বিপিও থেকে আসবে ১ বিলিয়ন ডলার: তৌহিদ হোসেন

দেশের সার্বিক উন্নয়নে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা বিপিও খাতের সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে।  সরকারের ভিশন ২০২১কে সামনে  রেখে এগিয়ে যাচ্ছে বিপিও। ২০১৮ সালের মধ্যে বিপিও খাত থেকে এক বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন শিল্প সংশিষ্টরা। আজকের বাজার ও এবিটিভি’কে বিপিও’র সার্বিক পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে জানালেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউট সোর্সিং-এর সেক্রেটারি জেনারেল তৌহিদ হোসেন। বক্তব্যের মূল অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা বিপিও’র সার্বিক অবস্থা
আমরা ২০০৮ সালে মাত্র ৩০০ জনকে নিয়ে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা বিপিও  শুরু করেছিলাম। আর এখন ২০১৬ সালে এসে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ এই সেক্টরে কাজ করছে। এরমধ্যে কেউ কেউ কল সেন্টারে কাজ করছে। অনেকে ভ্যাট অফিসে কাজ করছে। গ্লোবালি এটা অনেক বড় একটা ব্যবসা। ফাইভ হান্ড্রেড বিলিয়ন ডলারের বিজনেস। এখন বাংলাদেশ থেকে আমাদের টার্গেট, ২০১৮ সালের মধ্যে এই বিপিও সেক্টর থেকে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করা।

বিপিও সেক্টরের চ্যালেঞ্জ
চ্যালেঞ্জের কথা বলতে হলে আগে আসবে দক্ষ জনশক্তির কথা। কারণ আমরা বেশিরভাগই স্টুডেন্ট কর্মী থেকে নিয়ে থাকি। ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটই আমাদের এখানে বেশি। ফলে এদের দীর্ঘ সময় প্রশিক্ষণ দিতে হয়। এভাবে দক্ষ করে তুলতে একটু বেশি সময় লাগছে। এটি কমিয়ে আনা দরকার।

বাংলাদেশে প্রায় ১১ কোটি তরুণ রয়েছে। আমরা চাই এর একটি বড় অংশ বিপিও সেক্টরে কাজ করুক। এখন আমাদের কার্যক্রম শুধুমাত্র ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ধীরে ধীরে সকল মেট্রো শহরেই কার্যক্রম শুরু করবো। এটা কঠিন কিছু না। চাহিদা মতো বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট কানেকশন পেলে যে কোনও জায়গায় বসেই আউটসোর্সিং করা সম্ভব।

দেশে বিদ্যুৎ সমস্যা এখন খুব একটা নেই। তবে ইন্টারনেটটা এখনো সব জায়গায় সেভাবে পৌঁছায়নি। ফলে বেশিরভাগ কোম্পানি ঢাকা কেন্দ্রিক ব্যবসার কথা চিন্তা করছে। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে ব্যবসা ছড়ানো সম্ভব হয়নি। ঢাকায় এই সমস্যা নেই। যেমন আমার অফিসে চারটি লাইনে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। একটিতে  সমস্যা দেখা দিলে অন্যগুলো দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা
সব চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মার্কেটিং। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করার পাশাপাশি ডমেস্টিক লেভেলেও অনেক কোম্পানির কাজ করেছি। সবগুলো মোবাইল কোম্পানি ইতিমধ্যে আমাদের আউটসোর্স করেছে। একই সঙ্গে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি কোকাকোলা, ইউনিলিভারও আমাদের কাজ করেছে। এর পর দেশি কোম্পানি আকিজ গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল; প্রত্যেকেই ইতিমধ্যে বিপিওতে আউটসোর্স করেছে। এ থেকে বলা যায় বিপিও সেক্টরে কিন্তু বেশ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এখন আমরা ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
একটু একটু করে আমরা কাজও পাচ্ছি। আমি নিজেও ফেসবুক, আমাজনের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের কিছু কাজ করেছি। কিন্তু তারা বাংলাদেশে ওইভাবে বড় কোনো কাজ দিচ্ছে না। আমরা আশাবাদী যে, তারা বাংলাদেশে বড় কাজগুলোও দিবে। যখন তারা নিশ্চিত হবে যে বাংলাদেশ থেকেও বড় কাজ বের করে আনা সম্ভব তখন তারা  অবশ্যই কাজ দিবে।

সরকার কোন ধরনের সহযোগিতা করছে?
আমরা সরকারের থেকে কিছু সহযোগিতা পাচ্ছি। আইসিটি ডিভিশন থেকে বেশ কিছু প্রশিক্ষণ সহায়তা পেয়েছি। এ ছাড়া যে কোনো বিষয়ে আইসিটি বিভাগের কাছে গেলে তারা সরাসরি সহযোগিতা করছে। অথবা হাইকমিশনকে বলে দিচ্ছে, আমাদের সহযোগিতা করার জন্য। এর বাইরে বিপিসি বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল থেকেও বেশ সুবিধা পাচ্ছি। এখন আমাদের সাপোর্ট দরকার লং টাইম ইনভেস্টমেন্টে । এটা না  হলে গ্লোবালি বিজনেস সম্ভব হবে না। সরকার নিজ উদ্যোগে ২৮ টি পয়েন্টে হাইটেক পার্ক করছে। এগুলোর কয়েকটি এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

