পুঁজিবাজারে প্রাইমারি মার্কেটের ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ

মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো এ দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রফিট নিয়ে যাবে, অথচ এ দেশের মানুষের সঙ্গে ক্যাপিটাল মার্কেটের মাধ্যমে ভাগিদার করা হবে না, এটা কীভাবে হয়? মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে ক্যাপিটাল মার্কেটে আসার যে বাধ্যবাধকতার আইন ছিল, তা থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। এটা কীভাবে হলো? কাদের চাপে হলো? বিষয়টা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। পুঁজিবাজারের প্রাইমারি মার্কেট নিয়ে আজকের বাজার-এর সাথে একান্ত খোলামেলা আলোচনায় এসব কথা বলেছেন এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব এইচ মজুমদার এফসিএমএ। আজকের বাজার-এর পাঠকদের জন্য তাঁর আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনুলিখন করে ছাপা হলো।

আমাদের সেকেন্ডারি মার্কেট বর্তমানে চমৎকার অবস্থায় আছে। যতগুলো রেগুলেটরি রিফর্ম ও আইন-কানুন গত ৫-৭ বছরে হয়েছে, সেগুলো এই মার্কেটটাকে অনেকটা স্টাবলিশ করে দিয়েছে। এখন মার্কেট খুব বেশি চাঙা হবে বা ধস নামবে, এমনটা হবে না। এটা একটা ভালো দিক।

পাঁচ বছর আগেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগকারীদের যে মানসিকতা ছিল, বর্তমানে সেটি অনেক উন্নত হয়েছে। দু-একটা গুজবনির্ভর বিনিয়োগ হলেও বিনিয়োগকারীরা অনেক ম্যাচিউরড হয়েছে। এগুলো কিন্তু পজেটিভ দিক।

আরেকটি পজেটিভ দিক হচ্ছে, আপনি যদি এখনকার সূচকের কথা বলেন বা এখনকার শেয়ারের প্রাইসিং বা ভেরিয়েশনের কথা বলেন, যেকোনো প্রেক্ষাপটে অনেক চমৎকার অবস্থানে আছে। বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ঝুঁকির কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি আপনি খুব অল্পসংখ্যক এনালাইসিস করে বিনিয়োগ করেন, সে ক্ষেত্রে আমি বলব যে এখন সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগের জন্য ভালো অবস্থা আছে।

আর প্রাথমিক বাজারের সম্ভাবনার কথা বলতে গেলে, বর্তমানে প্রাথমিক বাজারের অবস্থা হচ্ছে দ্য স্কাই ইজ লিমিট রাইট নাউ। কারণ, আমাদের এখানে একটি আইপিওযদি হয়, দেখা যাবে আইপিওটির বিপরীতে অ্যাপ্লিকেশন পড়ছে ২০ থেকে ৪০ গুণ। এ ক্ষেত্রে মানুষের গেইন করার আগ্রহের প্রেক্ষাপটটাই গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ, কিছু কোম্পানি তো আসবেই, যেখানে বিজনেস রিস্কটা বেশি বা যেটার ভেতরে কিছু সমস্যা থাকবে। এটা অস্বীকার করছি না। তবে বেশির ভাগ কোম্পানি খুবই ভালো অবস্থানে আছে।

কিছুদিন আগে একটা কোম্পানি এনালাইসিস করে দেখলাম, সেই কোম্পানির এনএভি হচ্ছে ২৭ টাকা। সেটা বাজারে এসেছে ১০ টাকা ফেস ভ্যালুতে। তার মানে, আপনি ১০ টাকা দিয়ে ২৭ টাকার অ্যাসেট কিনছেন। অর্থাৎ, আমার কাছে মনে হচ্ছে, এখন যে কোম্পানিগুলো বাজারে আসছে, তার অনেকগুলোই ভালো কোম্পানি।

