কোল্ড স্টোরেজে জায়গা কম,লাল পাকরি আলু’ই সমাধান

উদ্ভাবন

ড. এফ এইচ আনসারী:

আমাদের দেশের অন্যতম অর্থকরী সবজি আলু। আবার দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পুষ্টিকর ও সহজলভ্য খাবারের মধ্যে আলু অন্যতম। চাইলে এই আলুকে দীর্ঘদিন সঠিকভাবে সংগ্রহ করা যায়। অনেকসময় অধিক উৎপাদনের ফলে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সংরক্ষণের অভাবে এবং কোল্ড স্টোরেজের স্বল্পতার কারণে এই আলু নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন।

যদিও আলু আমাদের দেশের প্রধান ফসল না। তবে দেশে প্রচুর আলু উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। দেশে উৎপাদিত আলু সর্বোচ্চ ৪৫-৫০ লক্ষ টনের মতো কোল্ড স্টোরেজের মধ্যে রাখা সম্ভব হয়। বাকিগুলো কৃষক তার বাড়িতে রেখে দেন বা কোনভাবে ব্যবহার করে শেষ করেন ফেলেন। সমস্যা হলো, এক্ষেত্রে কৃষক যতটা লাভবান হবার কথা ছিল, ততটা হতে পারেন না। অন্যদিকে কৃষক অধিক আলু উৎপাদন করছে কিন্ত সেটা সংরক্ষণ করে রাখতে পারছে না। কারণ সে অনুপাতে কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা বা ধারণ ক্ষমতা সীমিত। ফলে অতিরিক্ত আলু রাখার জায়গা নেই। যেসব জাতগুলো আমাদের দেশে উৎপাদিত হয়, বিশেষ করে মোটকা, কারিনাসহ আরো কিছু জাত আছে যেগুলো কোনভাবেই কোল্ড স্টোরেজে না রাখলে, বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। আবার সংখ্যায় এগুলো এতো বেশি উৎপাদন হয় যে, ঘরে রেখে বেশিদিন এগুলো খেতে পারবেন না, নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে কী করবেন? কোটি টাকা খরচ করে আরো কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করব, নাকি বিকল্প কিছু চিন্তা করব।

আসলে আলুর বিভিন্ন জাত আছে। একেক জন একেক রকমের জাতের আলু পছন্দ করেন। লাল পাকরি আছে, লাল বিলাতি আছে। অনেকে বাজারে ছোট ছোট লাল রঙের আলু পছন্দ করে এবং সেটাই কিনে নিয়ে যান। এগুলো বিদেশিরাও কিনে নিয়ে যায় আবার আমরাও কিনি। আবার পাঁচ তারকা হোটেলে গেলে দেখি, তারা ছোট ছোট আলু ফ্রাই করে দিচ্ছে আর আমরা সেটাই খেতে পছন্দ করি। তাহলে কি দেখছি মানুষের চাহিদা একদিকে, আর আমরা উৎপাদন করছি অন্যটা, আবার উৎপাদনের অতিরিক্ত আমরা সংরক্ষণও করতে পারছি না। কিন্ত আলু উৎপাদন করা তো আর বন্ধ করা যাবে না।

আমাদের দেশে প্রচুর আলু রয়েছে এর মধ্যে দেশি লাল পাকরি বেশি পরিচিত ও মানুষের কাছে সমাদৃত। তবে এই আলুর উৎপাদনের হার অনেক কম। এটা ছোট বড় বিভিন্ন সাইজের হয়। আমরা এই লাল আলুকে সিরাক্সিন প্রসেসে একটা প্রক্রিয়ায় নিয়ে এসেছি। এটা চার পাঁচ বছরের গবেষণায় পিউরিটি করে করে নির্দিষ্ট একটা সাইজে নিয়ে এসেছি। এখন আর সেটা ছোট বড় হয় না। মোটামুটি ৪৫ থেকে ৫০ গ্রাম বা ৬০ গ্রাম ওজনের হয়। এর উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩০ থেকে ৩২ টনের মতো। বিদেশি আলুর তুলনায় প্রায় সমান এসব আলুর উৎপাদন। তাহলে আমরা লাল পাকরি উৎপাদন করতে পারছি অনায়াসে, কারণ এর চাহিদা আছে। কৃষকরা উৎপাদনের পর এর মূল্য যেমনি ভালো পায়, তেমনি মৌসুমের শেষের দিকেও লাভ থাকে ভালো। কিন্ত সমস্যা হলো অধিকহারে উৎপাদিত আলু কৃষকরা রাখবে কোথায়? এ জন্য কৃষকরা নিরুপায় হয়ে কম মূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছে, না হলে গবাদিপশুকে কেটে খাবার হিসেবে খাওয়াচ্ছে। তাহলে আমরা করবো কী?

