পুঁজিবাজার সাপোর্ট পেলে জিডিপি ৯% ছাড়াবে

মো. আবদুল মুকতাদিও, সিএফএ
বর্তমান পুঁজিবাজারের অবস্থা বেশ ভালো। আমাদের ইকোনোমি এখন একটি ট্রানজিশন পিরিয়ডের মধ্যে আছে। আমার গরিব রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিলাম। এখন সেখান থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটেছে। এখন আমরা নিম্ন মধ্য আয়ের রাষ্ট্রে প্রবেশ করেছি। দেশে অর্থনীতির পরিসর বাড়ছে। একইসঙ্গে মানুষের পারচেজ প্র্যাকটিস পাওয়ার বাড়ছে। আগে অর্থনীতি চর্চায় শুধুমাত্র ব্যাংক কেন্দ্রিক চিন্তা করা হতো। অধিকাংশ মানুষ ফিক্সড ডিপোজিট করতেন। দু’একজন জমিতে বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু এখন মানুষ বিকল্প খুঁজছে। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে ব্যাংকের ইন্টারেস্ট কমে গেছে। এখন কিন্তু ৫-৬ শতাংশের কম ইন্টারেস্ট দেয় এরকম ব্যাংকের সংখ্যা কম। যেখানে আমাদের ইনফ্লেশন রেট, প্রায় ৭ শতাংশ। রিয়েল টাইমে যদি কেউ ব্যাংকে ডিপোজিট রাখে তাহলে কিন্তু লস হচ্ছে না। আর রিয়েল স্টেটের অবস্থা গত কয়েকবছর বেশ খারাপ গেছে। গত ৫-৭ বছরে ফ্ল্যাটের দাম কমেছে, জমির দাম কমেছে। এতে মানুষের যে ধারণা ছিল- ‘জমির দাম কখনও কমে না’ সেটি চেঞ্জ হয়েছে। এবার দেখুন, যদি কেউ ৮০ লক্ষ বা ১ কোটি টাকা ব্যয় করে একটি ফ্ল্যাট কিনে তাহলে তার মাসিক আয় ট্যাক্স বাদ দিলে ২০ হাজারের মতো থাকবে। যেটি ব্যাংক ইন্টারেস্টের চেয়েও কম। এটা অন্যভাবে কভার করতে হলে ক্যাপিটাল গেইন থাকতে হবে। কিন্তু এ সকল ক্ষেত্রে আমাদের ক্যাপিটাল গেইনের পরিবর্তে লসই হচ্ছে। আমাদের দেশে একটি বড় সুবিধার জায়গা হচ্ছে, শেয়ার মার্কেট।

এখন কিন্তু এখানে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। ২০১০ সালের ধসের পরে কিন্তু অধিকাংশ কোম্পানিরই শেয়ার মূল্য যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এসব জায়গায় যদি বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে বড় ধরনের একটা গেইনের সুযোগ থাকে। এজন্য মানুষ এখন ক্যাপিটাল মার্কেটের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে। আমরা দেখেছি গত ২/৩ বছর আগে ডেইলি ২০০/৩০০ কোটি টাকা টার্ন ওভার করতো। সেখানে এখন নিয়মিত ৮০০ কোটি টাকা টার্নওভার হচ্ছে। কোনো কোনোদিন এক হাজার কোটি টাকাও টার্নওভার হচ্ছে। জানুয়ারিতেও আমরা দেখেছি দুই হাজার কোটি বা ১৫০০ কোটি টাকা টার্নওভার হয়েছে। মাঝে কিছুদিন মার্কেটটা খারাপ গেছে। আবার রিভাইবও করছে। আশা করি সামনে এভাবে চলবে। এখন যে মাঝে মধ্যে ছোট আকারে মার্কেট ফল করে এর পেছনে ব্যাংকের অনিয়ম থাকে। গত কয়েকদিন আগেও ৭টি ব্যাংককে পুঁজিবাজারে অনিয়মের অপরাধে জরিমানা করা হয়েছে। যদিও জরিমানার অংক বেশি না। পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থায় আমার মনে হচ্ছে না, আর কোনো বড় ধরনের সমস্যা হবে। পণ্যের যেহেতু ওভার অল গ্রোথ আছে, আমাদের রিয়েল জিডিপি’র গ্রোথ আছে, ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপ হচ্ছে। আগামিতে সরকার থেকে ঠিকমত সাপোর্ট দিলে জিডিপি ৮ বা ৯ শতাংশ, ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।

