প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে ভরসা ‘প্রশ্নব্যাংক’

রাসেল মাহমুদ: প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রায় সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিব্রত শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। কী করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে তাই এখন প্রধান আলোচ্য। সত্যিই বুঝি এবার মুক্তি মিলবে অভিশপ্ত এই বিপদ থেকে। ধারণা করা হচ্ছে, এই অভিশাপ মুক্তির ত্রাতা হবে ‘প্রশ্নব্যাংক’।

জানা গেছে, প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে নতুন পথে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর নতুন এই পথটি হলো ‘প্রশ্নব্যাংক’। যার মাধ্যমে এখন থেকে প্রশ্ন তৈরি করে স্কুলে পাঠানো হবে। সেই প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আর প্রশ্নব্যাংক তদারকির দায়িত্বে থাকবে শিক্ষা বোর্ডগুলো। আর বিষয়টি পরীক্ষামূলক চালু করতে মাধ্যমিক স্তরকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। ফলে এ স্তরের অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষায় প্রশ্ন নির্বাচন করা হবে প্রশ্নব্যাংক থেকে।

শিক্ষামন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশ্নফাঁস ও মুখস্থ বিদ্যার প্রবণতা কমাতে ভূমিকা রাখবে এই পদ্ধতি। মুখস্ত শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনা, কোচিং-প্রাইভেট ও নোট-গাইড বন্ধ করতে ২০০৫ সালে চালু করা হয় সৃজনশীল পদ্ধতি। শিক্ষকদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে সরকার শত কোটি টাকা খরচ করেও কাক্সিক্ষত ফল পায়নি। শিক্ষকরা ঠিকমতো না বোঝায় তারা ক্লাসে ভালোভাবে পড়াতে পারছেন না।

সরকারি এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ২০০৫ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হলেও ১২ বছরে মাত্র ৫৬ শতাংশ শিক্ষক বিষয়টি আয়ত্ত করতে পেরেছেন। অপর দিকে শিক্ষকরা যাতে পদ্ধতি বুঝতে পরিশ্রম করেন, সে জন্য স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্ন বাইরে থেকে না কেনার নির্দেশনা ছিল। এ ব্যাপারে পরিপত্রও জারি করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু পদ্ধতি না বোঝায় অনেক শিক্ষক তা মানছেন না। তারা বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক সমিতি থেকে প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা নেন। স্কুল-কলেজ তো বটেই, পাবলিক পরীক্ষায়ও নোট গাইড থেকে প্রশ্ন তুলে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে প্রতি বছর।

শিক্ষার্থীরা আগে এক কোম্পানির গাইড কিনলেও এখন সৃজনশীল প্রশ্নের বেশি উদ্দীপক পাওয়ার আশায় একাধিক কোম্পানির গাইড কিনছে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া শ্রেণিকক্ষের পরিবর্তে কোচিং সেন্টার নির্ভর হয়ে পড়েছে। শিক্ষকরা এই পদ্ধতি না বোঝায় বাণিজ্যিক কোচিং প্রত্যন্ত এলাকার অলিগলিতে পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসাও জমজমাট হয়েছে। গণসাক্ষরতা অভিযানসহ (ক্যাম্পে) বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষায়ও এসব তথ্য উঠে এসেছে। এরপরই টনক নড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এ সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) নেতৃত্বে যশোর শিক্ষাবোর্ডের তত্বাবধানে তৈরি করা হয় প্রশ্ন ব্যাংক। যার প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিচ্ছে ভারতীয় একটি আইটি কোম্পানি।

যশোর শিক্ষাবোর্ড জানিয়েছে, ২০১৫ সালের মে মাসে অনলাইন প্রশ্নব্যাংক তৈরির কাজ শুরু হয়। গত বছরের মার্চ মাসে অনলাইন প্রশ্নব্যাংকের সফটওয়্যার পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। এ বছর বোর্ডের অধীন সকল স্কুলের নবম শ্রেণির বার্ষিক ও এসএসসির টেস্ট পরীক্ষা প্রশ্নব্যাংক থেকে হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে ২০ থেকে ২২ জন মাস্টার ট্রেইনার শিক্ষক রয়েছেন।

