সত্য-সুন্দরের প্রত্যাশায় মঙ্গল শোভাযাত্রা

সাম্প্রদায়িকতা রুখে দিয়ে সত্য-সুন্দরের প্রত্যাশায় হলো ১৪২৪ সনের বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য-সুন্দর।’

মঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৯টার কিছু পরে শোভাযাত্রাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে শুরু হয়। এরপর শোভাযাত্রাটি হোটেলে ইন্টারকন্টিনেন্টাল (আগের রূপসী বাংলা), শাহবাগ ও টিএসটি মোড় ঘুরে ফের চারুকলার সামনে গিয়ে সকাল সোয়া ১০টার দিকে শেষ হয়।

শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী উপস্থাপনের নানা বিষয় স্থান পেয়েছে।

শোভাযাত্রায় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো ছিল পুরো এলাকা।

শোভাযাত্রা নিয়ে হুমকি ও নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকলেও তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের কাছে হার মানে সবকিছুই। ঢাক-ঢোলের বাদ্যি আর তরুণ-তরুণীদের হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দ উল্লাস মাতিয়ে রেখেছিল পুরো শোভাযাত্রা।

গত বছরের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ‌্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে হওয়া এ শোভাযাত্রা।

সকাল থেকেই টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ ও এর আশপাশের এলাকায় মানুষ জড়ো হতে থাকে। নয়টার মধ্যেই পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।শোভাযাত্রা ঘিরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। পুলিশ, র‌্যাবের সঙ্গে ছিল সোয়াত সদস্যরা। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও তৎপর ছিল। শোভাযাত্রায় ছিল ঘোড়া ও বিশাল বাঘের মুখ, সমৃদ্ধির প্রতীক হাতি।

সূর্যের মুখ। যার এক প্রান্তে ছিল হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী আর অন্যপ্রান্তে সূর্যের বিপরীতে অন্ধকার কদাকার মুখ। মানুষের অন্তর্নিহিত এই দুই রূপ তুলে ধরা হয়েছে। সে সঙ্গে ছোট ছোট আরও অনেকগুলো হাস্যোজ্জ্বল সূর্যমুখ দেখা গেছে শোভাযাত্রায়, ছিল রাজা-রানীর মুখোশ। এ ছাড়া টেপা পুতুল, ঘোড়া, হরিণ, কয়েক রকম পাখির শিল্প কর্ম ছিল এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায়। বিশাল কদাকার মুখের এক দানবের শিল্পকাঠামোও ছিল শোভাযাত্রায়, যা দিয়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের কুৎসিত মুখ হাজির করা হয়েছে।

সাংস্কৃতিক-বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখন অমঙ্গল, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। সারা বিশ্বে আজ জঙ্গিবাদ। সেই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমরা আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে আপসহীন অবস্থান গ্রহণ করেছেন। সর্বশেষ ইউনেস্কা এটিকে (মঙ্গল শোভাযাত্রা) বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘জঙ্গিবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করা আমাদের মূল কাজ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাজ সুনিপুণভাবে পালন করছে। তাদের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন আছে। এটি জনগণের লড়াই, এটি একটি আদর্শিক লড়াই। আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে আছি, তার সাথে সাথে আমাদের মানবিক সমাজ গড়তে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘সকল অমঙ্গলকে দূর করে শুরু হচ্ছে আরেকটি নতুন বছর। মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে, এ দেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী।’

বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। তখন এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সালে এর নাম হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।

বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরও কয়েক বছরের পুরোনো। ১৯৮৫ বা ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরোনো বাদ্যসহ আরও অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে।

যশোরের সেই শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের একজন মাহবুব জামাল শামীম মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে পরে ঢাকার চারুকলায় চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।