বেশি লাভের আশায় লোকসান হয়

পুঁজিবাজার

বরুণ প্রসাদ পাল

অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা মার্কেট থেকে টাকা উঠিয়ে সময়মতো এজিএম করতে পারেনি, ডিভিডেন্ড দিতে পারেনি, জেড ক্যাটাগরিতে চলে গিয়েছে। অথচ আমরা সেই সব কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনও ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারি নি।

আমাদের শেয়ারমার্কেট এখন পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে একটা স্থিতির মধ্যে আছে রেগুলেটরি, বিনিয়োগকারী, ট্রেডারসহ সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এমনটা সম্ভব হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা যদি একটু চোখ কান খোলা রেখে, সঠিকভাবে বিনিয়োগ করে তাহলে আমি মনে করি, বর্তমান বাজারে ঝুঁকি অনেক কম। আমি আরও বলব, একটা হ্যান্ডসাম রিটার্ন পাওয়ার মতো উপযোগী বাজার হিসেবে পুঁজিবাজার অবস্থান করছে এখন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সব সেক্টরেই রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে। আমি বলতে পারি, অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা মার্কেট থেকে টাকা উঠিয়ে সময়মতো এজিএম করতে পারেনি, ডিভিডেন্ড দিতে পারেনি, জেড ক্যাটাগরিতে চলে গিয়েছে। অথচ আমরা সেই সব কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনও ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারি নি। আমরা যদি এর মধ্যে থেকে একটা বা দুইটা কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতাম, বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারতাম, তাহলে অন্য সব কোম্পানির জন্য একটা উদাহরণ হতে পারত। তখন সবাই বুঝতে পারত যে বিনিয়োগকারীর টাকা নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা যাবে না। এদের যদি শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা যেত তাহলে আমার মনে হয়, যেন-তেন কোন প্রতিষ্ঠান বা কোনও খারাপ কোম্পানি মার্কেট থেকে টাকা তোলার সাহস করত না। এটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ।

আরেটা চ্যালেঞ্জ হলো, আমাদের বাজারে বিনিয়োগকারীদের অনেকেরই পুঁজিবাজার সম্পর্কে ধারণা না থাকা বা জ্ঞানের অভাব। এখানে বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা এসেছেন যাদের লোভ একটু বেশি। সমস্যা হলো এখানেই, কারণ আমরা লোভের মধ্যে পড়ে বিপদ ডেকে আনি এবং পুঁজিবাজারে লস করে বসি। কাজেই বিনিয়োগ সম্পর্কে যদি আমরা ধারণা দিতে পারি বা বিনিয়োগকারীদের যদি আমরা আরো সচেতন করে, শিক্ষিত করে তুলতে পারি তাহলে আর এই সমস্যার মুখে পড়তে হবে না। ফলে আমরা এই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব।

এসইসি এখন সারা দেশে বিনিয়োগকারীদের সচেতন করার জন্য এবং বিনিয়োগের জ্ঞান বাড়াতে বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। আমরা দেখেছি প্রতিটি মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকার এজেন্সী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। কিন্ত দুঃখের কথা হলো, আমরা যে পরিমাণ বিনিয়োগকারী আশা করি, তাদের অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাই, সে অনুপাতে তারা আসছে না। আমার ধারণা যেহেতু এই কার্যক্রম কেবলমাত্র শুরু হয়েছে, সেহেতু সামনের দিনে বিনিয়োগকারীরা আসবে, অংশগ্রহণ করবে এবং জ্ঞান অর্জন করবে, পুঁজিবাজারে এসবের প্রভাব পড়বে। আমার মনে হয়,বিনিয়োগকারীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেটের জন্য, সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় রকমের সুফল বয়ে আনবে।

