রোগীর খারাপ কিছু হলে ডাক্তারকেই ধরতে হবে আগে

মশিউর রহমান খসরু:

খ্যাতিমান ছড়াকার রোমেন রায়হানের সদ্য রচিত ছড়া দিয়েই শুরু করি।
হারামজাদা ডাক্তারকেই ধরতে হবে পয়লা
রোমেন রায়হান
উন্নয়নের বইছে জোয়ার, ডাক্তার তার ময়লা
হারামজাদা ডাক্তারকেই ধরতে হবে পয়লা।
অফিস ছাড়াই বেতন গোণে, রোগী দেখে স্টাফরা
সুযোগ পেলেই ডাক্তারদের থাপড়া
ডাক্তাররা ঔষধচোর, মন্ত্রী প্রমাণ পাইছে
ডাক্তারদের চাকরী এবার খাইছে
বাড়ি যাওয়ার টিকেট কাটো
রোগী দেখুক রাজনীতিকের বাপরা
সুযোগ পেলেই ডাক্তারদের থাপড়া।।

এ কথা অনস্বীকার্য যে চিকিৎসা কেন্দ্রে মান সম্পন্ন ও যথেষ্ট পরিমাণে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারার মাঝেই, চিকিৎসক -রোগীর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার ও কর্মেেত্র চিকিৎসকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি নিহিত। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে চিকিৎসা কেন্দ্রে আগত রোগীদের অধিকার বা সিটিজেন চার্টার নিয়ে অনেক কথা হয় কিন্তু চিকিৎসা সেবা প্রদানে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসকের অধিকার নিয়ে কোন চর্চা হয় না।

সাধারণ মানুষ জানতেই পারেন না কে ডাক্তার আর কে ডাক্তার নয়। অবশ্য ষোল কোটি ডাক্তারের দেশে পাস করা ডাক্তার ছাড়া সকলেই চিকিৎসা বোঝে। সবাই বিশেষজ্ঞ শুধু পাস করা ডাক্তারই অজ্ঞ।

সবাই বিশেষজ্ঞ শুধু পাস করা ডাক্তারই অজ্ঞ।
মোস্তফা জামান। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার যুগীহুদা গ্রামের বাসিন্দা। সর্বসাকুল্যে অষ্টম শ্রেণী পাস। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন মসজিদের ইমাম। অত:পর তিনি শুরু করলেন আদম ব্যবসা। আদম ব্যবসায় নেমে বিভিন্ন মানুষের টাকা আত্মসাৎ করেন। একপর্যায়ে তিনি কিছুদিনের জন্য জেল খাটেন। কিন্তু মানুষের সেবা করার জন্য যার জন্ম, তাকে কি জেল জরিমানা করে দমিয়ে রাখা যায়!

তিনি জেলখানা থেকে বের হলেন একজন ডাক্তার হিসেবে। যেনতেন ডাক্তার নন এমবিবিএস(ঢাকা), পিএইচডি(ইন্ডিয়া) আরও অনেক ডিগ্রী সাথে করেই তিনি জেল থেকে বের হয়ে আসেন। চর্ম যৌন এবং মেডিসিন স্পেশালিস্ট হিসেবে প্র্যাকটিস শুরু করেন নরসিংদী অঞ্চলে। কিন্তু ফখরুদ্দীন মইনুদ্দীন আমলে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন, খুঁজে পাওয়া গেল না। (ডিগ্রী করতে গিয়েছিলেন, বোধহয় লন্ডনে!!!)