এ ক্ষেত্রে বলতে হয়, প্রাইমারি মার্কেটে বেশি করে শেয়ার দিতে। প্রাইমারি মার্কেটে যত বেশি শেয়ার দেবে, সেকেন্ডারি মার্কেটের অনিশ্চয়তা তত কমে যাবে। কারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে অপশন থাকবে। তারা এক্স নেবে, ওয়াই নেবে, জেড নেবে।

প্রাথমিক বাজারের সমস্যা হচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা শুধু ইকুইটি বেইজ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু এখানে অন্যান্য প্রোডাক্ট থাকা উচিত ছিল, কিছু ফিক্সড ইনকাম ভেহিকল  থাকা উচিত ছিলÑ এগুলো নেই। আর নিয়ন্ত্রণ সংস্থার ফেইলিওরের কথা বলতে হলে এই ভেহিকলগুলো না থাকাকেই বলতে হবে। কেন এগুলো তারা আনতে পারছে না? আমার কাছে মনে হচ্ছে, সাধারণ বিনিয়োগকারী বলেন বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বলেন, সেগুলো চমৎকার হয়েছে।

প্রাথমিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন যে বিষয়টি এসেছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা একটা কোটা পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা দেখেশুনে ইনভেস্ট করতে পারছে। অথবা ইস্যুয়ার কোম্পানিগুলোকে অনেকগুলো কোশ্চেন, অনেকগুলো ডিসক্লোজার, অনেক কম্প্রোমাইজ মেইনটেইন করে আসতে হচ্ছে। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এনালাইসিস করার ক্ষমতা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের তুলনায় ন্যাচারালি বেশি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, এলিজেবল ক্যাটাগরিতে যেটা দেওয়া হয়েছে, এটি আরও অনেক বড় করা উচিত। তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়বে। একই সাথে ক্যাপিটাল মার্কেটে মানুষের যে বিনিয়োগ, সেটিও বাড়বে।

এবার আরেকটি ইস্যুতে আমরা আলোচনা করতে পারি। তা হচ্ছে, প্রিমিয়াম আর এটপার নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে। অথচ এটা কিন্তু বড় কোনো ইস্যু নয়। তার কারণ, যে কোম্পানির এনএভি ভালো থাকবে, যে কোম্পানির ইপিএস ভালো থাকবে বা রিজার্ভ ভালো আছে, সেই কোম্পানিকে প্রিমিয়াম দিতেই হবে। আর যে কোম্পানিগুলো অনেক দিন ধরে ব্যবসা করছে, কিন্তু এনএভি বা রিজার্ভ নেই বা রিজার্ভ ছোট, সে তো প্রিমিয়াম পাওয়ার যোগ্য না। কিন্তু সে বাজারে আসতে চাচ্ছে, তার এক্সপ্রেন্সিয়াল বিজনেস প্রোগ্রাম ভালো আছে, সে ক্ষেত্রে তাকেও আসতে দিতে হবে।

এ জন্য এটপারও যেমন আসবে, প্রিমিয়ার কোম্পানিও আসবে। আমার যেটা মনে হয়, দুটি একসাথেই দেওয়া উচিত। যে মনে করবে প্রিমিয়ামে রিস্ক নেবে না, সে এটপারে বিনিয়োগ করবে। তাহলে আর বিতর্ক হবে না।

আরেকটি রেগুলেটরি রিফর্মস অবশ্যই পরিবর্তন করা উচিত। ফিক্সড প্রাইজ মেথড বলেন আর প্রিমিয়াম মেথড বলেন, এগুলোর চেয়ে বড় হচ্ছে স্বচ্ছতা। প্রাইসিংয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা কিন্তু বর্তমান পদ্ধতিতে আগের চেয়ে অনেক নিশ্চিত করা গেছে। অনেক কোম্পানি এখানে পার্টিসিপেট করছে। আমার মনে হয় এ পদ্ধতিটি ভালো।

