পুঁজিবাজারের বড় স্টেক হোল্ডার হতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং রাজস্ব বোর্ড

পুঁজিবাজারের অভিজ্ঞ ব্যাক্তিত্ব এস এম নাসির উদ্দিন। স্টারলিংক স্টকস্ এন্ড সিকিউরিটিস লিমিটেডের সিইও’র দায়িত্বে রয়েছেন। দেশের পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা নিয়ে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন আজকের বাজার ও এবিটিভির সঙ্গে। আলোচনার মূল অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি
আমাদের পুঁজিবাজারের বয়স প্রায় অর্ধশত বছর হয়েছে। ১৯৫৪ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ যাত্রা শুরু করে। এই দীর্ঘ সময় অতিক্রম করার পর পুঁজিবাজারের যে রকম টেকসই ভিত্ত্বি পাওয়ার কথা ছিল সেরকমটি হয়নি। আমাদের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে গিয়েছে, আমাদের পুঁজিবাজার সেভাবে এগোতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে আমাদের পুঁজিবাজারে একটি বড় ধরণের পতন ঘটেছে। এরপর ২০১০ সালে এসে হঠাতকরেই বাবল হয়।

যখন পুঁজিবাজার সম্পর্কে মানুষ একটু জানতে শুরু করেছে। একটু দক্ষ হয়ে উঠতে শুরু করেছে তখনই পুঁজিবার বড় ধরণের ধাক্কা খাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, ২০১০ সাল পরবর্তী অনেক কাজ হয়েছে। অনেক ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। এনালগ পদ্ধতি থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে এসেছে। আমাদের সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ অনেক কাজ করে যাচ্ছে। যদিও পুঁজিবাজারকে ঢেলে সাজাতে আরো অনেক কাজ করতে হবে।

নিজের অভিজ্ঞতা
আমি ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারের সঙ্গে যুক্ত হই। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের একটি ব্রোকারেজ হাউজে অথরাইজ হিসেবে চাকরি নিই। একটা স্বপ্ন নিয়ে পুঁজিবাজারের সঙ্গে যুক্ত হই। যদিও সেই স্বপ্নের পুঁজিবাজার আর আজকের পুঁজিবাজার এক নয়। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের উদ্যোক্তাদের মুখে শুনেছি, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের লেনদেন বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে যাবে। কিন্তু এত বছর পরেও দেখছি তার কোনো বাস্তবতা দেখছি না। যদিও এখন আবার পুঁজিবাজার বড় হতে শুরু করেছে। উন্নত হচ্ছে। আশাকরি, একটু দেরিতে হলেও বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। যে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার এত বেড়েছে, যে দেশে প্রযুক্তগতভাবে এত এগিয়ে যাচ্ছে, যে দেশে অল্প সময়ে  সব ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে; সেই দেশের পুঁজিবাজার কোনোভাবেই থেমে থাকতে পারে না। বিনিয়োগকারিদের প্রত্যাশিত স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের জন্য কাজ চলছে। বর্তমান সময়টাকে বলা হয়, স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের গ্রাউন্ড ওয়ার্ল্ড।

পুঁজিবাজারের চ্যালেঞ্জ
পুঁজিবাজার নিয়ে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কাজ করে যাচ্ছে। অনেক পরিবর্তন এনেছে। দিন দিন ভালো উদ্যোগ নিচ্ছে। এরপরও দেখা যাচ্ছে, দ্রুতগতিতে আগাতে পারছে না।  এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ বলতে, ঢেলে সাজানোকেই বলা হয়। আজকের পুঁজিবাজারকে চাইলেই ঢেলে সাজানো সম্ভব নয়। আমার মনে হয়, আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের বড় ধরনের স্টেক হোল্ডার হতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

অর্থনীতির সঙ্গে পুঁজিবাজারের সম্পর্ক
শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশেই অর্থনীতি এবং পুঁজিবাজার একে অপরের পরিপূরক। যে দেশের পুঁজিবাজার যত বেশি টেকসই, মজবুত; সে দেশের অর্থনীতি তত বেশি টেকসই বা মজবুত। আমাদের অর্থনীতি এবং বাজেটের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য এসেছে। দুটিই দিনে দিনে অনেক বড় হচ্ছে। সে তুলনায় পুঁজিবাজারের সাইজ অনেক ছোট। এ সকল দিক চিন্তা করলে অর্থনীতি  এবং পুঁজিবাজারের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। যদিও আমাদের জিডিপি’র হার বেড়েছে ৬.৮। আমাদের বর্তমান অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের অবদান অলমোস্ট ১০ শতাংশ। যেখানে অন্যসকল দেশে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ। তাই পুঁজিবাজারের স্টেক হোল্ডারদের নির্ধারণ করে এটি ঢেলে সাজাতে হবে। শিল্প খাতে পুঁজিবাজারের অবদান কত সেটি দেখতে হবে। শিল্প খাতে পুঁজিবাজারের অবদান মাত্র ১০ শতাংশ। আর টোটাল জিডিপিতে শিল্পখাতে অবদান ৩১.২৮ শতাংশ। এখন শিল্প খাতে পুঁজিবাজারের অবদান বাড়াতে হবে। না হলে, টেকসই অর্থনীতি সম্ভব নয়। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, আমাদের  দেশ এখনো ঋণ নির্ভর অর্থনীতির দেশ। এ থেকে বের হয়ে এসে পুঁজিবাজার অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে।

