পুঁজিবাজারে আসছে মেট্রোসেম সিমেন্ট: শহিদুল্লাহ্

দেশের অবকাঠামো নির্মাণ শিল্পে মেট্রোসেম পরিচিত একটি নাম। বিশ্বমানের স্টিল, সিমেন্ট ও পরিবেশবান্ধব ইট নির্মাণে তাদের সুনাম রয়েছে।  মেট্রোসেম সিমেন্ট ইতিমধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মোবাইল হ্যান্ড সেট ও ইজি বাইক বাজারজাত করার পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ আজকের বাজার ও এবি টিভির সঙ্গে এ শিল্পে নানাদিক নিয়ে কথা বলেছেন। তার সঙ্গে কথপোকথনের চুম্বক অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

রিরোলিং ও স্টিল মিল শিল্প
বর্তমানে বাংলাদেশে ৪২টি রি-রোলিং ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট আছে। আমরা জানি এখনকার বাংলাদেশ একটি দ্রুত উন্নয়নশীল একটি দেশ। এ জন্য শক্তসমর্থ অবকাঠামো তৈরিতে একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে কাজ করছে এটি। টিএমটি, এমএস রড যা ভবন নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে স্টিল বা রড তৈরির জন্য যে ধরনের কাঁচামাল দরকার তা পাওয়া যায় না। রড বা স্টিল তৈরির জন্য এই কাঁচামালের ৮৫ থেকে ৯৫ ভাগ বাইরে থেকে আমদানি করে আনতে হয়। এসব দিয়েই আমাদের সবগুলো কারখানা চালু রয়েছে এবং বিমানের রড উৎপাদন করে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ অটো রিরোলিং এন্ড স্টিল মিলস এসোসিয়েশনের আওতায় যে কারখানাগুলো রয়েছে সেগুলো গুণগতমানের স্টিল তৈরি করে থাকে। দেশের বড় বড় যত অবকাঠামো রয়েছে বিশেষ করে সরকারের মেগা প্রজেক্ট পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পের প্রয়োজনীয় স্টিল তৈরিতে সমর্থ হয়েছি। আমাদের বাৎসরিক সর্বমোট রড উৎপাদনের সামর্থ্য রয়েছে প্রায় ৮০লক্ষ টন। অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রায় ৫০ লক্ষ টন। এই যে অতিরিক্ত ৩০ লক্ষ টন তাও ব্যবহারের মধ্যে চলে আসছে। তাছাড়া শিগগিরই তা উৎপাদন ও বিপনণ  ক্ষমতা ১০০ লাখ টনে চলে আসবে।

স্টিল উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা
মূলত এ সেক্টরে শ্রমিক, বিদ্যুৎ ও টেকনোলজি সহজলভ্য হলেও যাবতীয় র-ম্যাটেরিয়াল ও ক্যামিক্যালের প্রায় ৯৫ ভাগ দেশের বাইরে থেকে  আনতে হয়। সে ক্ষেত্রে আমরা ব্লেড, স্ক্র্যাব,  সিলিকন ক্যামিক্যাল নিয়ে আসি কাঁচামাল হিসেবে। তবে এখন আমারা দেশেই ব্লেড উৎপাদনে সক্ষম হয়েছি।

আমরা কী প্রক্রিয়ায় রড তৈরি করি তা যদি পরিষ্কার করে আপনাদের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারি তা হলে ভোক্তা সাধারণ এ সম্পর্কে বিষদভাবে জানতে পারবে।

আসলে রড তৈরি করা হয় সাধারণত দু’টি ধাপে। প্রথমে স্ক্র্যাবগুলোকে মেল্ট করে ব্লেডের ফর্ম দেয়া হয়। সে ব্লেডকে পুনরায় রূপান্তর করে রড তৈরি হয়। আমাদের দেশে স্টিল মিল ও রি-রোলিং মিল দুটো সেক্টরই উন্নতি করছে। মাত্র দুই বছর আগেও প্রচুর ব্লেড আমদানি করে নিয়ে আসতে হতো রড উৎপাদনের জন্য। এখন তা আর প্রয়োজন হয় না। আমাদের অত্যাধুনিক কারখানা স্থাপনের ফলে আমরাই ব্লেড তৈরি পারছি। এখন আমাদের কেবল মেল্টিং স্ক্র্যাব আমদানি করতে হয়। কিন্ত আমদানিতেও সরকারি শুল্ক ব্যবস্থায় কিছু বাধা রয়েছে। যার সমাধানে শুল্ক হার শূন্যতে নিয়ে আসা দরকার।  আমদানি প্রক্রিয়ার সব জটিলতা সহজ করা উচিৎ। তাতে করে রড উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা আরো বাড়বে। ফলে উৎপাদিত রড অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। আয় করা যাবে বৈদেশিক মুদ্রা।

