পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের অভাব রয়েছে-দেওয়ান নুরুল ইসলাম

আমাদের অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা : আমাদের সার্বিক অর্থনীতির কথা বললে আমি বলবো, এখন সার্বিক অবস্থা খুবই ভালো। এটা খুবই অ্যানকারেজিং এবং জিডিপি ইজ গ্রোইং। অনেকগুলো অর্থনৈতিক সূচকের ক্ষেত্রে আমরা বেশ এগিয়ে আছি। আমাদের এচিভমেন্ট অনেক ভালো। এর প্রমাণ হচ্ছে জিডিপি গ্রোথ। বিশে^ যে ক’টা দেশ এখন জিডিপির দিক থেকে এগিয়ে আছে তার মধ্যে আমরা অন্যতম। আমরা এখন প্রায় ৭ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি পাচ্ছি, এটি কিন্ত সহজ নয়, কঠিন কাজ। এটাই আমাদের বড় অ্যাচিভম্যান্ট। একে ধরে আমাদের শতকরা ৮ ভাগের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আর এটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য একমাত্র রাস্তা হলো আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধি। ভিশন ২০-২১ সামনে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ২১ সালের মধ্যে কম করে হলেও ৫৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে হবে। যেখানে আমরা এখন ৩৬ বিলিয়ন পর্যন্ত করতে পারছি। একথা বলতে হচ্ছে যে, গত বছর বা এর আগের যে রপ্তানির উর্ধ্বগতি ছিল তা অনেকটা থমকে গেছে। এর অন্যতম কারণ হলো, দেশের টেক্সটাইলের গ্রোথ অনেক কম হচ্ছে। এখানে বলা প্রয়োজন, আমরা বিশে^ দ্বিতীয় টেক্সটাইল উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশ। চায়নার পরেই আমাদের অবস্থান। তাদের সাথে আমাদের অনেক গ্যাপ রয়েছে। আমাদের ঠিক পরেই রয়েছে ভারতের মতো বৃহৎ একটি দেশ। তার পর ভিয়েতনাম ও অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো। আমাদের এই অগ্রযাত্রা চালিয়ে নিতে টেক্সটাইলের গ্রোথ দ্রুত গতিতে বাড়াতে হবে ।

এর জন্য ভ্যালু এডেড আইটেমের দিকে যেতে হবে এখন। আমাদের ভ্যালু বাড়ছে, তবে তার তুলনায় রপ্তানি আইটেম ও এমাউন্ট বাড়ছে না। এসব কারণে আমরা মিড বা লো লেভেলের আইটেমগুলোতে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। আরেকটা হচ্ছে, আমাদের রপ্তানি ব্যবসায় ও পণ্যের ডাইভারসিফিকেশন দরকার। যে খাতগুলোতে আমাদের সম্ভাবনা রয়েছে সেদিকে নজর দিতে হবে। যেমন এর একটা হচ্ছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। আমরা জানি বিশ্বে এই পণ্যের মার্কেট রয়েছে তিনশ বিলিয়ন ডলারের। এই পণ্যের শতভাগ কাঁচামাল কিন্ত আমাদের দেশে পাওয়া যায়। এ খাতকে যদি আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি তাহলে এখান থেকে ৩ থেকে ৪ বছরে, ৫ মিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভবব। যেখানে ভারত করছে ১৫ মিলিয়ন ডলার। আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য গুণগতমানের দিক দিয়ে বিশে^ দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। এটা আমাদের জন্য বিশাল একটা ব্যাপার। সারা বিশে^ আমাদের এই চামড়ার অনেক পরিচিতি ও কদর রয়েছে। আর এই সব সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় নিয়ে আমরা হাজারিবাগের সকল ট্যানারিকে সাভারে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্থানান্তর হলেও পুরোপুরি যে লজিস্টিক সাপোর্ট রয়েছে সেটা এখনও দেয়া সম্ভব হয়নি। এখনও শোধন প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি করা সম্ভব হয় নি। দ্রুত এর সমাধান না করলে এর চারপাশের কৃষি জমিগুলো বুড়িগঙ্গার পানির মতো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তা ছাড়া যারা চামড়া ব্যবসায়ী এবার তারা মূলধনের অভাবে চামড়া কিনতে পারেনি। ফলে এই সব সমস্যার সমাধান করাও জরুরি। তাহলেই আমরা আমাদের সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যেতে পরবো। না হলে এই পণ্য চলে যাবে পাশের দেশ ভারতে। তারা তখন এগিয়ে যাবে। যেহেতু তারা আমাদের প্রতিযোগী, আমাদের সমস্যার কারণে সঠিক উদ্যোগের অভাবে আমাদের সম্পদ তারা ব্যাবহার করে আমাদের চাইতে এগিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য এখন সময় হয়েছে যে লেদার ও ফুটওয়্যারের দিকে সময় দেয়ার। এবং ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ৫ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করা প্রয়োজন। সেটা যদি করা যায় তাহলে অন্যান্য সেক্টর মিলিয়ে ৫৫ মিলিয়নের যে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা ২০২১ সালের মধ্যে আমরা অর্জন করতে পারবো।

