রণবীর আর জ্যোতির কথা

মানুষ ভাব প্রকাশ করে কথা বলে। কিন্তু ভাব প্রকাশে প্রাণীরাও কি কথা বলে? তাদের রয়েছে নিজেদের ভাষা। যেমন করে কথা বলে রণবীর আর জ্যোতি। তাদের দেখতে হলে তাদের ভাষা বুঝতে হলে চলে যেতে হবে মিরপুর চিড়িয়াখানায়। যেভাবে গিয়েছিলাম আমরাও।তাহলে শুনুন রণবীর আর জ্যোতির কথা।

মাংসের বড় দুটি টুকরা কাঠের পাটাতনে রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে মুখ বের করল জ্যোতি। হেলেদুলে এগিয়ে এল। দীর্ঘ শ্বাস টেনে মাংসের ঘ্রাণ নিল। কিন্তু চেখে দেখল না। বেশ আয়েশি ঢঙে আট-দশ কদম হেঁটে বসে পড়ল রোদে। এমন সময় বিশাল হাই তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল রণবীর। শুরু হলো রাজকীয় পায়চারি। এই মিনিট তিনেক, তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে এগিয়ে গেল জ্যোতির কাছে।

রণবীরের এগিয়ে আসা দেখে জ্যোতিও উঠে দাঁড়াল। মুখ বাড়িয়ে রণবীর ও জ্যোতি কিছুক্ষণ মুখ নাড়াল। কী একটা সংকেতে ভাব বিনিময় করল! কিন্তু মাংসের টুকরো মুখে পুরল না। ঘণ্টাখানেক মাংসের দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল। ঘড়ির কাঁটায় দুটো বাজতে না বাজতে জ্যোতি-রণবীর একসঙ্গে খাওয়া শুরু করল। পুরোটা খেল না, কিছুটা রেখে দিল। সম্প্রতি রণবীরের সঙ্গে এভাবে সুখের সংসার করতে দেখা গেল বেঙ্গল টাইগার জ্যোতিকে।

মিরপুরে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় রয়েছে ছয়টি বেঙ্গল টাইগার। এগুলোর মধ্যে সুন্দরবনে জন্ম নেওয়া বুনো বাঘ কেবল জ্যোতি। বাকি পাঁচটি বেঙ্গল টাইগারের জন্ম মিরপুরের চিড়িয়াখানায়। এদের বাবা-মায়ের জন্মও সুন্দরবনে ছিল না। আনা হয়েছিল ভারতের মধ্যপ্রদেশের চিড়িয়াখানা থেকে। মধ্যপ্রদেশের বাঘ রাজা ও প্রমীলার শাবক রণবীর এখন জ্যোতির সঙ্গী।

ছয় বছর বয়সী বাঘিনী জ্যোতির জীবনটা বড়ই কষ্টে ভরা। ওরা ছিল দুই বোন, এক ভাই। ২০১২ সালের ১৪ মে সুন্দরবনে মধু আহরণ করে ফেরার পথে কৌশলে এক বাঘিনীকে তাড়িয়ে তিনটি বাঘের বাচ্চা নিয়ে এলাকায় ফেরে সাতজনের একটি বনজীবী দল। তিন দিন চেষ্টা চালিয়ে সংঘবদ্ধ পাচার চক্রের সদস্য আবু ইছা, নুরুজ্জামান গাজী, মোস্তফা ও আমিনুরের কাছে বাচ্চাগুলো মাত্র ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। পরে সাতক্ষীরা শহরের একটি পাচার চক্রের সদস্যদের কাছে বাচ্চাগুলো ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। এরপর তা বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়। প্রায় এক মাস পর ১১ জুন সকালে রাজধানীর শ্যামলী ২ নম্বর সড়কের ১৩/১২ নম্বর বাসার নিচতলার ফ্ল্যাট থেকে তিনটি বাঘের বাচ্চাকে উদ্ধার করে র‌্যাব। গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সের ছাত্র জাকির হোসেন ও তাঁর মা জাহানারা বেগমকে। এরপরই বাচ্চা তিনটির নাম হয় জ্যোতি, জয় ও জুঁই। র‍্যাব হেফাজত থেকে বাঘের বাচ্চাগুলো হাতিরপুলে একটি ব্যক্তিগত ছোট চিড়িয়াখানায় রাখা হয়। কয়েক দিন পর দুই ভাইবোনসহ জ্যোতি চলে যায় কক্সবাজারের ডুলাহাজারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে।