যদিও আমরা বলি, মার্কেটে ৩৩ লক্ষ একাউন্ট আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, জ্জ লক্ষ একাউন্টের বেশি সক্রিয় নেই। আমাদের দেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এটা কিন্তু বাড়ার অনেক সুযোগ আছে। জনসংখ্যার হিসেবে আমাদের এখনও ৪ কোটি ইনভেস্টর বাড়ার সুযোগ আছে। ৪ কোটি না হোক ১ কোটি তো হবে। কিন্তু আমাদের বিনিয়োগকারী আছে মাত্র ৩/৪ লক্ষ। এখনও যারা ব্যাংকে টাকা রাখছে বা অন্য জায়গাগুলোতে বিনিয়োগ করছে তারা যদি মার্কেটে আসে তাহলে কিন্তু মার্কেটে বড় ধরনের গ্রোথ আসবে। এক্ষেত্রে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যেন মার্কেট ওভারভ্যালুড না হয়ে যায়। এজন্য আমাদের করণীয় হচ্ছে, মার্কেটের সাপ্লাই ঠিক রাখা। একইসঙ্গে নতুন নতুন কোম্পানি নিয়ে আসতে হবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমাদের লিস্টেড কোম্পানি খুব কম। টোটাল হিসাব করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে ১০ হাজার বা ২০ হাজার ভালো কোম্পানি আছে। এরমধ্যে পুঁজিবাজারে লিস্টেড ৪০০ কোম্পানিও নেই। এখান থেকে যদি আমরা ১০ শতাংশ কোম্পানিও লিস্টেড করাতে পারি তাহলে কমপক্ষে আরো ২/৩ হাজার কোম্পানি লিস্টেড হবে। ইনভেস্ট করার জায়গা বৃদ্ধি পাবে। আমরা ওটা করতে না পারলে আবার দেখা যাবে আামাদের মার্কেটটা অতিমূল্যায়িত হচ্ছে। আর অতিমূল্যায়িত হওয়ার পরে দেখা যাবে আরেকটা ক্র্যাশ হতে পারে। নেয়ার ফিউচার হবে, এমন কোনো আশা করছি না। তবে শঙ্কা থেকে যায়।