জিএসপি সমস্যার সমাধান: এটা আসলে একটা দ্বৈত সমস্যা। এর সমাধানের জন্য শিল্প সহায়ক একটা বার্গেনিং এজেন্টের মাধ্যমে কাজ করা হচ্ছে। কাজ অনেকটাই ফলপ্রসূ। এখানে আবার অনেক যুক্তিসংগত কারণও থেকে থাকে। তারা বিভিন্ন সমস্যা হলে সমাধানের জন্য আসে। এখানে বলে রাখা ভালো, যারা চালিকা-শক্তি তারা আসলে মূল নয় এখানে মূল হলো ম্যনেজম্যন্ট, বটম টু আপ। যে আইডিয়া আসে একজন শ্রমিক লেভেল থেকে সেখান থেকে ধারাবাহিকভাবে সবার কাছেই আমাদের যেতে হচ্ছে। এখন সেখানে তাদের কাছে কোনও একটা অন্যায় আব্দার করলাম সেটা কিন্ত হবে না। তাদের নিয়মে অনেক টাইট মার্জিনে কাজ করতে হয়। কিন্ত আমরা সেটা করছি কতটুকু? আমাদের শ্রমিক, ব্যবস্থাপনা, মালিকপক্ষ কেউই সেটা বুঝতেই পারি না। আমাদের সেটা বুঝতে হবে। এ জন্য আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারেরও ভূমিকা রয়েছে। আবার যারা মালিক, শ্রমিক, ব্যবস্থাপনার সাথে সমন্বয় করে থাকেন তাদেরও কিন্ত এখানে বিশাল ভূমিকা রয়েছে। যার মাধ্যমে সর্বত একটা শিল্প সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

পুঁজিবাজারের সমস্যার ব্যাপারে: আমাদের পুঁজিবাজার আসলে অনেক বড় কোনও বাজার নয়। এই বাজার অনেক বড় হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সে অনুযায়ী বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের অভাব রয়েছে। যারা আসলে প্রকৃত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে সহনীয় মূল্য যখন হয় তখনই তারা ক্রয় করে বিনিয়োগে সেটা রাখে। ধীরে ধীরে যখন কোম্পাািনটা গ্রো করে তাদের আয়টাও তখন আসে। আমাদের স্বল্প সময়ে বেশি রিটার্ন পাবার একটা প্রবণতা রয়েছে, যা অনেকের মধ্যে বেশি। যাকে বিনিয়োগ না বলে ট্রেডিং বলা উচিত । এখানেই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, এখানেই কিন্ত নয়েজটা আসে। যেসব শেয়ার ভালো সেগুলো কিন্ত এমন নয়। বরং যে সব শেয়ার স্ট্রং নয়, যেসব দীর্ঘমেয়াদি শেয়ার নিশ্চিত নয় বা সেটা ঠিকমতো ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় সেইসব শেয়ার কিন্ত স্থায়ী শেয়ার নয়। দেখবেন এসব শেয়ার অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত বাড়ছে বা কমছে। আর প্রতিনিয়ত সে পথেই ধাবিত হচ্ছে সবাই ।

