যেভাবে যাবেন হামহাম জলপ্রপাত

নৈসর্গিক হামহাম জলপ্রপাতের অবস্থান বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরতি বনাঞ্চলের কুরমা বনবিট এলাকায়। ২০১০ সালের শেষের দিকে একদল পর্যটক এই জলপ্রপাত আবিস্কারের দাবী করেন।

কিন্তু স্থানীয়দের দাবী, এই জলপ্রপাতের অস্তিত্বের কথা তারা আগে থেকেই জানতেন। দুর্গম জঙ্গলে ঘেরা এই জলপ্রপাতটির উচ্চতার নির্ভরযোগ্য সঠিক পরিমাপ এখনো জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, এর উচ্চতা ১৩৫-১৬০ ফুটের মধ্যে, যেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের উচ্চতা ১৬২ ফুট।হামহাম- শব্দটা একটু অপরিচিত মনে হওয়া স্বাভাবিক। কারণ দুটো: এক, এই জলপ্রপাত পরিচিতি পেয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। দুই, এই শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে এখনো পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।

কেউ কেউ ধারণা করেন, ‘হাম্মাম’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি, যার অর্থ গোসলখানা। আবার সিলেটি উপভাষায় ‘আ-ম আ-ম’ বলে পানির তীব্র শব্দকে বোঝানো হয়। তাই অনেকে ধারণা করেন, এখান থেকেই ‘হামহাম’ নামের উৎপত্তি। এই জলপ্রপাতের আরেক নাম ‘চিতা ঝর্ণা’ হলেও হামহাম নামেই এটি অধিক পরিচিত।

ঝর্ণার যৌবন হলো বর্ষাকাল। তাই বর্ষাতেই এই অ্যাডভেঞ্চার সব থেকে বেশি থ্রিলিং। হামহাম জলপ্রপাতে সরাসরি গাড়ি নিয়ে পৌছানোর কোনো রাস্তা নেই। কয়েক কিলোমিটার দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা আপনাকে হেঁটে যেতে হবে। আর এই রাস্তা পাড়ি দেওয়ার জন্যই এই যাত্রা ভ্রমণের থেকে বেশিকিছু!

ঠিকানা:
ঝর্নাটির কাছে যাওয়ার সুবিধার জন্য এখনো কোনো সরকারী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ঝর্নায় যেতে হলে কুরমা বনবিটের চাম্পারায় চা-বাগান হয়ে যেতে হয়। চাম্পারায় চা-বাগান থেকে কলাবনপাড়ার দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। কলাবনপাড়া থেকে রাস্তা শুরু হবে চা-বাগানের মধ্য দিয়ে। বনের শুরুতেই দুটি রাস্তা পাওয়া যাবে। ডান দিকের রাস্তা দিয়েই যাওয়া সুবিধাজনক। রাস্তা দিয়ে ঢুকতেই জানা-অজানা অনেক ধরণের গাছ চোখে পড়বে। আর সাথে চোখে পড়বে নানান প্রজাতির বাঁশ। মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট সাঁকো পার হতে হবে। যাবার পথে চোখে পরবে সারি সারি কলাগাছ, জারুল, চিকরাশি, কদম গাছ। ভাগ্য ভাল থাকলে দেখা পেতে পারেন চশমাপড়া হনুমানের!রাস্তায় সবথেকে উঁচু এবং খাঁড়া যে পাহাড় তার নাম মোকাম টিলা। এটি অতিক্রম করা একটু কষ্টসাধ্য বটে! তবে মন খারাপ করতে হবে না। এর পাশের পাথুরে প্রাচীরগুলো দেখলে আপনার মন ভালো হতে বাধ্য! এই মোকাম টিলার পাশেই আরেকটি ছোট ঝর্না আছে যা স্থানীয়ভাবে ‘সীতাব’ নামে পরিচিত। অপরূপ এই ঝর্ণাটি দেখতে ভুলবেন না।