অর্থমন্ত্রী ইচ্ছে করলে, সরকারি প্রকল্পগুলোয় পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ সম্পৃক্ত করতে পারে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারিরা নির্দিদ্ধায় বিনিয়োগ করতে পারবে। শঙ্কা কমে যাবে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্পগুলো করতে হলে সরকারের সুদ দিতে হচ্ছে। কিন্তু পুঁজিবাজার থেকে টাকা নিলে সরকারের সুদ দিতে হচ্ছে না। ওই প্রকল্পের লভ্যাংশ বিনিয়োগকারিদের দিলেই হবে। এরপর ব্যবসায়ীরাও যদি ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভর না করে পুঁজিবাজার থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে ব্যবসা করতো তাহলে তারাও বেনিফিটেড হতো। পুঁজিবাজারও সমৃদ্ধ হতো।

সরকারের প্রতি পরামর্শ
আমাদের দেশের পুঁজিবাজারকে সমৃদ্ধ করতে সর্বপ্রথম যে জিনিসটি দরকার তা হলো সূক্ষ্ম পরিকল্পনা থাকতে হবে। ন্যূনতম ৫০ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে হবে। আমার নেক্সট জেনারেশনের জন্য আমাকেই পরিকল্পনা করে রেখে যেতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালেই দেখতে পাই, তারা ১০০ টাকা আয় করলেও আগে চিন্তা করে এখান থেকে কত সঞ্চয় করতে পারবে। এটাও পরিকল্পনার ফল। কোনো কিছুই পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের পুঁজিবাজারকে স্ট্রং করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে, পুঁজিবাজারের সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের সমন্বয়ে কাজ করতে হবে।

স্টারলিংকের বিশেষত্ব
স্টারলিংকের মূল ব্যবসা হচ্ছে গার্মেন্টস এন্ড টেক্সটাইল। আর গার্মেন্টস এন্ড টেক্সটাইল সেক্টরে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম সারির রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে স্টারলিংক। সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ যে ১২ টি লাইসেঞ্চ দিয়েছে তারমধ্যে একটি পেয়েছে স্টারলিংক। আমি এখানে যোগদান করার পর থেকে এটাকে নতুন আঙিকে সাজানোর চেষ্টা করেছি। প্রত্যকটি ডিপার্টমেন্টকে নতুন করে সাজিয়েছি। পাশাপাশি কাস্টমারদের সেবা নিশ্চিত করতে সেবা সেল করা হয়েছে। এরপর একটা বিনিয়োগ শিক্ষারও আয়োজন করা হয়েছে। সর্বোপরি কথা হচ্ছে, আমাদের মূল টার্গেট বিনিয়োগকারিদের সেবা নিশ্চিত করা। বিনিয়োগকারিদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে বাজারে সুখ্যাতি অর্জনই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য। ফলে আমাদের ওপর বিনিয়োগকারিদেরও যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। আমাদের বিনিয়োগকারিরা আামাদের জন্যও কাজ করে।

বিনিয়োগকারিদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ
বিনিয়োগকারিদের প্রতি আমার প্রথম পরামর্শ হচ্ছে ধৈর্য্য ধারণ করা। পুঁজিবাজার এমন একটি জায়গা যেখানে ধৈর্যশীলরা তুলনামূলক কম ধৈর্য্যশীলদের টাকা হাতিয়ে নেয়। হুট হাট করেই শেয়ার বিক্রি করলে হবে না। বাজারে দর পতন হতেই পারে তাই বলে অস্থির হওয়া যাবে না। অনেকেই বলেন, দরপতন হচ্ছে বাজারের পিওরিটি। আমারও মনে হয়, বাজারে দরপতন থাকা ভালো। কিন্তু উত্থান এবং পতন কোনোটিই দীর্ঘস্থায়ী হওয়া ঠিক নয়। তাহলে বাজারের বিউটি থাকে না। এজন্য আমরা বিনিয়োগকারিদের প্রতি পরামর্শ দেই, বাজার এবং দর এনালাসিস করুন। প্রয়োজনে আমাদের রিসার্স সেল বা গবেষণা টিমের সহায়তা নেন। আমাদের মূল উদ্দেশ্য, বিনিয়োগকারিদের বাজারে টিকিয়ে রাখা।

নতুনদের উদ্দেশে
বর্তমানে অনেক মেধাবী তরুণ পুঁজিবাজারে কাজ করছে। অনেক ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে পুঁজিবাজারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এটা অবশ্যই ভালো একটা বিষয়। কিন্তু এদের ভালোভাবে ট্রেইনআপ করার জন্য তেমন কোনো ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেনি। হাতে গোনা দু একটা গড়ে উঠলেও মান সম্পন্ন ইনস্টিটিউট এখনো হয়নি। আশাকরি আগামি দুই তিন বছরের মধ্যেই প্রত্যক ইউনিভার্সিটিতে পুঁজিবাজারের ওপর সাবজেক্ট যুক্ত হবে। আমি মনে রি আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের ভবিশ্যৎ উজ্জ্বল। তাই মেধাবিদের আসতে হবে। শুধু সার্টিফিকেটধারী হলে হবে না। সু-শিক্ষিত হতে হবে॥ পুঁজিবাজার সম্পর্কিত জ্ঞান থাকতে হবে। কোম্পানিগুলোর ওপর গবেষণা করতে হবে। এরপর পুঁজিবাজারের সঙ্গে থাকলে এখান থেকে ক্যারিয়ার গঠন করা সম্ভব।

আজকের বাজার: আরআর/ ২৫ মে ২০১৭