দেশীয় জাতের আলু কৃষক ঘরে রেখে খেতে পারে। গত ৪/৫ বছর ধরে আমাদের দেশে আশি থেকে নব্বই লাখ টন আলু উৎপাদিত হয় । তার মানে প্রতি বছরের হিসাবে দেখা যায়, প্রায় ৭ লাখ টন আলু প্রতি মাসে থাকে। আর তাহলে সেটা তিন চার মাসে যেয়ে হয় প্রায় ২৫ লাখ টন যদি আমরা উৎপাদন করতে পারি। এর উৎপাদন হার বিদেশি আলুর প্রায় সমান, যেটা ঘরে রেখে খাওয়া যায়। তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সেটা কিভাবে? যেহেতু ৫০-৬০ লক্ষ টন আলু আমরা কোল্ড স্টোরেজে রাখতে পারি, তার সাথে যদি আরো ৩০ লাখ বাড়তি উৎপাদন হয়,তাহলে মোট ৮০ লাখ টন আমরা উদ্বৃত্ত রাখতে পারবো। তবে সেটা দেশি পাকরি জাতের হতে হবে। এর ফলে কৃষককে পচনের ভয়ে দ্রুত আলু বিক্রি করতে হবে না। তারা পর্যায়ক্রমে এই জাতের আলু ঘরে সংরক্ষণ করতে পারবে এবং সময়মতো বিক্রি করতে পারলে অধিক মূল্যও পাবে।

আসল কথা হলো, আমাদের দেশের লাল আলু ভর্তা করে খাওয়া যায়, সব্জির মধ্যে দিয়ে খাওয়া যায়, ভাজি করে খাওয়া যায়, মাছ মাংসের মধ্যে দিয়ে খাওয়া যায়। এর টেস্টও অনেক বেশি, তিন চার মাস ঘরে রেখে দিলেও, এ আলু নষ্ট হয় না। এসব বিবেচনায় আমাদের দেশে লাল পাকরি উৎপাদনের জন্য কৃষককে উৎসাহ দেয়া উচিত। ফলে কৃষক হারভেস্টের সময়ই এ আলু কেজিতে ১০-১৫ টাকায় বিক্রি করতে পারবে, আর অন্য সময় ২৫-৩০ টাকা করে বাজরে বিক্রি করতে পারবে। ফলে আমরা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিওসহ সবাই মিলে লাল পাকরি আলু চাষে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে, কোল্ড স্টোরেজের সমস্যার সমাধান অনেকাংশেই কমে আসবে। লাল পাকরি আলু কৃষক সহজেই ঘরে রাখতে পারছে, বেশি দামে বিক্রি করতে পারছে, অল্পতে নষ্টও হয় না। এতে কৃষকরা উপকৃতও হবে।

লাল পাকরি-১
*আকর্ষনীয় আলতা লাল বর্ণের আলু
*জীবন কাল ৭৫-৮০ দিন
*গাছ প্রতি আলুর সংখ্যা ১৫ থেকে ২২টি
*বপন সময় ১ম নভেম্বর ৩০ নভেম্বর
*একর প্রতি ফলন ৮.৭১ থেকে ১১.২৫ মেট্রিক টন

লাল পাকরি আসলে আমাদের দেশে কয়েকশ’ বছর ধরেই উৎপাদন হচ্ছে। একসময় একই গাছে বিভিন্ন সাইজের ছোট বড় আলু পাওয়া যেত। বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী অধ্যাপক সিদ্দিক, তিনি আলু নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে এই পাকরি আলুর জাতের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। তিনি আমাদের সাথে ৫/৭ বছর ধরে কাজ করছেন। কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি দেখেছেন, প্রতিটা আলু ৫০-৭০ গ্রাম ওজন পর্যন্ত হয়। এই জাতের আলু এসিআই উন্নত করেছে এবং রেজিস্ট্রেশনও করেছে। 

এসিআই এ জাতের আলুর বীজ উৎপাদন করছে, সংরক্ষণ করছে এবং কৃষকের কাছে মানসম্মত বীজ পৌঁছ দিচ্ছে। অনেক এনজিও, বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা আমাদের কাছ থেকে আলু বীজ কিনে নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষকদের বিতরণ করছে। সেখানকার লবণাক্ত জমিতে একসময় আলু চাষ হতো, হতো না-এমন একটা অবস্থা ছিলো। এখন সেখানেও এই জাতের আলু চাষ হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের চরে এ আলু চাষ করা সম্ভব। আবার কৃষক তার বাড়ির আশপাশে যতটুকু জায়গা আছে, সেখানে পাকরি জাতের উন্নত আলু চাষ করে সারা বছরের আলু উৎপাদন করতে পারছে। তার ঘরে খাটের নীচে রেখে দিয়ে সারাবছর খেতে পারছে। আসলে অন্যান্য জাতের আলু তাপ সহনশীল নয়। এ কারণে চাইলেই আপনি ঘরের মধ্যে আলু রেখে দিতে পারবেন না। উৎপাদনের পর চলতি জাতের আলু বস্তায় করে অবশ্যই কোল্ড স্টোরেজে নিয়ে রাখতে হবে। আমাদের দেশে কোল্ড স্টোরেজের ধারণক্ষমতা ৫০ লাখ টনের বেশি নয়। যদি এক লাখ বা আশি নব্বই লাখ টন উৎপাদন হয় তাহলে অতিরিক্ত আলু আপনি কী করবেন? আপনাকে হয় তা স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে দিতে হবে, নয়তো কেটে গবাদিপশুকে খাওয়াতে হবে, না হয় নিজেদের খেয়ে ফেলতে হবে। এ সমস্যার জন্য আমাদের দেশি জাতের লাল পাকরি চাষই সঠিক সমাধান হতে পারে।

ড. এফ এইচ আনসারী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও
এসিআই এগ্রিবিজনেস

আজকের বাজার:এলকে/সালি/এলকে ১৫ নভেম্বর ২০১৭