বাকীগুলোও হচ্ছে। এগুলো সফলভাবে কাজও করছে। কিন্তু বাইরের বিশ্বে তাকালে দেখা যাবে তাদের অনেক বেশি হাইটেক পার্ক রয়েছে। ফিলিপাইনে প্রায় ৫০০ হাইটেক পার্ক রয়েছে। তারা ক্যাপটিভ মডেলে করছে এসব। একজন ইনভেস্টর গেলে তাকে ফিলিপাইন সরকার ১০ হাজার স্কয়ার ফিটের একটা পাকা ভবন দিয়ে দিচ্ছে। কিংবা আস্ত একটি ফোর দিয়ে দিচ্ছে। আর বাংলাদেশে আগে চিন্তা করা হয়, ৩০০ একর বা ৪০০ একর জমি নিয়ে করতে হবে । আমি মনে করি চিন্তার এই জায়গাটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

আমাদের জনতা  টাওয়ারে মাত্র ৭০ হাজার স্কয়ার ফিট জায়গা।  এখানে কিন্তু  ১০০ ভাগ সচলতার সঙ্গে কাজ হচ্ছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে যেটা হচ্ছে ৩০০ একরের  বেশি জমিতে। আশা করা হচ্ছে সেখানে লক্ষাধিক আইটি সংশ্লিষ্ট মানুষ কাজ করতে পারবে। এভাবে সব দিকেই উন্নতি হচ্ছে। যেমন বিজনেস হচ্ছে, নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

বাজেটে প্রত্যাশা
এবারের বাজেটে আমাদের প্রধান চাওয়া, যেন ভ্যাটটা গ্রহণযোগ্য করা হয়। এখন ৪.৫ পার্সেন্ট আছে আমরা ২.৫ পার্সেন্ট প্রস্তাব করেছি। এ ছাড়া আমরা যখন ইন্টারনেট কিনছি তখন আবার ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। আমি কোম্পানি থেকে ৪.৫ শতাংশ ভ্যাট দিচ্ছি এরপর আবার কেন ইন্টারনেটের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে? সব জায়গায় একই রকম ভ্যাট হলে আমাদের সুবিধা হয়।

যুব সমাজের জন্য পরামর্শ
তরুণদের জন্য প্রথম এবং প্রধান পরামর্শ হচ্ছে, নিজের কাজ করার ইচ্ছা আগে আনতে হবে। আমাদের সময় টিউশনি ছাড়া তেমন কোনো কাজ ছিল না। এখন পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক কাজের সুযোগ আছে। আমি মনে করি, ইউনিভার্সিটি জীবনে এসে প্রথম বর্ষ থেকেই কোনো না কোনো কাজে  লেগে পড়া উচিত। এতে, গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে করতে তার ৩/৪ বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন হয়ে যাবে। এটা পরে তার কর্মজীবনে কাজে লাগবে।

ইন্টারনেটের যৌক্তিক ব্যবহার  
প্রাইভেট কোম্পানিগুলো যতটুকু কেনে তারা শতভাগ ব্যবহার করে। একটুও অব্যবহৃত থাকে না। তবে সরকারি  প্রতিষ্ঠানে যেটুকু অব্যবহৃত  বা মাস শেষে থেকে যায় সেগুলো কিন্তু তারা বিভিন্ন জায়গায় ফ্রি বণ্টন করে দিতে পারে। এটা হতে পারে শিক্ষার্থীদের মাঝে। আর ইন্টারনেট এমন একটি জিনিস, যা একবার ফ্রি দিলে পরে ব্যবহার না করে থাকতে পারবে না। সে আপনাআপনি ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে যাবে।

ভিশন ২০২১ উপলক্ষে আইসিটি খাতের উদ্যোগ
প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন তাতে সবাই বেশ উদ্যোগী। তার সঙ্গে আমাদের তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকও পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তা ছাড়া এই প্রথম সরকারের সঙ্গে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোও একসঙ্গে কাজ করছে। এতে আমাদের গ্যাপটা সরকারও বুঝতে পারছে। তারা আমলাতান্ত্রিক ব্যাপার থেকে বের হয়ে এসে আমাদের সরাসরি যথেষ্ট সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি আমাদেরও কিছু কমিটমেন্ট রয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা প্রাইভেট সেক্টর থেকে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা পাশাপাশি  ৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে চাই।

তৌহিদ হোসেন: সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউট সোর্সিং

আজকের বাজার: সবুজ/আরআর/দীপু/এলকে/ ২২ মে ২০১৭