পহেলা জুলাই বাজেট ঘোষণা করা হলো। আমাদের স্টিল রিরোলিং এসোসিয়েশনের পক্ষে একটাই দাবি ছিল। সরকার চলতি অর্থবছর থেকে যে শতকরা ১৫ ভাগ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করেছে তা সহজবোধ্য নয়। ইতিপূর্বে আমরা শতকরা ৩ ভাগ হারে ভ্যাট দিয়ে এসেছি । আমরা ভ্যাট দিতে আগ্রহী, আমরা ভ্যাটের বিপক্ষে না। যদি শতকরা ১৫ ভাগ হারে ভ্যাট দিতে হয় তাহলে এর প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর। আমাদের যেহেতু প্রচুর সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কাজ হচ্ছে, শিল্প-কারখানা, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, কনস্ট্রাকশন কাজ, ব্রীজ, বড় বড় ভবন নির্মাণ হচ্ছে। আপনারা জানেন আমাদের দেশের এক কোটি বিশ লক্ষ লোক দেশের বাইরে কাজ করে বৈদেশিক রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে। সে লোকগুলো প্রত্যন্ত গ্রামের সহজ সাধারণ লোক। তাদের একটা স্বপ্ন থাকে যে বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা দিয়ে দেশে তাদের বাবা মায়ের জন্য একটা বাড়ি নির্মাণ করবে। আগে যেখানে টিন, শনের কাঁচা বাড়ি দেখা যেত এখন সেখানে পাকা দালান বাড়িই লক্ষ করা যায়। দিনকে দিন তা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তা ছাড়া আমরা যারা ঢাকা কেন্দ্রিক, তারা নিজের একটা ফ্যাটের জন্য রিহ্যাব বা ডেভেলপারের উপর নির্ভর করে থাকি। ডেভেলপররা ঢাকা থেকে বিভাগীয় শহর, এমনকি জেলা পর্যায়ে তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে। তারা আমাদের অন্যতম স্টেক হোল্ডার। সে-সব নির্মাণ ক্ষেত্রে রড ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাই করা যায় না। এর মধ্যে যদি ১৫ ভাগ ভ্যাট আরোপ করা হয় তাহলে হুট করে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়বে। আর এ জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে সাধারণ ক্রেতা আর সরকারকে। কারণ দেশের ৩০ ভাগ রড সরকার তার বিভিন্ন কাজের জন্য ক্রয় করে থাকে। ফলে নির্মাণ শিল্পের সাথে যারা জড়িত প্রত্যেকের ওপর ভ্যাটের প্রভাব পড়বে।

এসব কারণে আমাদের পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব ছিল যে, ভ্যাট যেন শতকরা ৫ ভাগের ওপরে না যায়। ভ্যাট দিতে আমরা প্রস্তত, আমরা ভ্যাট দিতে চাই। দেশের উন্নয়নে আমরাও অংশ নিতে চাই কিন্তু এভাবে না, ধারাবাহিকভাবে। হুট করে ভ্যাটের হার এতোটা বৃদ্ধি করলে এর প্রভাব গিয়ে পড়বে সরকার, ব্যাবসায়ী ও জনগণের উপর। তাই সরকারের কাছে বিশেষ অনুরোধ, আমাদের এই সেক্টরের উন্নয়নের স্বার্থে এভাবে ভ্যাট না বাড়িয়ে ধারাবাহিক ভাবে বাড়ালে সবার জন্য উপকার হবে।