বন্ড মার্কেট

প্রাথমিক মার্কেটে নানা রকম ভেহিকল, ফিক্সড ইনকাম, বন্ড ইত্যাদি থাকার কথা। আমরা তো আমাদের বাজারে শুধু শেয়ারই বুঝি। ইভেন মিউচুয়াল ফান্ডগুলো যথাযথভাবে কাজ করছে না। সে ক্ষেত্রে বন্ডের দিকে সরকারও বেশ সোচ্চার, আন্তরিক। এই প্রাথমিক বাজারে বন্ড মার্কেট চালু করতে হলে কিছু ইনসেনটিভ দিয়ে চালু করতে হবে। যেমন ধরেন, একসময় জিরো কুপন বন্ড ছিল। আমরা সবাই বলছি ব্রিজ করা সম্ভব, এটা করা সম্ভব, কিন্তু এই টুলসটা কী হবে? মাধ্যমটা কী হবে? ক্যাপিটাল মার্কেট কী টুলস ইউজ করবে? এ ক্ষেত্রে বন্ডগুলো ইউজ করা যেতে পারে। যেমন জিরো কুপন বন্ড বা অ্যাসেট সিকিউরিটাইজেশন। আপনি একটা ব্রিজ করবেন, বড় বড় ব্রিজ করতে পারেন বা রাস্তা করতে পারেন। এখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। যেমন কিছু ট্যাক্স বেনিফিট দিতে হবে, যদি আপনি ফিক্সড ভেহিকল ইনকামগুলো ইনট্রোডিউজ করতে চান।

যারা একটু কম রিস্ক নিতে চায় বা রিটায়ারমেন্টে চলে গেছে, তারা ফিক্সড ভেহিকল ইনকামগুলো নিতে চায়। তাদের ওভাবে সহযোগিতা করা যেতে পারে। এতে অনেকে ভাবতে পারে যে রেট কমালে ট্যাক্স আদায় কমে যাবে। কিন্তু না; ট্যাক্স কোনোভাবেই কমবে না। বরং বাড়বে। কারণ এতে বিনিয়োগ বাড়বে। অনেক লোক আছে, যারা ফিক্সড ইনকাম চায়। যেমন ধরেন, এফডিআরের ইন্টারেস্ট রেট কমে যাবে, সেভিংসের রেট কমে যাচ্ছে। কোথায় আসবে তখন বিনিয়োগ; আপনি যদি ক্যাপিটাল মার্কেটকে এর প্রস্তুতক্ষেত্র তৈরি করে না দেন, তাহলে  ননকনভেনশিয়াল রিস্কে যে জিনিসগুলো তৈরি হয়, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বলেন আর ইউনি পে টু, সিক্স, ফাইভ যেগুলো বলেন, এগুলো তৈরি হবে। কারণ, মানুষের বিনিয়োগের একটা ইন্টারনাল স্পৃহা থাকে এবং আমরা জানি যে জাতি যত ইনভেস্ট করবে, তার তত সঞ্চয় হবে। আবার ইনভেস্টমেন্ট হবে, কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে। এগুলো যদি চিন্তা করেন, তাহলে বন্ডের ক্ষেত্রে কিছুটা ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

ইনকামের ট্যাক্সটা দুই বছরের জন্য এক্সামশন অথবা দুই বছরের জন্য হাফ রেট করে দিতে পারলে বন্ড মার্কেটটা গতিশীল হবে। হ্যাঁ, এটা হতে পারে যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইনসেনটিভ দেওয়া হলো। আরেকটা জিনিস বেশ আলোচিত, তা হলো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো বা বড় বড় ব্যাংক বছরের পর বছর ব্যবসা করছে অথচ তাদের ক্যাপিটাল মার্কেটে আসার যে বাধ্যবাধকতার আইন ছিল, তা থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। এটা কীভাবে হলো? কাদের চাপে হলো? এটা কিন্তু কেউ জানে না। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো এ দেশ থেকে প্রফিট নেবে, ব্যবসা করবে, ¯েœা-পাউডার বিক্রি করবে, এ দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রফিট নিয়ে যাবে, অথচ এ দেশের মানুষের সঙ্গে ক্যাপিটাল মার্কেটের মাধ্যমে ভাগিদার করা হবে না, এটা কীভাবে হয়?

