ভেষজ ওষুধ শুধু রোগ নিরাময় করে না, প্রতিরোধও করে

শুরুতে আমি যদি হামদর্দের কথা বলতে যাই, তাহলে আমাকে যাওয়া লাগবে ১১২ বছর পিছনে। ১৯০৬ সালে ভারতের দিল্লিতে ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করে হামদর্দ। আজ থেকে ১১২ বছর পূর্বে এদেশে বা উপমহাদেশে তেমন কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না। ওই সময়ে হামদর্দের প্রতিষ্ঠাতা চিন্তা করলেন কিভাবে এই উপমহাদেশের মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা দেয়া যায়।

তখন ভাবনায় আসে, দেশের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ সেবার জন্য সহজেই যেসব কাচামাল পাওয়া যায়, সেসব দিয়ে কিভাবে সেবা দেয়া যায়। সেসব সহজলভ্য কাচামাল দিয়ে তৈরি কিছু ঔষধ নিয়ে হামদর্দ শুরু হয়। খুব স্বল্প পরিসরে হামদর্দ শুরু হলো। ধীরে ধীরে হামদর্দ ভারতে বড় প্রতিষ্ঠানের রুপ ধারন করলো। তারপর হামদর্দের প্রতিষ্ঠাতার আরেক ভাই পাকিস্থান গেলেন এবং সেখানে হামদর্দ প্রতিষ্ঠা করলেন সেই ১৯৫৩ সালে। তখন থেকে বাংলাদেশেও হামদর্দের চিকিৎসা সেবা ছড়িয়ে পড়ে।

এই উপমহাদেশে এলোপ্যাথির পাশাপাশি হামদর্দ প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার ধারনা প্রচলন করে। মানুষের চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে যেন কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত না হয়, সেই লক্ষেই বিগত ১শ ১২বছর হামদর্দ কাজ করেছে।

আসলে মানুষ দুই কারনণ ঔষধ গ্রহণ করে। কোন রোগে আক্রান্ত হলে বা কোন সমস্যা হলে। যখন রোগ হয় তখন মানুষ চিন্তা করে কার দ্বারা বা কোন ঔষধের মাধ্যমে কিভাবে সুস্থ্য হবো? আসলে প্রতিটা ঔষধেরই কিন্তু আলাদা আলাদা ফিলোসোফি রয়েছে। এলোপ্যাথিকের কন্সেপ্ট তুলনামূলক ইউনানি, হার্বাল বা আয়ুর্বেদিকের চেয়ে নতুন।

হার্বাল, ইউনানি বা আয়ুর্বেদিক ঔষধের মূল উপাদান হচ্ছে হার্বস। কিছুটা প্রানী থেকেও এর উপাদান পাওয়া যায়। হার্বস বলতে বিভিন্ন ঔষধি গাছের বাকল, পাতা ইত্যাদি।

প্রায় প্রতিটা দেশেরই লোকজ বা ভেষজ নিজস্ব একটা চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। হার্বসের উপরে ভিত্তি করেই মূলত চিকিৎসা পদ্বতি গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থানসহ পার্শ্ববর্তী দেশের চিকিৎসা পদ্বতি হচ্ছে ইউনানি। এটা মূলত আসছে গ্রিসের ইউনিয়ন প্রদেশ থেকে। সেখান থেকে পরবর্তীতে ইবনে সিনা, আলরাজির হাত ধরে এই চিকিৎসা পদ্বতির ডেভেলপ হয়।

ইউনানি যেহেতু মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দ্বারা আবিস্কৃত সেহেতু এই পদ্বতিতে ঔষধ তৈরিতে সবসময় হালাল–হারামের বিষয়টা দেখা হয়। অর্থাৎ মুসলিমদের জন্য হারাম এমন কোন উপাদান এই পদ্বতির মধ্যে ব্যবহার করা হয় না।

ভারত থেকে মূলত আসে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্বতি। আয়ুর্বেদ আসে বেদ সাস্ত্র থেকে। আয়ুর্বেদ মানে হলো জীবনের জ্ঞান। আয়ুর্বেদিক দুই তিন হাজার বছরেরও প্রাচীন চিকিৎসা পদ্বতি।

ইউনানিও হাজার বছরের প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা। এই পদ্বতি গ্রিস থেকে মধ্য প্রাচ্য, তুজবেকিস্থান, উজবেকিস্থান, আফগানিস্থান হয়ে আসছে আমদের উপমহাদেশে। ইউনানি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আরও উন্নত। হার্বাল রয়েছে অনেক যেমন, চাইনিজ হার্বাল, আমেরিকান হার্বাল, জাপানিজ হার্বাল। হার্বালের মূল উপাদান আসে গাছ থেকে।

হামদর্দ ইউনানি, হার্বাল এবং আয়ুর্বেদিক তিন ধরনের ঔষধই তৈরি করে। হামদর্দ এমন এক প্রতিষ্ঠান যেখানে শুধু ঔষধই তৈরি করে না, গবেষনাও করে। ঔষধ উৎপাদনে হামদর্দ মূলত সহজ লভ্যতা, নিরাপদ ও মাননিয়ন্ত্রনের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মানুষ হামদর্দের ঔষধ গ্রহন করছে, ভালো সেবা পাচ্ছে তাই মানুষের কাছে হামদর্দের গ্রহনযোগ্যতা বেশি। আমাদের এখানে ইউনানির যেমন ভাল ঔষধ আছে, তেমনি আয়ুর্বেদিকেও ভালো ঔষধ আছে। আমরা চাই মানুষ সুস্থ্য থাকার জন্য আমদের এই সেবা আরো বেশি নেওয়া দরকার। তাই হামদর্দ ইউনিভার্সিটিতে আমরা একটা ফ্যাকাল্টি খুলেছি ইউনানি-আইয়ুর্বেদিক ফ্যাকাল্টি।

আমরা তিনটা ইউনানি মেডিকেল কলেজ করেছি। এখান থেকে যারা পাশ করে বের হবে তারা সবাই কিন্তু এমবিবিএস এর সমমান। এই খাতে যত শিক্ষার্থী বাড়বে এই পদ্বতির জনপ্রিয়তা বাড়বে। আমাদের ডোজ শতভাগ ঠিক থাকলে এই পদ্বতি নিরাপদ চিকিৎসা পদ্বতি।

তবে আয়ুর্বেদিক বা ইউনানির নামে ভেজাল ঔষধ দিয়ে ধোকা দিচ্ছে অনেকে। আমাদের রেগুলেটরের উচিৎ এদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া। কারণ যদি কঠোর না হয় তাহলে এত ভালো একটা খাতের সুনাম ক্ষুন্ন হবে। পাশাপাশি মানুষ প্রতারিত হলে মানুষের আস্থা কমে যাবে। ফলে এই খাতের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। আমরা মনে করি মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নেওয়া উচিত ইউনানি বা আয়ুর্বেদিক পদ্বতি থেকে।

হামদর্দের মূল উদ্দেশ্য লাভ করা নয়। আমাদের মূল উদ্দেশ্য মানুষের সেবা করা। আমরা হজ্ব ক্যাম্পে, বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ফ্রি চিকিৎসা প্রদান করে থাকি। আমরাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে চিকিৎসক পেশক্রিপশনের জন্য কোন টাকা নেন না। আমরা ভবিষ্যতেও এইভাবে মানুষের সেবা করে যেতে চাই।

মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন রাসেল,
ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ বাংলাদেশ