মেট্রোসেম গ্রুপের বিজনেস 

মেট্রোসেম গ্রুপ সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে কাজ করে। আমরা সিমেন্ট উৎপাদন করি, বিশ্বমানের টিএমটি রড উৎপাদন করি, পরিবেশ বান্ধব ইট তৈরির প্রতিষ্ঠানও আমাদের আছে। সিমেন্ট, রড ও ইট এই তিনটাই আমরা তৈরি করি। সিমেন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে গেছে। আমরা এখন সিমেন্ট রপ্তানি করতে পারি। গুণগত মানের জন্য প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পরিমাণ বেশি সিমেন্ট আমরা রপ্তানি করেছি। আমাদের উৎপাদিত রড দিয়ে আপনি যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবেন। গুণগতমানের কারণে আমাদের রড সারা দেশের ব্যাবসায়ীরা নিচ্ছেন। নিচ্ছেন আগ্রহের সঙ্গেই। আমাদের ইট উৎপাদনের আগেই বিক্রি হয়ে যায়।

আমরা যারা ‘বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং এসোসিয়েশনের’ সদস্য আমরা কখনোই আমাদের পণ্যের গুণগত মানের ব্যাপারে আপোস করি না। আমাদের সদস্য হতে গেলে অবশ্যই সিমেন্টের মানের দিকটা মাথায় রেখে তারপর আসতে হবে। একই রকম নিয়ম ‘বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং এন্ড স্টিল মিলস্ এসোসিয়েশনের’ বেলায়ও প্রযোজ্য।

আপনাদের মিডিয়ার মাধ্যমে ভোক্তা সাধারণকে একটা ম্যাসেজ দিতে চাই, ‘আমরা যারা এই এসোসিয়েশনের মধ্যে আছি। এবং আমাদের উৎপাদিত সব ধরনের পণ্য অবশ্যই মান সম্পন্ন’।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
২০২০ সালের মধ্যে উৎপাদনক্ষমতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সারাদশের ৬৪ জেলায় আমাদের পণ্য বিপনণের ব্যবস্থা আছে। এর বাইরে বিদেশে আরো বেশি পরিমাণে রপ্তানির পরিকল্পনা নিয়েছি। আমাদের ব্র্যান্ড ও ইমেজকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কারণ আমরা একদিনের জন্য আসিনি, দীর্ঘদিনের পরিকল্পনামতো কাজ আমরা আজ এখানে আসতে পেরেছি। তাই রড, সিমেন্ট আর ইটের মানকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। মাটির বিকল্প দিয়ে ইট তৈরির পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।  সেভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

এ ছাড়া আমরা টাইল্স উৎপাদনের দিকে যাচ্ছি। অত্যাধুনিক মেশিন সমৃদ্ধ কারখানায় উন্নতমানের টাইল্স উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগিয়ে  যাচ্ছি।

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এগুলো আমাদের মৌলিক চাহিদা। আর বর্তমানে এর সাথে জড়িয়ে আছে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজ যোগাযোগ। সে কথা মাথায় নিয়েই আমরা বাজারে আনতে যাচ্ছি মেট্রোসেম মোবাইল ফোন। সহজ যাতায়াত ও ঢাকা শহরের জ্যামের কথা চিন্তা করে আমরা ইজি বাইক নিয়ে আসার কথাও ভাবছি। অচিরেই আমরা সারাদেশের জন্য ইজি বাইক বাজারজাত শুরু করবো। যার মূল্য হবে সাধারণের হাতের নাগালের মধ্যেই। যেটি শব্দ দূষণ  করবে না, পরিবেশের ক্ষতি করবে না। সর্ব সাধারণের উপকারে আসবে।

পুঁজি বাজারে আসছে মেট্রোসেম
আমাদের সিমেন্ট গুণগতভাবে ভালো হওয়ার কারণে দেশে-বিদেশে সবার কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পাশাপাশি সারাদেশে চাহিদা বাড়ছে। বলা যায়, উৎপাদনের দিক দিয়ে আমরা এখন একটা ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখন আমরা চিন্তা করছি মেট্রোসেম কোম্পানি তার সিমেন্ট নিয়ে পুঁজিবাজারে আসুক । মেট্রোসেম পুঁজিবাজার থেকে অর্থ নিয়ে অন্য কিছুতে বিনিয়োগ করবে এই দর্শনে বিশ^াস করে না। আমরা এখান থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাবো তা বাড়তি সিমেন্ট উৎপাদনের পিছনে ব্যয় করবো। সিমেন্ট এমন একটি পণ্য যার চাহিদা দিন দিন বাড়ছেই।

মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ্
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মেট্রোসেম গ্রুপ

আজকের বাজার:সালি/ আরআর/ ১ জুন ২০১৭