একটা আইন পাস করার আগে জনমত নেওয়া হয়। অথচ এ ক্ষেত্রে কিন্তু সে রকম কিছু করা হয়নি। হঠাৎ করে দেখলাম একটা নোটিফেকশন এল, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিকে এ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয় এটি ঠিক হয়নি। জনমত ছাড়া একটা আইন পাস কতটা যৌক্তিক, এখানে প্রশ্ন থেকে যায়।

আর সরকারি শেয়ারের ব্যাপারে বলতে গেলে, সরকার দেশ চালাবে, নীতি তৈরি করবে, আইন প্রণয়ন করবে, প্রয়োগ করবে। কিন্তু সরকার নিজে যদি ব্যবসা করতে আসে, তাহলে তো হবে না। এ জন্য দেখেন, সরকারি যে কোম্পানিগুলো ছিল, সেগুলো বাজারে আনার ব্যাপারে বছরের পর বছর বলতেছে এবং সরকারের মহল থেকে কোনো প্রকারের সদিচ্ছার কমতি নেই এটা নিশ্চিত। অর্থ মন্ত্রণালয় বলেন, অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউই চাচ্ছেন না যে সরকার ব্যবসা করুক। কেন সরকার ব্যবসা করবে? অথচ এক গোষ্ঠী আমলা চক্রের কারণে এটা হচ্ছে না। তো প্রথমে বের করতে হবে এটা কারা চাচ্ছে না।

আরেকটি বিষয়, সরকারি ক্রয়নীতিতেও সমস্যা রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার অফলোড করার ক্ষমতা একমাত্র আইসিবিকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইসিবি নিজেই একটা ব্যুরোক্রেট কোম্পানি অথবা তার এই এক্সপার্টিস আছে কি না, অথবা সে সত্যি সত্যি চায় কি না বা সে উদ্যোগী কি নাÑ এ বিষয়গুলো বিবেচনা ছাড়াই দায়িত্ব দেয়াটাও ঠিক হয়নি। আমার মনে হয় সরকারের ক্রয়নীতির এ বিষয়গুলো সংশোধন করা উচিত।

আমরা জানি যে আমাদের দেশে অনেকগুলো মার্চেন্ট ব্যাংক রয়েছে এবং মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর ওপর দায়িত্ব রয়েছে বেশি বেশি আইপিও নিয়ে আসার। অথচ আমরা বছরে সব মিলিয়ে ২০-২৫টির বেশি আইপিও পাই না। যেখানে হওয়া উচিত ছিল ৫০-এর বেশি। এখানে যে বিতর্কটি রয়েছে তা হলো, কেউ কেউ মনে করেন যে আইপিও বেশি আসা উচিত, আবার কেউ কেউ মনে করেন কম আসা উচিত। আবার কেউ মনে করছেন আইপিও বেশি আসছে, কেউ মনে করছেন বেশি আসছে না। আমরা একটু বাস্তবতার দিকে তাকাতে চাই। যদি ২০১৬ সালের কথা বলি, দেখা যাবে সে বছর মাত্র ১০টি আইপিও এসেছে। আর ২০০৭ সালে এসেছিল ১৮টি। শুধু ২০০৭ নয়, তখন প্রায় প্রতি বছরই ১৭-১৮টি করে আসত। অথচ আজ নয় বছরের ব্যবধানে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ১০টিতে।