আইনের মধ্যে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি তো থাকবেই, কিন্ত এর জন্য বসে থাকলে তো হবে না। এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। আইন এমন একটা প্রসেস যার মাধ্যমে এই ত্রুটি বিচ্যুতি দূর করা সম্ভব। এখন যে আইনটা চালু আছে, আমি মনে করি, এটা আন্তর্জাতিক মানের, কিন্ত প্রত্যেকটি আইনে কিছু ফাঁক-ফোকর থাকে, এই সুযোগ যদি রিলেটেড পার্টিরা নিয়ে নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে কিন্ত আইন করে আপনি এটা বন্ধ করতে পারবেন না। আমি যদি নির্দিষ্ট করে বলি, বসুন্ধরা পেপার মিলের নির্ধারিত প্রাইস হলো ৮০ টাকা। অনেকেই বলছে এই মূল্য অনেক বেশি হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কোন কিছু ম্যানুপুলেট হলো কি হলো না, এটা বোঝা বা খুঁজে বের করা কিন্ত কঠিন। আমরা যারা বিডার, যারা মূল্য নির্ধারণ করি, তারা যদি এসব ব্যাপার ক্যালকুলেট না করি, তাহলে আপনি আইন করে আটকাতে পারবেন না। এই জিনিসগুলো প্রমাণ করাটাও কষ্টকর। আসলে যারা এমন দুর্নীতিগ্রস্ত, তারা যদি তাদের আচরণ পরিবর্তন না করে, তাহলে করার তেমন কিছুই থাকে না। এসব ক্ষেত্রে একটা চক্র গঠিত হয়। তারা ইরেজেবল বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে কী পরিমাণ টাকা তুলবে কোম্পানি, তা ঠিক করে দিতে পারে, এখানে ৫০-৬০ জন ইরেজেবল বিনিয়োগকারী যদি বিট করে তাহলে আমার কাট অব প্রাইজটা বেশি হবে। এটা কিন্ত যেকোনো সময় ম্যানেজ করা সম্ভব। কাজেই আমরা যারা বিডার, তারা যদি ইস্যু ম্যানেজারদের দ্বারা বায়াস্ট হই তাহলে আইন দিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। এর জন্য আমরা বলতে চাই যে, আমরা যারা বিট কাট অব প্রাইজ নির্ধারণ করি এগুলো পাবলিকের টাকা। সুতরাং আমাদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। আইনের পরিবর্তনের কথা আমি বলব না , আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, কারণ ত্রুটি আমাদের মধ্যেই রয়েছে।

আমাদের একটা অভ্যাস আছে, যখন মার্কেট বেড়ে যায়, তখন দেখি, বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। আবার মার্কেট কমে গেলে বিনিয়োগকারীদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা বাজারের জন্য নেতিবাচক দিক । সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধারণা, বাজার যখন উঠতি থাকে তখন টাকা বিনিয়োগ করলে অনেক লাভ হবে। তখন তারা সোনা-দানা, জমি, ধার-দেনা করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কেন জানি সবসময় উর্ধ্বমূল্যে শেয়ার কিনতে অভ্যস্ত। একটা শেয়ার যখন বটম অবস্থানে তখন আপনি কোনও বিনিয়োগকারীকে মার্কেটে আনতে পারবেন না। এ ব্যাপারটা বারবারই ঘটছে, এটা একটা থ্রেট। এভাবে অনেকে সব হারিয়ে ফেলছে, আবার অনেকেই এখান থেকে শিক্ষাও নিচ্ছে। আমাদের স্টকমার্কেটের বয়সতো খুব বেশি না। বিশে^র যত বড় বড় শেয়ার মার্কেট রয়েছে একসময় তারাও আমাদের মতোই ছিল। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তারা আজ ম্যাচিউরড মার্কেটে পরিণত হয়েছে। আমার বিশ^াস, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারও একসময় একটি ম্যাচিউরড মার্কেটে পরিণত হবে।

বরুণ প্রসাদ পাল
এমডি ও সিইও, বিডি ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল হোল্ডিংস লিমিটেড