একবার মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দিল!! কিন্তু আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল হাইকোর্ট!! তিনি হাইকোর্টে রিট করলেন তাকে যেন জামিন দেয়া হয় এবং হয়রানি না করা হয়। বিজ্ঞ আইনজীবিরা তার হয়ে লড়লেন। তিনি কিছু কাগজপত্র জমা দিলেন কোর্টে যাচাই করার জন্য!! মহামান্য হাইকোর্ট যতদিন না কাগজপত্র জাল বলে প্রমাণ হচ্ছে ততদিন তাকে বিরক্ত না করতে নির্দেশ দিলেন।

তারপর বোধহয় ১০ বছর পার হয়ে গেছে। মহামান্য হাইকোর্ট তার পিএইচডি ‘র কাগজ জমা রেখেছেন কিন্তু তার এসএসসি পাশের কাগজ জমা নেন নি। হাইকোর্টের আদেশেই উল্লেখ করা হয়েছে যে তিনি কোলকাতা থেকে অল্টারনেট মেডিক্যাল সায়েন্সে এমবিবিএস! ডিগ্রি নিয়েছেন যা স্বীকৃত চিকিৎসা শিা নয়; অতপর পিএইচডি পিচব্লেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা থেকে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেরই অনুমোদন নেই, যার প্রতারণা থেকে সর্বসাধারণকে সতর্ক করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও শিা মন্ত্রণালয়ের প হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশ কম্বাইন্ড মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিসিএমডিসি) নামে রাষ্ট্র স্বীকৃত কোন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে তিনি নিবন্ধিত। রাষ্ট্রের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। বিএমডিসি’র আইন দ্বারা সকল চিকিৎসকরা নিয়ন্ত্রিত।

বিএমডিসি’র আইন অনুযায়ী এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রীধারী যারা বিএমডিসি-তে নিবন্ধিত কেবলমাত্র তারাই চিকিৎসা প্রদান করতে পারবেন এবং তারাই নামের পূর্বে ডাঃ লিখতে পারবেন।

মোস্তফা জামানের মতো ডাক্তার/বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এদেশের সকল প্রান্তে জন্ম নিয়েছে, খোদ ঢাকা শহরেই অসংখ্য। তাদের কেউ কেউ আবার টেলিভিশনে চ্যানেল কিনে চিকিৎসা বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে শ্যামলীর আদাবর রিংরোডে এস চক্রবর্তী, মোহাম্মদপুরে সফিউল্লাহ প্রধান, পান্থপথের আলতাফ হোসেন সরকার যাদের নেই কোন মেডিক্যাল শিা, যারা বিএমডিসি স্বীকৃত চিকিৎসকই নন অথচ রাজধানীতেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেজে করছেন প্রতারণার জমজমাট ব্যবসা। যাদের হাত আবার বেশ লম্বা। মাসোহারা পায় থানার পুলিশ, কম যায় না সাংবাদিকরাও! গেলেই মেলে একফালী চাঁদ।
ভুয়া চিকিৎসক, ভুয়া ডায়াগনোস্টিক সেন্টার বন্ধ না করতে পারলে জাতিকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে। প্রতারণার স্বীকার হতে পারে যে কেউ যেকোন সময়। ভুয়া চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসার গ্লানি পেতে হয় নিবন্ধিত চিকিৎসকদেরকেও যা অনেক কষ্টের, অপমানের।

সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি আমার অনুরোধ সংবাদ শিরোনামে ভুয়া চিকিৎসকে “ভুয়া চিকিৎসক”ই লিখুন শুধু চিকিৎসক নয়, রোগীর ভুল চিকিৎসার অভিযোগকে অভিযোগ আকারেই লিখতে পারেন- সিদ্ধান্ত হিসেবে নয়।

চিকিৎসা ভুল না সঠিক তা নির্ণয় করার যোগ্য হলেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ টিম। অনেক সময় অনেক বন্ধুর রিপোর্টিং এ অনিচ্ছাকৃত ভুলটি হয় যাতে অপমানিত হন গোটা চিকিৎসক সমাজ যা মোটেই কাম্য নয়। চিকিৎসকরা তাদের সঠিক কাজ করার আগ্রহ হারালে তিগ্রস্ত হবো আমরা সবাই, সমগ্র জনগণ এবং রাষ্ট্র। চিকিৎসকদের কাজের সঠিক পরিবেশ তৈরি করে যথার্থ আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

মশিউর রহমান খসরু, উপদেষ্টা সম্পাদক, বিডি হেলথ নিউজ
এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর
ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ
বিএসএমএমইউ