শুল্কমুক্ত চাল আমদানির সুপারিশ:কৃষকের গলার ফাঁস

কাজী লুৎফুল কবীর: বোরোর ভরা মৌসুমের শুরুতেই, চাল আমদানির কর প্রত্যাহার করা হলে, কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে ব্যঞ্চিত হবে বলে মনে করেছেন চাল আমদানিকারক,বাজার বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা। আর এতে করে মৌসুমের শুরুতেই বড় মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষক।

উল্লেখ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হাওড়াঞ্চলের ফ্ল্যাশফ্লাড ও কমবেশী দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাবে পর্যাপ্ত চাল উৎপাদন হবে না, এমন শঙ্কায় খাদ্য মন্ত্রণালয়। তাই চালের বাজার স্থিতিশীলের জন্য সরবরাহ ঠিক রাখতে চায়। কোন অজুহাতে সরবরাহে যেন সংকট সৃষ্টি না হয়, সেজন্য চাল আমদানির সব ধরনের কর প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠিও দিয়েছে মন্ত্রণালয়। তবে চাল আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সবেমাত্র ধান উঠতে শুরু করেছে,এখন কৃষক খরচ অনুযায়ী ভালো দামের অপেক্ষায় আছে। প্রত্যাশার দিন গুনছেন ধান উৎপাদনকারী দেশীয় কৃষকরা।

প্রসঙ্গগত চালের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধে ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের পাশাপাশি চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ২০১৫ সালে আমদানি কর বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) যোগ করা হয়। এরপর প্রায় দেড় বছর বন্ধ ছিলো চাল আমদানি। আর এ কারণে গত কয়েক মৌসুমে দেশের কৃষক ন্যায্যমূল্য পেয়ে বেশ লাভবানও হয়ে আসছিলেন।
কিন্তু সম্প্রতি হাওড়াঞ্চলের ফ্ল্যাশফ্লাড ও ব্লাস্ট রোগের অজুহাত এবং উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কায় গেলো কয়েক দিনে চালের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। আর এ কারণে খাদ্য মন্ত্রণালয় মনে করছে, বাজার স্থিতিশীল রাখতে, চাল আমদানির কর প্রত্যাহার করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের ধারণা,আমদানি বাড়লে, বাজারে চালের দাম কমবে। কিন্তু বোরোর উঠতি মৌসুমে চাল আমদানি কর প্রত্যাহার করা হলে,ধান উৎপাদনকারি কৃষক মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষক,আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, উত্তরবঙ্গ ছাড়া দেশের বেশিরভাগ এলাকায় বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় আমদানি কর সম্পূর্ণভাবে তুলে নেয়া হলে, কম দামে চাল আমদানির দিকে ঝুঁকবে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। ফলে কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ কমে যাবে। এতে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবে কৃষক। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত চাল আমদানি করলেই, ব্যবসায়ীরা চালের দাম কমাবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর একবার দাম বেড়ে গেলে, তা কমানোর নজিরও নেই তেমনটা।

তাই চাল আমদানির কর প্রত্যাহার করা হলে ধানের দরপতন ঘটবে। মিল মালিক ও মজুদদারা আগে-ভাগেই ধান মজুদ করবে এবং এক শ্রেণীর মৌসুমী মুনাফালোভী আমদানিকারকের স্বল্প সময়ের বিনিয়োগে বাজার সয়লাব হবে পার্শ্ববর্তী দেশের নিম্মমানের চালে। এতে করে মোটাদাগে ক্ষতির মুখে পড়বে দেশীয় ধান উৎপাদনকারি কৃষক। আর চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখা তো দূরের কথা হয়ে পড়বে অস্থির।

এ বিষয়ে আজকের বাজারের সঙ্গে কথা বলেন চাল আমদানিকারক করিম ট্রের্ডাস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সাজ্জাদুল করিম। তিনি বলেন,সারা বছর যখন কৃষকের হাতে ধান থাকলো না,তখন বাজারে চালের স্বাভাবিক সরবরাহ ঠিক রাখতে চেষ্টা করা হলো না। তুলে নেয়া হলো না কর। অথচ যখন দেশের কৃষকের ধান উঠতে শুরু করেছে তখন কেন কর প্রত্যাহার। কি রহস্য আছে তাতে। সাজ্জাদুল করিম বলেন,বোরোর ভরা মৌসুমে এখন ভালো লাভের আশায় কৃষক। আর এখনই যদি ঘাটতি পুরণের অজুহাতে এটা করা হয়,ধানের দাম পড়ে যাবে। মিলার ও মজুদদারা আগে-ভাগেই কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করে মজুদ করবে এবং পরে চড়া দামে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে। তিনি বলেন,আর ভারতের রপ্তানীকারকরাও অপেক্ষায় আছে কখন তারা দাম বাড়াবে। গেলো এক সপ্তাহে তারা চালের আমদানি মূল্য নির্ধারণ করছে না। যখন শুল্ক প্রত্যাহার হবে,সঙ্গে সঙ্গে তারা দাম বাড়িয়ে চালের মূল্য নির্ধারণ করবে। তাতে কি হবে,সেই তো বাড়তি দামেই ভারতীয় চালে বাজার সয়লাব হবে।

