আপনার গ্যাসের প্রবলেম হতে পারে। তখন আপনাকে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেতে হবে ১০ টাকা পিস ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল। সার্বিকভাবে আপনার ৮ টাকা লস হল। আপনার শারীরিক কষ্ট হল। ওষুধও খেতে হল শুধু ভালো প্রোডাক্টটা না খাওয়ার কারণে।

বাংলাদেশে এত হসপিটাল কেন? অথচ জাপানে দেখেন হসপিটাল বন্ধ করে দিচ্ছে। কাপড়, জুতা আপনি কম দামে কিনেন অসুবিধা নেই। কিন্তু খাদ্য সব সময় সেরাটা কেনা উচিৎ। ফুড নিয়ে কোন কম্প্রোমাইজ করবেন না। আমরা সাধারণত বাজারে গিয়ে সবচেয়ে কম দামি তেল কিনি। লেভেল দেখি তারপরে দেখি সবচেয়ে কম দাম কোনটা। কম দাম খুঁজতে গিয়ে আমরা খারাপ পণ্য কিনছি। তুলনামূলক একটু বেশি দামের কারণে আমাদের প্রোডাক্ট লোকাল মার্কেটে কম চলে।

আমাদের প্রোডাক্ট লন্ডন, মালদ্বীপ, কাতার, জর্ডান, দুবাই যাচ্ছে। আমাদের প্রোডাক্ট পাঠানোর জন্য সম্প্রতি আমেরিকার সাথে কথা হচ্ছে। বিদেশে প্রোডাক্ট পাঠানোর জন্য কোয়ালিটি কন্ট্রোল পাশ করে যেতে হয়। আমাদের দেশের অনেক ব্যবসায়ীরা বিএসটিআইতে প্রথম পণ্য দেওয়ার সময় এক রকম দেয়। আর মার্কেটে দেয়ার সময় নিম্নমানের প্রোডাক্ট দেয়। বিএসটিআই নিম্নমানের প্রোডাক্ট ধরছে, ফাইন করছে লাখ টাকা। কেউ ২০০ কোটি টাকার প্রোডাক্ট বিক্রি করে মাত্র লাখ টাকা জরিমানা দিল, তাতে তো ওই ব্যবসায়ীর খুব একট লস হচ্ছে না।

আমি মনে করি একটু সচেতন কনজ্যুমাররাই ভাইয়া গ্রুপের প্রোডাক্ট ক্রয় করে। আগামী এক মাসের মধ্যে আমাদের রাইস ব্র্যান্ ওয়েল লোকাল মার্কেটে আসবে। রাইস ব্র্যান্ ওয়েল স্বাস্থ্যসম্মত তেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রাইস ব্র্যান্ ওয়েল দিয়ে দেশের তেলের চাহিদা মিটানো সম্ভব। তাহলে সেটা কেন লোকাল মার্কেটে নেই। তাই আমরা আমাদের রাইস ব্র্যান্ ওয়েল লোকাল মার্কেটে নিয়ে আসার কাজ করছি। রাইস ব্র্যান অয়েল ও সয়াবিন তেলের মধ্যে টেস্টে কোন পার্থক্য নেই। একটি পার্থক্য রয়েছে তা হলো রাইস ব্যান্ অয়েল শীতে একটু জমে যায়। আপনারা জানেন নারকেল তেল শীতে জমে যায় কিন্তু গুণগত মান কমে না। এটা রাইস ব্র্যান্ ওয়ালের একটা বৈশিষ্ট্য। শীতে জমে গেলেও গুণগতমান কমে না। রাইস ব্যান্ অয়েলে ভিটামিন ই ন্যাচারালি থাকে। আর অন্যান্য তেলে ভিটামিন ই পুশ করতে হয়। রাইস ব্র্যান অয়েলকে বলা হয় স্বাস্থ্যসম্মত তেল। খুব শীঘ্রই এটা আমরা মার্কেটে আনব ইনশাল্লাহ।

শাখাওয়াত হোসেন মামুন
ভাইস চেয়ারম্যান
ভাইয়া গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