ব্যাংকে নতুন নিয়ম, ভালো-মন্দ: যদি এমন হতো যে এক পরিবার থেকে তিন চারজন আসছে, আসার পর আপনার প্রপার গভর্নন্যন্সটা নিশ্চিত হচ্ছে, তাহলে এই ইস্যুটা আসত না। ব্যাংক তো এবটা ব্যবসা, সেখানে যারা বিনিয়োগ করেছেন তাদের পরিবার থেকে তারা আসবেন কি আসবেন না, এই প্রশ্নই আসত না যদি না সেটা ঠিকমতো পরিচালিত হতো! সেখানে আমাদের একটি সমস্যা আছে। দেখা গেছে যে অনেক ব্যাংকের মধ্যে সচ্ছ ও ওয়েল গভার্ণ নেই। এখানে আবার ৬ বছরের পরিবর্তে ৯ বছর মেয়াদের কথাও বলতে হয়। আগের ব্যাপারটা কিন্ত খুব খারাপ ছিল না। এখানে যদি দীর্ঘসময় কেউ নেতৃত্ব দেন, তাহলে নতুন নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সেটা বাধা হতে পারে। বুঝতে হবে ৯ বছর কিন্ত কম সময় নয়। আর একই পরিবারের চারজনের ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা আসছে সেটা হলো, এভাবে আসলে তো দেখা যাবে যখন সেলিং তখন চারজন- চারজন করে হয়ে যাচ্ছে। যে চারজন আসছেন তারা কেমন, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন, তাদের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না এটা দেখার দায়িত্ব এখন সেন্ট্রাল ব্যাংকের। আইন হলেই যে চারজন কে যেতে হবে এমন কিন্ত নয়। তাদের চারজন বা দুইজন বা একজনও ব্যাংকে আসতে পারেন যদি ব্যাংক প্রয়োজন মনে করে। এক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয়তা, যোগ্যতা থাকতে হবে।

এই নিয়মে পুঁজিবাজারে কেমন প্রভাব পড়বে: পুঁজিবাজার কিন্ত রেগুলেটেড সেক্টর। যেখানে সেন্ট্রাল ব্যাংক রয়েছে, অন্যান্য ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানগুলোও লিস্টেড। আরও আছে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন, ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ, সরকারি ব্যাংকের মালিক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় রয়েছে। সবমিলিয়ে এটি একটি রেগুলেটেড সেক্টর। এখানে যদি সবগুলো রেগুলেটেড প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো কাজ করে, তাহলে সেখানে প্রকৃত যে ফল সেটাই প্রতিফলিত হবার কথা। এবং এই ব্যাপারটা পুঁজিবাজারে হওয়াই উচিত। একটা প্রতিষ্ঠানের যে মূল্য হবে, কিংবা যে ভ্যালু হবে, সেটা হবে ওই প্রতিষ্ঠানের স্ট্রেন্থ অনুযায়ী।

আমাদের প্রতিষ্ঠান কী কাজ করে: আমাদের এই ‘গ্রান্ড থন টন’ প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর অন্যতম একটা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। যেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে কার্যক্রম চলে, আর সেই সব প্রকল্পে যারা ডোনার ও পার্টনার যেমন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এশিয়ান ডেভলপম্যান্ট ব্যাংক, ডিএফআইডি, ইউএসআইডি। তাদের কাজের পর্যবেক্ষণ করি আমরা। কাজের শুরুতে, মধ্যবর্তী সময়ে, এবং শেষের দিকে তাদের কাজের রিভিউ করি। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন-পরামর্শক হিসেবেও আমরা কাজ করছি। স্কিল ডেভলপম্যান্ট, ন্যাশনাল ইকোনোমি,সোশ্যাল ইকোনোমিসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে আমরা বিশ^মানের পরামর্শক হিসেবে কাজ করি। এটা একটা বাংলাদেশি কোম্পানি, যদিও এটি বিশ^মানের একটা প্রতিষ্ঠানের মেম্বার ফার্ম। এ ছাড়া আমরা স্থানীয় রিসোর্সকে কাজে লাগিয়ে পথ চলছি। যাদের আমরা বিভিন্ন প্রজেক্টের তদারকির কাজে নিয়োগ করি তাদের সবাই কিন্ত আমাদের দেশীয় রিসোর্স। এতে করে আমাদের এখানেই ক্যাপাসিটি বিল্ড আপ হচ্ছে। আর যে সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের মাধ্যমে এডভাইস করা হয় তারাও এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের রিসোর্সরাও তাদের কাজের মাধ্যমে নিজেদের আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করার একটা সুযোগ পাচ্ছে।

দেওয়ান নুরুল ইসলাম এফসিএ
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, গ্র্যান্ড থন টন