বাজারে চালের কিছুটা ঘাটতি আছে দাবি করে আমদানিকারক রসনা ট্রের্ডাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাবিদ হোসেন মালিক আজকের বাজারকে বলেন,মৌসুমের এই সময়ে চালের আমদানি কর প্রত্যাহার করা হলে,বাজার স্থিতিশীল হবে না,বরং পুরো বাজার এলোমেলো হয়ে যাবে। তিনি বলেন,ধান-চালের মূল্য সরকার নির্ধারিত ৩৫/৩৬ টাকা তো থাকবেই না আরো বেড়ে যাবে। কারণ কর প্রত্যাহারে সঙ্গে সঙ্গে মিলার ও মজুদদারা কম দামে কৃষকের কাছ থেকে কিনে মজুদ করবে। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে ভারতীয় চাল আমদানির সুযোগ নিতে। আর সেই সুযোগে ভারতীয় চাল রপ্তানীকারকরা বাড়িয়ে দেবে চালের দাম। তিনি বলেন,ভারতের ব্যবসায়ীরা গত এক সপ্তাহ ধরে আমাদের দর দিচ্ছে না। তারা বলছে তোমাদের কর প্রত্যাহার হোক,তারপর। জাবিদ হোসেন বলেন,ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও সেই সুযোগ নিতে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন,গত বছরও কুষকের হাত থেকে ধান চলে যাবার পর ঠিকই চালের দাম বেড়ে গেছে। তাহলে লাভ হয়েছে কোথায়? তিনি বলেন,আমাদের কৃষকদের তো মজুদ রাখার ক্ষমতা নেই। তাই তাদের কম দামে হলেও ছেড়ে দিতে হয় উৎপাদিত পণ্য। বাধ্য হয় মিলার ও মজুদদারদের কাছে দ্বারস্থ হতে। জাবিদ হোসেন মালিক আরো বলেন,এ অবস্থায় সামনের আউশ-আমনের উৎপাদন যদি কম হয়,তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে। তিনি বলেন,এখন সামান্য যে ঘাটতি আছে তা পূরণে সরকার নিজে কেন বেসরকারী মাধ্যম ব্যবহার করে চাল আমদানি করছে না? এতে করে সঠিক পদ্ধতিতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কারণ বাজারে ঘাটতি দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে সেই মজুদ ছেড়ে দিলেই,বাজার স্বাভাবিক থাকবে। তিনি বলেন, আর তাতে করে বেচে যাবে আমার কৃষক।

‌তবে কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থে উৎপাদন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কিছুদিনের জন্য কর কিছুটা কমিয়ে চাল আমদানির সুযোগ দেয়া যেতে পারে বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। কিন্তু তাও আবার এই মূর্হূতে নয়। আগে কৃষকে বাচাতে হবে। তারপর চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের বা স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ তাদের। কারণ কেউ যাতে এ সুযোগের অবৈধ ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকেও কড়া নজর রাখতে হবে। এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়া কৃষকদের উদ্ধার করতে ভর্তুকি সহায়তা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য প্রণোদনা নিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যদিকে পরিস্থিতির সঠিক বাস্তবতা নির্ণয়ে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান বাড়াতে হবে। পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য থাকলে, ভোক্তা ও কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এমন পদক্ষেপ নেয়া সহজ হয়। ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অন্যায্যভাবে যেন দাম বাড়াতে না পারেন, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।

উল্লেখ আগের বছরের তুলনায় এবার কিছুটা কম হলেও বর্তমানে সরকারের খাদ্য মজুদ যথেষ্ট সন্তোষজনক। হাওড়াঞ্চলের বন্যাদুর্গতদের জন্য এরই মধ্যে ওএমএস চালুসহ সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সুতরাং এ অবস্থায় চাল আমদানি হঠাৎ শুল্কমুক্ত না করে বরং বিষয়টি যথেষ্ট বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত। সিদ্ধান্ত এমন হওয়া উচিত, যা কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করবে। ভোক্তা ও কৃষককে বাঁচাতে সরকারকে অবশ্যই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

আজকের বাজার:এলকে/আরআর/৮ মে,২০১৭