মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর খুলে দেবে নতুন সম্ভাবনার দ্বার

সমুদ্রপথে আমদানি-রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চট্রগ্রাম সমুদ্র বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণও দ্রুত বাড়ছে। ফলে ধারণক্ষমতার বাইরে গিয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। এতে চাপ বেড়েছে দেশের অন্যতম এ সমুদ্র বন্দরে। চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর থেকে অতিরিক্ত চাপ কমানো এবং ব্যাপক সংখ্যক জাহাজ ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যে ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার।

এ প্রকল্পের অধীনে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সাগর দ্বীপ মহেশখালী মাতারবাড়িতে নির্মাণ করা হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর। এ বন্দর নির্মিত হলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে বলে অভিমত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের।

ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাহিদাকে সামনে রেখে দেশের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৬ মিটার গভীরতা এবং ৮০০০ টিইইউ’স (২০ ফুট দৈর্ঘের কন্টেইনার) ধারণক্ষমতা সম্পন্ন কন্টেইনার জাহাজ প্রবেশের সুবিধা বৃদ্ধি করতে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বন্দরের পোতাশ্রয়ে ১৬ মিটার পর্যন্ত ড্রাফটের জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে। ফলে সামগ্রিক পরিবহন ব্যয় হ্রাস পাবে আনুমানিক ১৫ শতাংশ।

মাতারবাড়ি বন্দর সড়ক, রেল ও নদীপথে সংযুক্ত থাকবে। বন্দরকে কেন্দ্র করে একটি সুপরিকল্পিত কানেক্টিভিটি গড়ে উঠবে। ফলে যেকোনো পণ্য সহজে ও কম খরচে পৌঁছে যাবে আমদানি-রফতানিকারকদের দোরগোড়ায়। এ বন্দর দিয়ে কয়লা, লিক্যুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি), অপরিশোধিত তেল ও তেল জাতীয় পণ্য, সিমেন্ট, ক্লিঙ্কার, সার, খাদ্য, স্টিল ও স্ক্র্যাপ লোহা আমদানি সহজ হবে।

জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় মাতারবাড়ি ও ধলঘাট এলাকায় বন্দরটির নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল ২ হাজার ২১৩ কোটি এবং বাংলাদেশ সরকারের বরাদ্দ ২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা।

২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বন্দরের প্রথম পর্যায়ের কজ শেষ হবে। মাতারবাড়ি বন্দরের অংশ এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ সড়ক অংশ বাস্তবায়ন করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে থাকবে ৪৬০ মিটার দৈর্ঘের কন্টেইনার জেটি, ৩০০ মিটার দৈর্ঘের মাল্টিপারপাস জেটি এবং ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চ্যানেল। চ্যানেলের গভীরতা হবে ১৬ মিটার ও প্রস্থ হবে ৩৫০ মিটার। এছাড়া ৩৯৭ মিটার নর্থ ব্রেক ওয়াটার বাঁধ বর্ধিতকরণ, দুটি কি-গ্যান্ট্রি ক্রেন, একটি মাল্টিপারপাস গ্যান্ট্রি ক্রেন, ছয়টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন ও তিনটি টাগবোট ক্রয় করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে পুনর্বাসনসহ জমি অধিগ্রহণ, আয়কর, শুল্ক এবং ভ্যাটবাবদ ব্যয়, প্রকল্পের যানবাহন, জনবল এবং বাস্তবায়ন ব্যয় সম্পন্ন হবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ চারলেন বিশিষ্ট ২৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক, ১৭টি ছোটো-বড় ব্রিজ (ব্রিজগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ৭ হাজার ০৯৪ মিটার), ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার ডাইক রোড এবং সার্ভিস রোড নির্মাণ করবে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে জাহাজ আগমন বৃদ্ধির হার ১১ শতাংশের বেশি। বর্তমান কন্টেইনার হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে বার্ষিক কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪ মিলিয়ন টিইইউ’স এবং জাহাজের সংখ্যা দাঁড়াবে ৮ হাজার ২০০টি। এ বিপুলসংখ্যক কন্টেইনার ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা দেশের বর্তমান সমুদ্র বন্দরগুলোতে নেই।

দেশে বর্তমানে যে কয়টি সমুদ্র বন্দর রয়েছে সেগুলোর কোনোটিই গভীর সমুদ্র বন্দর নয়। ফলে অধিক গভীরতার (ডিপ ড্রাফটের) জাহাজ এসব বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। অধিক গভীরতার জাহাজের জেটি সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন’ প্রকল্প অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এটি সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপানের অংশীদারিত্ব চার দশকেরও বেশি সময়ের। বাংলাদেশকে কেন্দ্রে রেখে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো নির্মাণে জাপানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ অর্থাৎ ‘বিগ-বি’। এটি বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নে জাপানের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। বাংলাদেশ এবং জাপান সরকারের মধ্যে ২০১৪ সালে ‘বিগ-বি’ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

‘বিগ-বি’র প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে মাতারবাড়িকে। এখানে কয়লা-বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং অন্যান্য অবকাঠামোসহ নির্মাণ করা হচ্ছে বাণিজ্যিক বন্দর। এখানে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক বিনিয়োগ হবে, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি আসবে। ভূ-অবস্থানগত সুবিধা এবং গভীর সমুদ্র বন্দরের সক্ষমতা থাকায় বন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হবে।

এ বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। বন্দরকে কেন্দ্র করে নিকটবর্তী এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, উন্নয়ন হবে অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থায়। ফলে কর্মস্থান বিপুলভাবে বাড়বে। আমদানি-রফতানি বৃদ্ধি পেলে রাজস্ব আয় বাড়বে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। দেশের ব্লু ইকোনমি তথা তেল-গ্যাস ও অন্যান্য সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের সুযোগ সম্প্রসারিত হবে।

মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক কন্টেইনারবাহী জাহাজ, খোলা পণ্যবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারকে জেটিতে ভেড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নিঃসন্দেহে বলা যায় এটি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার পথে মাইলফলক হবে নতুন এ সমুদ্র বন্দর।

বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মাতারবাড়ির অবস্থান। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাকে বেগবান করতে মহেশখালী-মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে ৩৪টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে বদলে যাচ্ছে চিরচেনা মাতারবাড়ি। এখানে গড়ে উঠছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, কোল (কয়লা) জেটি, লিক্যুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনালসহ বাণিজ্যিক বন্দর। মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে দেশের তথাপি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বাণিজ্যিক হাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে মাতারবাড়ি।

জাইকার সমীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মহেশখালীর মাতারবাড়ি ও জাপানের কাশিমার ভূ-প্রকৃতি প্রায় একই ধরনের। তাই ‘কাশিমা’ চ্যানেল তৈরির মাধ্যমে বন্দরকে সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। অর্থাৎ এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম খননকৃত বন্দর। এছাড়া চ্যানেলে যাতে পলি জমতে না পারে, সে লক্ষ্যে ব্রেকওয়াটার বাঁধ নির্মাণ করে পানির প্রবাহ রোধ করা হবে।

কাশিমার আদলে তৈরি করা হলেও মাতারবাড়ি বন্দর হবে কাশিমা সমুদ্র বন্দরের চেয়ে আড়াই গুণ বড়। এতে করে পাল্টে যাবে কক্সবাজারসহ সারাদেশের অর্থনীতির চিত্র। উন্নত সমৃদ্ধ দেশের তালিকায় যুক্ত হওয়ার পথে বাংলাদেশের যাত্রা আরো বেগবান হবে বলে অভিমত দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের। খবর-ডেইলি বাংলাদেশ

আজকের বাজার/আখনূর রহমান