বছর কয়েক জয়, জুঁই ও জ্যোতির বেশ ভালোই কাটছিল। কিন্তু এর মধ্যে আসে জাপান যাওয়ার ডাক। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরে আসেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে উপহার দেওয়া হয় দুটি বেঙ্গল টাইগার। এর মধ্যে একটি ঢাকা চিড়িয়াখানা ও আরেকটি সাফারি পার্ক থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বেছে নেওয়া হয় জ্যোতি ও রণবীরকে। জ্যোতিকে ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার থেকে ঢাকা চিড়িয়াখানায় আনা হয়। কোয়ারেন্টাইন সেলে রাখা হয় রণবীরের সঙ্গে। ২০১০ সালের ৪ মে রণবীরের জন্ম। তবে ঠান্ডা আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে না বলে জ্যোতি-রণবীরকে নিতে রাজি হয়নি জাপান। তখন থেকে ওদের স্থায়ী আবাস চিড়িয়াখানায়। রণবীরের সঙ্গে সংসার জীবনে টোকিও ও মৈত্রী নামের দুটি বাচ্চার জন্ম দেয় জ্যোতি। কিন্তু বেশ বড় হয়ে দুই শাবকই মারা যায়।

দুই সন্তান হারালেও রণবীরের সঙ্গে জ্যোতির সখ্য রয়েছে বেশ। ফুটফুটে ছোট্ট জ্যোতির ওজন এখন প্রায় ১০০ কেজি, উচ্চতা তিন ফুট আর লেজসহ লম্বায় আট ফুট। ১৯৭৪ সালে সরকারি উদ্যোগে সুন্দরবন থেকে প্রথমবারের মতো দুটি বেঙ্গল টাইগারের বাচ্চা আনা হয়। ১৯৭৪ সালে যে দুটি বেঙ্গল টাইগারের বাচ্চা সুন্দরবন থেকে হয়, এর মধ্যে একটি ওই বছরই মারা যায়। কিন্তু আরেকটি বাঘ নিঃসঙ্গ থাকলেও ১৯ বছর বেঁচে থেকে ১৯৯৩ সালে মারা যায়। এরপর ঢাকা চিড়িয়াখানায় সুন্দরবনের আর কোনো বাঘের দেখা মেলেনি। ২২ বছর পর সুন্দরবনের বাঘ হিসেবে আসে জ্যোতি। জ্যোতিকে এখন সম্পদ মনে করছে জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।

চিড়িয়াখানার অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জ্যোতির সঙ্গে রণবীরের খুব ভাব দেখা যাচ্ছে। আশা করা যায় ওরা নতুন বাচ্চা জন্ম দিতে পারবে। দুটি বাঘের প্রতি যত্মআত্তির কমতি নেই। প্রতিদিন ২০ কেজি করে গরুর মাংস খেতে দেওয়া হয়। কেবল প্রতি রোববার একটি জ্যান্ত মুরগি খায় ওরা।

তবে সুন্দরবনের আরেকটি বাঘের সঙ্গে জ্যোতিকে রাখা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাঘ বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের বাঘ এখন বিপন্নপ্রায়। জ্যোতিকে সুন্দরবনের আরেকটি বাঘের সঙ্গে রাখা হলে ভালো হতো। এতে সুন্দরবনের বাঘের ওপর গবেষণার সুযোগ পাওয়া যেত। আবার একই জাতের বাঘের সংখ্যা বাড়ত।