যেখানে ক্যাপিটাল মার্কেট সব দিক থেকে বড় হচ্ছে, বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ছে, দেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে, ডেমোগ্রাফির কারণে উৎপাদনক্ষমতা বেড়েছে। সব মিলিয়ে আমরা এশিয়ান টাইগারে পরিণত হচ্ছি, শুধু আইপিওর ক্ষেত্রে এসে দেখা যায় কমে যাচ্ছে। ২০০৭ সালে যেখানে ১৮টি ছিল, এখন সে অনুযায়ী কমপক্ষে ৫০টি আসার কথা। সেখানে কমছে। এটা বিতর্কের কারণে হচ্ছে বলে মনে করি।

আইপিও কমে আসা মানে হচ্ছে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আইপিও কম আসা মানে, আপনি কি চান না ক্যাপিটাল মার্কেট আসুক? আইপিওই হচ্ছে ক্যাপিটাল মার্কেটের মূল জিনিস। সিঙ্গাপুরে ১৫০ পার্সেন্ট, কোনো দেশে ১২০ পার্সেন্ট, ১২৫ পার্সেন্ট অথচ আমাদের দেশে মাত্র ৮, ১০, ১২ পার্সেন্ট। যদিও কেউ ২০-২৫ পার্সেন্টের কথা বলেন, কিন্তু আমার হিসাবমতে কোনোভাবেই ১৫-২০ পার্সেন্টের বেশি হবে না। অর্থাৎ আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।

এখানে প্রশ্ন থাকতে পারে, বাজারে সাবস্ক্রাইব আছে কি না। সেটা তো বাজারই বলে দেবে। এটা তো ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাইয়ের ব্যাপার। আপনি একটি ইস্যু করতে চাচ্ছেন; দিলেন। বিনিয়োগকারীরা চাইলে সাবস্ক্রাইব করলে করবে, না করলে করবে না। আনসাবস্ক্রাইব হবে। এটাই তো নিয়ম। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কাজ হলো হাতে কোনো আইপিও এলে ধরে না রেখে ইয়েস অর নো বলা। অথবা বাজারে ছেড়ে দেওয়া। বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নেবে, তারা সাবস্ক্রাইব করবে কি না।

বছরে যদি ৫০-৬০টা আইপিও দেওয়া না যায় এই ক্যাপিটাল মার্কেটে, তাহলে অ্যানুয়েল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানে (এডিপি) কত পার্সেন্ট কনট্রিবিউট করতে পারছি? একদমই নগণ্য। ব্যাংকের কথা যদি বলেন, ২০১৬ সালে ব্যাংক থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। সেখানে আইপিও থেকে হয়েছে  ৫০০ কোটি টাকার মতো। এখানে তো উল্টো হওয়ার কথা ছিল।

ক্যাপিটালটা তো যাবে ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে। ব্যাংকগুলো করবে মিডটার্ম ফাইন্যান্স, সিজনাল গ্যাপ। আর মূল ফান্ডটা আসবে ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে। আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে উল্টো হচ্ছে। এ জন্য ব্যাংকগুলো যেমন রিস্কের মধ্যে পড়ছে, তেমনি বিনিয়োগকারী বলেন কিংবা ইস্যুয়ার বলেন, ইন্ডাস্ট্রি বলেন, সবাই রিস্কের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।

ক্যাপিটাল মার্কেট কতটা ঝুঁকিপূর্ণ

ক্যাপিটাল মার্কেট তো সব সময়ই রিস্কি মার্কেট হিসেবে পরিচিত। আমাদের রেগুলেটরিও নানাভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে এটি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট। আসলেই ক্যাপিটাল মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ এটা ঠিক কথা। এখানে বিনিয়োগ করতে হলে বুঝেশুনে বিনিয়োগ করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাইমারি মার্কেটের ক্ষেত্রে খুবই কম রিস্ক থাকে। কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেটে নিশ্চিত। ডেইলি যেহেতু প্রাইস আপ-ডাউন করে। একটা কোম্পানির মূল ভিত্তি হচ্ছে কোম্পানির পেছনে কারা আছে, এন্টারপ্রেনার কারা আছে, এই কোম্পানির গত কয়েক বছরের ডিভিডেন্ট ট্রেন্ডটা কী ছিলÑ এই বিষয়গুলো যদি এনালাইসিস না করেন, তবে আপনি তো অবশ্যই ঝুঁকির মধ্যে থাকবেন।

প্রাইমারি মার্কেটের ক্ষেত্রে দেখেন, গত ৫ বছরে ১০৩টি স্ক্রিপ্ট আসছে, তার মধ্যে কয়টা কোম্পানি বসে পড়েছে? কিছু তো থাকবেই। ব্যবসায়িক, সিসটেম্যাটিক রিস্ক যেটা এভয়েড করা যায় না, এটা তো থাকবেই। দেশের অর্থনীতি বলেন, বাজার বলেন, ম্যানেজমেন্ট ফেইলিওর বলেন, ম্যানেজমেন্ট এক্সিডেন্ট বলেনÑ এগুলো তো থাকবেই। কিন্তু ওভারঅল বলতে গেলে, আপনি গত পাঁচ বছরের প্রাইমারি মার্কেটের ইতিহাস দেখলে পাবেন মাত্র ৫ থেকে ১০টা কোম্পানি ইস্যু প্রাইসের নিচে নেমেছে। এটা তো হতেই পারে। ১০০টির মধ্যে ৫-১০টা কোম্পানি নামতেই পারে।

এ জন্য ক্যাপিটাল মার্কেটে যাঁরা আসছেন, তাঁদের বলি আগে প্রাইমারি মার্কেটে আসতে। এরপর বুঝেশুনে ক্যাপিটাল মার্কেটে আসতে হবে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোও এটিই বলে।

আমাদের প্রাইমারি মার্কেট বা সেকেন্ডারি মার্কেট যদি বলেন, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড পি রেশিও হচ্ছে ১৭। আর আমাদের দেশে এটি ১৭-এর নিচে। অর্থাৎ, ঝুঁকিও আমাদের দেশে কম। তবে না বুঝে যদি বিনিয়োগে যান, তাহলে তো ঝুঁকি থাকবেই। আমি আগেই বলেছি, বিনিয়োগের আগে ওই কোম্পানির পাঁচ বছরের হিস্ট্রি নিতে হবে। ওই কোম্পানির সঙ্গে যাঁরা এন্টারপ্রেনিওর আছেন, তাঁদের হিস্ট্রি দেখতে হবে। এবং কোম্পানিটির ব্যবসার ধরন দেখতে হবে। এই তিনটি বিষয় যাচাই করে নিলে ঝুঁকিটা অনেক কম থাকে।

তথ্য পাওয়া না পাওয়া

ক্যাপিটাল মার্কেটে তথ্যই অর্থ। আপনার কাছে যদি সঠিক তথ্য না থাকে, তাহলে আপনার অর্থের বিনাশ হবে। আর তথ্য যদি যথাযথ থাকে এবং বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত যদি সঠিকভাবে নেন, তাহলে আপনি অবশ্যই লাভবান হবেন। ক্যাপিটাল মার্কেটের নিয়ম হলো, সবার কাছে একই সময়ে সঠিক তথ্য যেতে হবে। আমাদের দেশে এই জায়গাটায় ঘাটতি আছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড যেটা ব্যবহার করা হয়, তাকে এক্সটেনসিভ বিজনেস রিপোর্টিং ল্যাঙ্গুয়েজ (এক্সবিআরএল) বলা হয়। অর্থাৎ, সবকিছু অনলাইনে সব সময় থাকতে হয়। এর জন্য এক্সট্রা কোনো টাকার প্রয়োজন নেই। সামান্য কিছু টাকা লাগে আর একটু উদ্যোগের প্রয়োজন। অথচ এটি আমাদের দেশে নেই। কী কারণে কেন রেগুলেটরি অথরিটি এটি করছে না; সেটাই প্রশ্ন।