বর্ষাকালে জোঁকের উপদ্রব বেশি হয়। তাই এই ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। এই পাহাড়ি পথ একসময় আপনাকে স্বচ্ছ জলের ¯্রােতে নামিয়ে দিবে। এই স্বচ্ছ শীতল জলের ¯্রােত মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দেয়। স্বচ্ছ জলের নিচে তাকালেই চোখে পড়বে বিশাল বিশাল পাথর! এই জলের ¯্রােতের উৎপত্তি হয়েছে হামহাম জলপ্রপাত থেকে। তাই এই ¯্রােতে নেমে পড়ার কিছুণের মধ্যেই আপনি ঝর্ণার পানি পড়ার শব্দ শুনতে পাবেন। অপূর্ব এই বনেই মধ্যে প্রমত্তা হামহামের পানির শব্দ এক অভূতপূর্ব অনুভূতি!চারিদিকের শীতল শান্ত পরিবেশের মধ্যে হামহামের জলধারা এক অদ্ভুত ছন্দের সৃষ্টি করে! এই অদ্ভুত রোমাঞ্চকর পরিবেশে একবারও চোখ ফেরানোর চিন্তা আসে না। প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু থেকে গড়িয়ে পড়া ¯্রােতধারা এগিয়ে যাচ্ছে পাথর থেকে পাথরে! আর এই শীতল পানি স্পর্শ করার অনুভূতিও অসাধারণ।

পর্যটকদের অনেকেই জলপ্রপাতের উপরে ওঠার জন্য চিন্তা করেন। কিন্তু এটি খুবই বিপদজনক। কারণ এতে ওঠার কোনো রাস্তা নেই। এছাড়াও এই ঝর্নার আশেপাশের মাটি খুবই পিচ্ছিল। তাই এর উপরে ওঠার চেষ্টা করা মানে জীবন বাজি রাখা! আরেকটি কথা, অবশ্যই সন্ধ্যা হওয়ার আগে কলাবনপাড়ায় ফিরতে হবে। সেজন্য ফেরার জন্য কমপে ৫ ঘন্টা সময় হাতে রাখতে হবে। সূর্যাস্তের পরে জঙ্গলে থাকা খুবই অনিরাপদ।

কিভাবে যাবেন:
বাস, ট্রেন বা বিমান যেভাবেই যান না কেন, প্রথমে আপনাকে যেতে হবে শ্রীমঙ্গলে। ঢাকা থেকে শ্যামলী, হানিফ ও এনা পরিবহনের বাস সরাসরি শ্রীমঙ্গল যায়। ভাড়া পড়বে ৩৮০-৪০০ টাকা। এছাড়া ঢাকা-সিলেট এর মধ্যে চলাচলকারী যেকোনো আন্তঃনগর ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যেতে পারবেন। সেেেত্র ভাড়া দিতে হবে ১৭৫-৩৫০ টাকা। আর বিমানে যেতে চাইলে সরাসরি সিলেটে চলে যেতে হবে।তারপর সেখান থেকে শ্রীমঙ্গলে আসতে হবে।

শ্রীমঙ্গল থেকে গাড়ী ভাড়া করে সরাসরি কলাবনপাড়া চলে যাওয়া যাবে। যে গাড়িতে যাবেন, সেটি অবশ্যই যাওয়া ও আসার জন্য ভাড়া করবেন। কারণ ঐ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না। তাই শুধুমাত্র যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করলে আসার সময় যথেষ্ট সমস্যায় পড়তে হতে পারে। সিএনজি নিয়ে গেলে ভাড়া ১২০০-১৮০০ টাকার মধ্যে হবে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কলাবনপাড়া যেতে দেড় থেকে দুই ঘন্টা সময় লাগবে। অন্যদিকে কলাবনপাড়া থেকে হামহামে যেতে-আসতে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগে। রাস্তা খারাপ হলে একটু বেশী লাগতে পারে। তাই শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সকাল সাড়ে ছয়টার ভেতরে রওয়ানা হওয়াই ভাল।

শেষ কথা:
দুটি পাতা,একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট। নয়নাভিরাম সিলেটে পর্যটন শিল্পের ঘাটতি নেয়। সিলেট ঐতিহাসিক নিদর্শনে যেমন ভরপুর, তেমনি ভরপুর সবুজে ঘেরা প্রকৃতিতে। এখানে যেমন রয়েছে ছোট বড় চা বাগান, তেমনি রয়েছে পাহাড়ের গা ঘেঁষে বেয়ে আসা অসংখ্য পাহাড়ি ঝর্ণা। হামহাম তাদের মধ্যে অন্যতম। স্থানীয় লোকদের কাছে এ ঝর্ণা অনেকদিন আগে থেকেই পরিচিত। তবে তা এতোদিন প্রকৃতি প্রেমীদের চক্ষুর আড়ালে ছিলো, বিধায় এর পর্যটন ব্যাবস্থা নাজুক। হামহামের মতো সিলেটে এমন অনেক ঝর্ণা রয়েছে, যা আজও পর্যটন শিল্পের আওতার বাইরে।

আজকের বাজার: আরআর/ ২৭ এপ্রিল ২০১৭