মার্কেটের চ্যালেঞ্জ : চ্যালেঞ্জ বলতে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন, বর্তমানে বলতে গেলে গুজব নির্ভর মার্কেট চলছে। বিনিয়োগকারীরা শুনে শুনে বিনিয়োগ করছেন্ ।তবে এগুলোর বিরুদ্ধে আমরা জনসচেতনতা গড়ে তুলতে পারছি না। আমরা কিন্তু মানুষকে নির্লিপ্ত করতে পারছি না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের জ্ঞানের অভাব। আমরা পর্যাপ্ত পড়াশোনা না করেই বিনিয়োগ করতে চাই। না জেনে, না বুঝে যারা বিনিয়োগ করে তাদের সচেতন করার লক্ষ্যে সম্প্রতি বেশ কিছু বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে। তারপরও অনেকে না বুঝেই বিনিয়োগে উৎসাহী। আমরা পরিচিত কারও কাছে জিজ্ঞাসা করি ভাই কী শেয়ার কিনব? সে যে মত দেন আমরা তার মত অনুযায়ী শেয়ারটি কিনি। এখানে সে কতটুকু অভিজ্ঞ সে খব্র নেই না। বা সে কতটুকু মার্কেট এক্সপার্ট সে খবর রাখি না।
আমাদের পুঁজিবাজারে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, ইনসাইডার ইনফরমেশন। যাকে আমরা পিএসআই বা প্রাইস সেনসেটিভ ইনফরমেশন বলি। এ বিষয়টি ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডেও বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। আপনি যখন ইনসাইডার ইনফরমেশন নিচ্ছেন, তখন কিন্তু অন্যদের থেকে বেশি অ্যাডভান্টেজ নিচ্ছেন। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বঞ্চিত হচ্ছে। বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন তারা ।
আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, আমাদের কোম্পানিগুলো যে ইপিএস বা আর্নিং পার শেয়ার, কোয়াটারলি পাবলিশ করছে এগুলো আনঅডিটেড। ইপিএস আমরা মানুষকে দেখাচ্ছি, এই বছর আমার কোম্পানি এতটাকা লাভ করেছে বা এই কোয়াটারে লাভ করেছে। কিন্তু পরের কোয়াটারে গিয়ে সেটা কমিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। বা আর্নিং বেশি হওয়া সত্ত্বেও ইপিএসটা বেশি না দেখালেও পারছি। যখন আর্নিং কম হচ্ছে তখন বেশি দেখানো এবং যখন আর্নিং বেশি হয় তখরন কম দেখানোর সুযোগ থাকে। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হচ্ছে, কোয়াটারলি যে ইপিএসগুলো দেখানো হয়, সেগুলো অডিটের আওতায় আনলে ভালো হবে। এছাড়া আমাদের অডিটরদের কোয়ালিটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যদিও এখন এসইসি একটা প্যানেল করে দিয়েছে। সেখানে নির্দিষ্টসংখ্যক অডিটর রয়েছে। আবার কোনো কোনো জায়গায় কোম্পানিগুলো ম্যানুপুলেশন করছে। এ কারণে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ আছে। বিনিয়োগকারীদের এখনও বলতে শুনি, কোম্পানি যা তথ্য পাবলিশ করে সেগুলো কতটুকু সত্য? এ নিয়েও চলে নানা গুঞ্জন। এ জন্য আমাদের রেগুলেটরদের সতর্ক থাকতে হবে। এক্ষেত্রে অডিটরদের মধ্যে যদি বড় ধরনের অনৈতিক কিছু পাওয়া যায় এবং তাদের যদি বিচারের আওতায় আনা যায়, তাহলে আর অডিটের কোয়ালিটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকবে না।

অন্যান্য দেশের কোম্পানিগুলো যখন আর্নিং ডিসক্লোজ করে, তখন কোম্পানির ডিটেইল প্রেজেন্ট করে। তারা জানায়, এসব কারণে আমার কোম্পানির ভালো হয়েছে বা এইসব কারণে খারাপ হয়েছে। আমাদের বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞরা ইচ্ছে করলে, আমাদের কোম্পানিগুলোর কাছেও এসব বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। আমাদের দেশে এমন প্র্যাকটিস নেই বললেই চলে। দু’একটা কোম্পানি যেমন- ব্র্যাক ব্যাংক, গ্রামীণ ফোন, আইডিএলসি একটু ব্যতিক্রম। এরা বাদে অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না।
সমস্যাগুলোর সমাধান হলে পুঁজিবাজারে অবস্থা কী হতে পারে : এখন যেমন অনেকেই মার্কেটের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন করে। এসব সমস্যার সমাধান হলে, প্রশ্নগুলো করার সুযোগ থাকবে না। এতে লোকাল বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ বাড়বে। একইসঙ্গে স্থায়ী বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকেও বড় অংকের বিনিয়োগ আসবে। তখন কিন্তু আমাদের মার্কেটের অবস্থা এমন থাকবে না। আরো ভালো হবে। মার্কেটের প্রতি মানুষের আস্থাও বাড়বে।

মোঃ আবদুল মুকতাদির, সিএফএ
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), পিএলএফএস ইনভেস্টমেন্টস লিঃ