বিউটি পার্লারের ব্যবসা খুলে জহুরা আজ ওমেন চেম্বারের সদস্য

নারায়নগঞ্জ জেলার রুপগঞ্জ উপজেলার বাগবের গ্রামের কিশোরী জহুরা। পারিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে মাত্র ১২ বছর বয়সেই যাকে বসতে হয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে। তবে সেটা তার নিজের ইচ্ছেতে নয়, বাবা-মা বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেন জহুরাকে। বাবা-মা এক প্রকার জোর করেই বিয়ে দেয় তার চেয়ে প্রায় তিনগুন বেশী বয়সী এক লোকের সাথে। ঘটনাটি ২০০৩ সালের শুরুতে। বিয়ের কিছুদিন পর পর্যন্ত হাসি-খুশী দিন কাটে তার। নতুন হলেও সকলের সাথে মিলিয়ে নিয়েছিলন জহুরা। কিন্তু সেই সুখ বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। কারন একটাই। জহুরার স্বামীসহ তার পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে চাপ দিতে থাকে যৌতুকের জন্য। আস্তে আস্তে শুরু হয় শারিরীক নির্যাতন।

আর এই নির্যাতনের মধ্যে ২০০৩ সালের শেষের দিকে জহুরার কেআল জুড়ে আসে একটি কন্যা সন্তান। তারপরও পাল্টেনি জহুরার ভাগ্য। বরঞ্চ বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা। এতকিছুর পরও সব মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছিল জহুরা শুধুমাত্র তার সন্তানের মুখ দেখে। কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এমন অবস্থায় জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার ভাবনা পেয়ে বসে জহুরাকে। সন্তানের বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন জীবনের কঠিন এক সিদ্ধান্ত নেয় জহুরা। স্বামীকে তালাক দেয় সে। এরপর ২০০৬ সালে ফিরে আসে বাবার বাড়ী। কিন্তু বাড়ী এসেও শান্তির দেখা মিলেনি জহুরার। উল্টো পরিবারের সবাই দোষ দিতে থাকে জহুরাকে। জানিয়ে দেয়া হয় তাকে কোন ধরনের সহযোগীতা করবে না তার পরিবার।

কিন্তু জহুরা অনড়। শশুর বাড়ি আর ফিরে যাবেনা সে। বরং যেকোন ভাবেই সে আবার শুরু করতে চায় তার নতুন জীবন। বুঝতে পারে তাকে নিজ পাঁয়ের উপর দাঁড়াতে হলে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হবে। কারন শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এদিকে দিন দিন বাড়তে থাকে নিজ পরিবারের নির্যাতনও। তাদের একটাই কথা আবার ফিরে যেতে হবে আগের স্বামীর কাছে। দিন দিন বাড়তে থাকে পরিবারের মানসিক নির্যাতন।

এরই মাঝে একদিন ভাগ্য বিধাতা মুখ ফিরে চায় তার দিকে। জহুরার সাথে দেখা হয় স্থানীয় এক এনজিও কর্মকর্তার। তার বুদ্ধিতেই জহুরা প্রশিক্ষণ নেয় মেকআপের। প্রশিক্ষণ শেষে নিজের জমানো মাত্র ৩,৩৫০ টাকায় নিজ বাড়ীতে শুরু করে কাজ। অল্প দিনেই স্থানীয় নারীদের মাঝে সে হয়ে উঠে খুব জনপ্রিয়। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে তার সেবা গ্রহীতার সংখ্যা।

এরপর একদিন জহুরা সিদ্ধান্ত নেয় এবার বাড়ীর বাইরে নিয়ে যেতে হবে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে। দৃঢ় প্রত্যয়ী জহুরা বাগবের বাজারে ভাড়া নেয় এক রুমের একটি দোকান। শুরু করে তার নতুন জীবন। শুরু করে বিউটি পার্লারের ব্যবসা।

ব্যবসার যখন সাফল্য আসে অর্থাৎ ভাল সময় আসে ঠিক তখনই আবারো তার পরিবার চাপ দিতে থাকে সংসার করার জন্য। কিন্তু জহুরা আবারো তাদের ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু এক পর্যায়ে তারা জহুরার তের বছর বয়সী জয়ীতাকেও নির্যাতন শুরু করে। জহুরাকে চাপ দেয় জয়ীতাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাতেও রাজি না জহুরা।

সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জহুরা। সিদ্ধান্ত নেয় আর নয় নিজ পরিবারের সাথে থাকা। বিউটি পার্লারের পাশেই এক রুম ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকা শুরু করে মা-মেয়ে। ২০১৫ সালে জহুরা ভর্তি হয় মৌরাপুরা ডিগ্রী কলেজে। পাশাপাশি সে আরো উচ্চতর ট্রেনিং নেয় মেকআপের উপর।

এরপর থেকেই আরো জমজমাট হয়ে ওঠে কজহুরার বিউটি পার্লারের ব্যবসা। এখন আর সে নকো নয়, আরো নারীদের নিজেই প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবসার পরিধি আরো বৃদ্ধি করে। এক সময় যার ওপট চালানো কস্টকর ছিল বর্তমানে জহুরার মাসিক আয় ৩০,০০০ টাকা থেকে ৪০,০০০ টাকা। এছাড়াও সে বাংলাদেশ ওমেন এন্ড চেম্বারের একজন নির্বাচিত সদস্য। তার মেয়ে জয়ীতা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী।

পুরানো দিনের কথা বলতে গিয়ে জহুরা বলেন, সেসব বিভীসিকাময় দিনের কথা আমি মনেও করতে চাই না। সে সব দিনের কথা মনে উঠলেও আমার গাঁ শিউড়ে উঠে। স্বামী আর তার পরিবার যেমন নির্যাতন করেছে…আমার পরিবারও আমাকে কম নির্যাতন করেনি। তিনি বলেন ভেবেছিলাম আমার পরিবারের সদস্যরা অন্তত আমাকে বুঝবে। কিন্তু উল্টো তারাই আমাকে দোষারো করতে লাগলো।

জহুরা বলেন, আমি এখন আর পুরনো দিনের দিকে তাকাতে চাইনা। আমার মেয়েকে ঘিরেই এখন আমার সব স্বপ্ন। তাকে আমি পড়ালেখা শেষ করাব যেন সে নিজের পাঁয়ে নিজে দাঁড়াতে পারে। কারন শিক্ষিত হওয়া একজন মেয়ের জন্য খুবই জরুরী যাতে করে সে পুরুষদের সমানতালে এগিয়ে যেতে পারে। তথ‌্য-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান