মাশরাফির বর্ণিল ১৬ বছর

Bangladesh's Mashrafe Mortaza celebrates after dismissing England's Craig Kieswetter for 0 in the third one-day international match at Edgbaston cricket ground in Birmingham July 12, 2010. REUTERS/Philip Brown (BRITAIN - Tags: SPORT CRICKET) - RTR2GCF2

বোলিং আক্রমণে গতি, সুইং আর বাউন্সের মিশেলে আগ্রাসী এক তরুণ পেসার থেকে জাতীয় দলের সাহসী ও দুর্দান্ত সফল এক অধিনায়কে পরিণত হয়ে দলকে ‘টাইগার’ তকমা এনে দেওয়া সেই তরুণ মাশরাফির ক্যারিয়ারের (৮ নভেম্বর ) ১৬ বছর পূর্ণ হলো ৮ নভেম্বর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি সময় প্রতিনিধিত্ব করা মাশরাফিকে এদেশের মানুষ দিয়েছে অকৃতিম ভালবাসা।

২০০১ সালের অনূর্ধ্ব-১৭ এশিয়া কাপে কুয়েতের বিপক্ষে ২৭ বলে ৭৩ রানের একটি ইনিংস খেলে নজরে আসেন মাশরাফি। পাদপ্রদীপের আলোয় ব্যাটসম্যান হিসেবে আসলেও তার পরিচয় মূলত পেসার হিসেবেই। বিকেএসপিতে বোলিং কোচ হিসেবে আসা ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তী অ্যান্ডি রবার্টস তাকে নিয়ে ইতিবাচক কথা বলেছিলেন। তারপরই ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তার টেস্ট অভিষেক। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এগিয়ে গেছেন দুর্বার গতিতে। হয়ে উঠেছেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’।

সাবেক কোচ ডেভ হোয়াটমোরের আদরের ‘পাগলা’ ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো ইনজুরীতে পরে সার্জনের ছুরির নিচে যান। ২০০৪ সালেও ইনজুরির কারণে অনেকদিন মাঠের বাইরে থাকেন ম্যাশ। কিন্তু ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে প্রথম জয়ের দিনে (সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে) বল হাতে ৯-২-৩৬-২, আর ব্যাট হাতে ৩৯ বলে ৩১ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা হন। ২০০৫ সালে ঘরের মাঠে প্রথম টেস্ট ও প্রথম সিরিজ জয়েও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেস দুই ম্যাচে ৯ উইকেট এবং ৯৩ রান করে বাংলাদেশের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন মাশরাফি।
২০০৬ সালে ২৭ ওয়ানডেতে ৪৯ উইকেট সংগ্রহ করে ২০০৬ সালে সকল বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির মালিক হন মাশরাফি। ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ভারতকে পাঁচ উইকেটে হারানোর ম্যাচের পর মাশরাফির ৯.৩-২-৩৮-৪ এর বিধ্বংসী বোলিং স্পেলে ভারতের শক্তিশালি ব্যাটিং লাইন আপ ধসে অলআউট হয়ে যায় মাত্র ১৯১ রানে।
২০০৮ সালে অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন মাশরাফি। ঘরের মাঠে ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবারের মত ওয়ানডে জয়ের পরপরই এই দায়িত্ব পান তিনি। ওই ম্যাচে ১০-৩-৪৪-৪ বোলিং ফিগার নিয়ে প্রায় একাই ধসিয়ে দেন নিউজিল্যান্ডের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপকে।
২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে এক টেস্ট খেলেই দেশের বিমান ধরতে হয় ইনজুরিরই কারণে। ২০১০ সালে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে প্রথমবারের মত তাদের মাটিতে ওয়ানডে ম্যাচে পরাজিত করে। এই ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচও নির্বাচিত হন অধিনায়ক মাশরাফি।
ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ৪-০ তে নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। যদিও ইনজুরি তাকে প্রথম ম্যাচের পরই ছিটকে দেয় আবার। তবে মাশরাফির জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্ট দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে না খেলতে পারা। ২০১২ সালে দেশের মাটিতে এশিয়া কাপে আবার দলে ফিরেন তিনি।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সকে ২০১২ ও ২০১৩ মৌসুমের শিরোপা জিতিয়ে আবারও ইনজুরিতে পড়েন তিনি। ২০১৪ সালে আবার জাতীয় দলের সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অধিনায়ক হন তিনি। তার নেতৃত্বে জিম্বাবুয়েকে দুই ফরম্যাট মিলিয়ে ৮-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ মাশরাফির অধীনে প্রথমবারের মত কোন বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছায়।
২০১৬ সালের রকেট বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় খেলায় ২ উইকেট সংগ্রহের মাধ্যমে মোট ২১৬ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারী হিসাবে তুলে ধরেন নিজেকে। ২০১৭ সালে ৬ই এপ্রিল বাংলাদেশ বনাম শ্রীলংকা সিরিজের শেষ টি২০ দিয়ে আন্তর্জাতিক টি২০ খেলা থেকে অবসর নেন। ম্যাশের অধীনে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে উঠে বাংলাদেশ।

টেস্ট ক্যারিয়ারে ৩৬টি ম্যাচ খেলেছেন মাশরাফি। নিয়েছেন ৭৮টি উইকেট। গড় ৪১.৫২, ইকনোমি রেট ৩.২৪। রান করেছেন ৭৯৭। ওয়ানডে খেলেছেন ১৮২ ম্যাচ। উইকেট শিকার করেছেন ২৩২টি। রান করেছেন ১৬০৪। সেরা বোলিং ফিগার ২৬ রানে ৬ উইকেট। আর টি-টোয়েন্টিতে ৫৪ ম্যাচ থেকে নিয়েছেন ৪২টি উইকেট। রান করেছেন ৩৭৭।

আগের সেই গতি, বাউন্স আর নেই, তবে যে সাহস আর অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় তার কাছ থেকে সেটাই তরুণ খেলোয়াড়দের উৎসাহিত করে। ক্যারিয়ারে বহুবার ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছেন ম্যাশ। শল্য চিকিৎসকের অস্ত্রোপচারের জন্য গিয়েছেন বহুবার। সব শেষ অস্ত্রোপচারের সময় মাশরাফির অস্ট্রেলীয় শল্য চিকিৎসক ডেভিড ইয়াং তো রাখঢাক না করে সরাসরি বলেই দিয়েছিলেন, আর একবার অস্ত্রোপচার হলে ম্যাশ চিরদিনের জন্য পংগুও হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু অদম্য মাশরাফির উত্তর, ‘দেশের হয়ে খেলতে খেলতে যদি আমি মারাও যাই তবু খেলা বন্ধ করতে পারব না।’

মাশরাফিকে এই সংগ্রামী খেলোয়ারী জীবনে বিশ্বের বাঘা বাঘা ক্রিকেট তারকারা কি বলেছিলেন:-
ক্যারিবীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তী ব্রায়ান লারার উক্তি “আমার দুর্ভাগ্য, আমি মাশরাফির সাথে এক টিমে খেলতে পারিনি”,
এডাম গিলক্রিস্টের উক্তি।“অধিনায়ক তো অনেকেই আছেন, মা আছেন কয়জন?”
স্যার ভিভ রিচার্ডস বলেছিলেন “আমার সৌভাগ্য, আমাকে কোনোদিন মাশরাফির বল মোকাবেলা করতে হয় নি”।
সাবেক প্রোটিয়া অধিনায়ক শন পোলক বলেন “তোমরা আমাকে একজন মাশরাফি দাও, আমি তোমাদের এগারোটা “সোনার টুকরো” (ক্রিকেটার) উপহার দিবো”।


“নেতা, মানুষ আর খেলোয়াড় এই ৩টি শব্দ যোগ করলে মাশরাফির মতো কোনো ক্রিকেটার এর আগে কোনোদিন ক্রিকেটবিশ্ব দেখে নি” সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হোসাইন।

“জীবন মানেই ক্রিকেট ম্যাচ নয়। জীবন মানেই আপনি কয়টা উইকেট পেলেন আবার কতো বলে কতো রান করলেন সেই হিসেব নয়। আপনি কত বড় সুপারস্টার হলেন সেটাও নয়। এক পর্যায়ে এসবের কোনো মূল্যই থাকবে না। আমি মনে করি আপনি কাউকে ভালোবাসছেন আবার কেউ আপনাকে ভালোবাসছে এটাই হলো জীবন। আমি এভাবেই জীবনটাকে দেখি”, এটাই মাশরাফির নিজের জীবন দর্শন। এমন ভাবনা তাকেই মানায়।
এমন অধিনায়ক, এমন সাহসী যোদ্ধা, এমন নেতা ক্রীকেট ইতিহাসে বিরল। এদেশের ক্রিকেটকে অনেক অর্জন এনে দিয়েছেন তিনি। কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি মাশরাফির এই বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ১৬টি বছর।

আজকের বাজার : সালি / ১৫ নভেম্বর ২০১৭