সূত্র আরও জানায়, প্রতিটি স্কুলে প্রশ্ন আপলোড করার প্যানেল থাকবে। প্রধান শিক্ষক হবেন প্যানেল প্রধান। তিনি ঠিক করে দেবেন, কোন শিক্ষক কোন বিষয়ের প্রশ্ন সফটওয়ারের আপলোড করবেন। শিক্ষর্থীদেরও প্রশ্ন তৈরির সুযোগ রয়েছে। কোনো শিক্ষার্থী প্রশ্ন আপলোড করতে চাইলে প্রধান শিক্ষক সুযোগ করে দিবেন। মানসম্পন্ন প্রশ্ন না হলে সফটওয়্যার প্রশ্ন আপলোড নেবে না।

প্রশ্নব্যাংকের ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, শিক্ষাবোর্ডের অধীন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের বাধ্যতামূলকভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠপুস্তক বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী প্রশ্নপত্র তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই পরীক্ষার ফলাফলকে শিক্ষার মূল্যায়ন মনে করছেন। এ জন্য শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই বাদ দিয়ে গাইড বা নোটবই মুখস্থ করে ভালো ফলাফলের চেষ্টা চালাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল হওয়ার পরিবর্তে মুখস্থনির্ভর হয়ে পড়ছে। শিক্ষকেরাও নিজেরা প্রশ্ন না করে গাইড বই, শিক্ষক সমিতি বা বিভিন্ন প্রকাশনীর কাছ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে পরীক্ষা নেন। ফলে পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার মান নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্নব্যাংকের মাধ্যমে সারাদেশে পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হবে। পরীক্ষার মান নিয়েও কোনো প্রশ্ন থাকবে না।

এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পরীক্ষার দিন স্কুল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবেন। বিদ্যুত বিভ্রাটের আশঙ্কা থাকলে জেনারেটর ভাড়া করে রাখবেন। স্কুলে প্রশ্নপত্র ফটোকপির ব্যবস্থা না থাকলে স্থানীয়ভাবে ফটোকপির দোকানের সঙ্গে চুক্তি করে ছাপিয়ে নিবেন। এটি তেমন জটিল নয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ বলেন, সৃজনশীল বিষয়ে দক্ষতার অভাবে শিক্ষকরা নোট ও গাইড থেকে হুবহু প্রশ্ন করছেন। পাঠ্যবই থেকে প্রশ্ন না করায় শিক্ষার্থীরা নোট-গাইড নির্ভর হচ্ছে। নোট গাইডের প্রভাবমুক্ত করতে যশোর শিক্ষাবোর্ড প্রশ্নব্যাংক তৈরি করেছে। প্রশ্নব্যাংক থেকে সারাদেশে পরীক্ষা নিলে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই পড়বে। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে।

তিনি আরও বলেন, যেসব স্কুলে পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র রয়েছে সেসব স্কুলে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রশ্নব্যাংক থেকে অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার নীতিগত সিদ্বান্ত হয়েছে। সফল হলে পাবলিক পরীক্ষাও একইভাবে নেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হবে বলে আশা করেন তিনি।

প্রশ্ন ব্যাংক
প্রশ্ন ব্যাংক হলো অনলাইনে প্রশ্ন রাখার একটি সফটওয়্যার। যেখানে শিক্ষকরা প্রশ্ন করে আপলোড করবেন। শিক্ষার্থীরাও প্রশ্ন আপলোড করতে পারবেন। তবে প্রশ্নপত্র মানসম্মত না হলে সফটওয়্যার তা আপলোড নেবে না। পরীক্ষার আগে স্কুলেই প্রশ্ন ব্যাংক থেকে প্রশ্ন প্রিন্ট করে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এতে প্রশ্ন ফাঁসের সুযোগ থাকবেনা।

আজকের বাজার: সালি / ০১ জানুয়ারি ২০১৮