এটি থাকলে এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার আইন-কানুন থাকবে, আইপিও সংস্থার তথ্য থাকবে, সেকেন্ডারি মার্কেটের সমস্ত তথ্য থাকবে। যে যার মতো করে তথ্য আপডেট করে দেবে বা যার যখন প্রয়োজন হয় এখান থেকে দেখে নেবে। এ জন্যই এক্সবিআরএল সিস্টেমটি চালু করা দরকার।

আমাদের দেশে ব্যাংক বা দু-চারটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ওয়েবসাইটে এ রকম কিছু শেয়ার ডিভিশন বা ইনভেস্টরস ইনফরমেশন বলে একটা জায়গা থাকে। তবে দু-একটা কোম্পানি ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। এর দায়ভার কার? এমন প্রশ্নের ক্ষেত্রে আমি মনে করি, কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছাড়া কাউকে কিছু বলা যাচ্ছে না। এটার একমাত্র দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর। স্টক এক্সচেঞ্জ, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন বা ঢাকা স্টক এক্সেচেঞ্জের এটি নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই তথ্য হালনাগাদ না করে কেউ পার পাবে না। শুধু একটা তথ্য কমিশনকে জানালেই হবে না। একই সাথে তার ওয়েবসাইটে সব তথ্য হালনাগাদ করতে হবে। নতুবা তাদের শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের পুঁজিবাজার ভালো হবেই

পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে যদি বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে বা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে পুঁজিবাজারই ক্যাপিটাল সরবরাহ করার অন্যতম মাধ্যম। ব্যাংকের মাধ্যমে শুধু সিজনাল গ্যাপ দেবে বা মিডটার্ম ফাইন্যান্স করবে। কিন্তু পুঁজি সরবরাহ পুঁজিবাজারের মাধ্যমেই করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীতে যত উন্নত দেশই দেখবেন, ক্যাপিটাল মার্কেটের মাধ্যমেই হয়েছে। এটি আমরা যত দ্রুত বুঝতে পারব, তত দ্রুত দেশের উন্নয়ন হবে।

সরকার সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। সরকার রাস্তাঘাট তৈরি করবে, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল উন্নয়ন ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমেই হবে। ইন্ডাস্ট্রিটা করতে হবে ব্যক্তি উদ্যোগে। এত বড় রাষ্ট্রের উন্নয়ন ব্যক্তি উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়। আর এই ব্যক্তি উদ্যোগের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম হতে পারে ক্যাপিটাল মার্কেট। এ ব্যাপারটা মানতে হবে এবং হবেও এটি। তবে বিষয় হলো, সরকার কত দ্রুত বুঝতে পারে। যত দ্রুত বুঝতে পারবে, আমাদের জন্য ততই মঙ্গল। আর আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেট অনেক ভালো করবে, অনেক দূর যাবে। ক্যাপিটাল মার্কেট মাত্র তার যাত্রা শুরু করেছে।

 আমি বলব, তিনটি বিষয়। যেমন এক. নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে ক্যাপিটাল মার্কেট ছাড়া উন্নয়নের আর কোনো রাস্তা নেই। ক্যাপিটাল মার্কেটকে উন্নয়নের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। দুই. বর্তমানে যারা নিয়ন্ত্রক বা নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো আছে, তাদের স্বচ্ছতার সাথে জবাবদিহি ও মনিটরিং করতে হবে দীর্ঘসূত্রতা না করে। তিন. বিনিয়োগকারীদের বুঝেশুনে বিনিয়োগ করতে হবে। হুজুগে মেতে যেন বিনিয়োগ না করে।

আজকের বাজার: জনাব মাহবুব এইচ মজুমদার, অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার এই মূল্যবান সময় দিয়ে জনগণকে সুন্দর তথ্য দেওয়ার জন্য।


মাহবুব এইচ মজুমদার

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেড।