বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ, আস্থা ফিরেছে পুঁজিবাজারে

মোশতাক আহমেদ সাদেক

বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ থেকে কী পেলেন বিনিয়োগকারীরা: ১৮৫ টা দেশে আইএসকো আছে। আমরা যে সপ্তাহটা পালন করলাম, এটা একই সাথে বিশে^র ৮৩টা দেশে পালিত হয়েছে। এই প্রথমবার এমন একটা আয়োজন বাংলাদেশে হলো। দুই বছর হলো, আমরা আইএসকোর মেম্বার হয়েছি। গত বছর আমরা প্রথম শ্রেণীভুক্ত মেম্বার হলাম। যার মাধ্যমে আমাদের সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন ‘এ’ গ্রেডে উন্নীত হয়েছে। এই সিইসি’র মাধ্যমে আমরা এমন আয়োজন করতে পারলাম। আমাদের এবারের মূল বিষয় ছিল ‘লিটারেসি এন্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট অব ইনভেস্টরস’

এ আয়োজনের মাধ্যমে আমরা বিনিয়োগকারীদের শিক্ষার মাধ্যমে সচেতন করেছি। বিনিয়োগের রিস্ক সম্পর্কে সবাইকে জানানো হয়েছে। দেশে ২ অক্টোবর থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত এই সপ্তাহ পালিত হয়েছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী, এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করনে। তার পর পর্যায়ক্রমে বিশেষজ্ঞ আলোচকেরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে কিভাবে এই বিনিয়োগ ছড়িয়ে দেয়া যায়, সবাইকে এর সাথে সম্পৃক্ত করা যায়; এ নিয়ে আলোচনা হয়। কিভাবে গ্রাম পর্যায়ে এ কাজ করতে হবে, কাদের নিয়ে আসা যাবে,তাদের কিভাবে বোঝানো যাবে, এসব ব্যাপারে বিষদ আলোচনা হয়।

আইএসকোর কোর্ডিনেটর হিসেবে, এই আয়োজন সফল করা আমার জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। এ বয়সে এসে আমি এতোবড় দায়িত্ব পালন করবো, তা আমি কল্পনা করতে পারিনি। আল্লাহর অশেষ রহমতে, আমরা সবাই মিলে সফলভাবে, এ আয়োজন শেষ করতে পেরেছি।

সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তো আর একদিনে সব জেনে যাবে না। তারা এর মাধ্যমে সচেতন হতে পেরেছে। তারা আইএসকো কি সেটাই জানতো না। আইএসকো পুঁজিবাজারের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, এর জন্য যত আইন কানুন, নিয়ম, বিধি বিধান তৈরি করে। একজন বিনিয়োগকারীকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হবে। সে যদি তার সারাজীবনের সম্পদ কোথায় বিনিয়োগ করছে, কিভাবে করছে সেটাই না জানে তাহলে তো সে নিঃস্ব হয়ে যাবে। গুজবে কান দিয়ে, অধিক মুনাফা লাভের আশায় ঝাঁপিয়ে পড়বে, ব্যাপারটা কিন্ত তা না। আবার যারা শুধু লাভের আশায়, পুঁজিবাজারে আসবেন তারা শুধু লসই করবেন, লাভের মুখ দেখতে পাবেন না। আর যদি আপনি ট্রেডার না হয়ে বুঝে শুনে, জেনে শুনে পুঁজিবাজরে আসেন তাহলে আপনি লাভবান হবেন। এখন এই মূহুর্তে যদি আপনি বিনিয়োগ করতে আসেন, যেখানে অনেক বিনিয়োগকারী রয়েছেন, তাহলে আপনার বিনিয়োগ নিরাপদ থাকবে। তাহলে এখন প্রশ্ন আসে যে সবাই তাহলে পুঁজিবাজারে আসছে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরই হলো এই ‘বিশ^ বিনিয়োগকারী সপ্তাহ’। যার মাধ্যমে সবাই জানবে, বুঝবে, সচেতন হবে এবং পুঁজিবাজরের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে তারপর তারা বিনিয়োগে আসবে।

বর্তমান বাজারে বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জগুলো কী : পুঁজিবাজারের বিনিয়োগের প্রধান ও প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো লিটারেট হওয়া। আমরা বিনিয়োগকারী হিসেবে বিনিয়োগ কোন শেয়ারে করছি, কখন করছি, কেন করছি এটা বোঝা। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যেখানে কোন রিস্ক থাকবে না।


তাছাড়া এখানে এসেই আপনি রাতারাতি অনেক বড়লোক হয়ে যেতে পারবেন এমন চিন্তা করা উচিৎ না। যদি তাই ভেবে কেউ আসে তার জন্য পুঁজিবাজার সঠিক জায়গা হবে না। এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জ। কারণ যদি কোন কারণে কেউ ক্ষতির মুখে পরে তাহলে সে পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে। এর জন্য আমাদের স্লোগান হলো ‘ইউ মাস্ট নট ফরগেট, ইউ হ্যাভ অ্যা ফ্যামিলি’। যখন আপনি পুঁজিবাজারে আসবেন, তখন আপনি আপনার মূলধনের অর্ধেক নিয়ে আসবেন। বাকি অর্ধেক রেখে দিন ভবিষ্যতে যদি কোন সমস্যা হয় তার জন্য। যা বিনিয়োগ করবেন তার লাভ থেকে চাইলে আপনি আবার বিনিয়োগ করুন। এই যে চ্যালেঞ্জগুলো, এগুলো আমাদের ফেস করতে হবে। এই ম্যাসেজগুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। তাহলেই আমাদের সফলতা আসবে।
এখনও অনেকেই একজনের দেখাদেখি বিনিয়োগ করে, তারা নিজেরা জানতে চায় না কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে? তারা স্টাডিও করে না কোন শেয়ার কিনবে বা কোন শেয়ারটা বিক্রি করবে। যাকে দেখে আপনি একটা শেয়ার কিনলেন, সে হয়তো কিনলো পাঁচ বছরের কথা মাথায় রেখে। কিন্ত আপনি না বুঝে কিনলেন এক দুই সপ্তাহের জন্য। দুইজনের চিন্তাধারা দুই রকম। আপনি জনেন না সে কেন কিনলো, বুঝারই চেষ্টা করলেন না? ফলাফল যা হবার তাই হবে। এর জন্য পুরো ব্যাপারটা জানা জরুরি। প্রত্যেকের উচিত হলো স্টাডি করা। তা না করতে পারলে যে জানে তার কাছ থেকে জেনে নেয়া। তার পর বিনিয়োগ করুন। এটা আসলে অশিক্ষিতের ব্যবসা না। এ ব্যবসা স্মার্ট ও শিক্ষিতের জন্য। এটা একটা চ্যালেঞ্জ।

আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো ব্যুরোক্র্যাসি। যখন আমাদের পুঁজিবাজারে ভাইব্রেন্ট হয় তখন সরকারের একটা ভূমিকা থাকে। এখানে সরকার হলো ফ্যাসিলেটেড বিজনেসার। সে ইনফ্রাক্ট্রাকচার তৈরি করবে, সেখানে জনগণ ব্যবসা বাণিজ্য করে দেশকে উন্নত করবে। কিন্ত দেখা যায়, আমাদের দেশের অনেক ইন্ডাস্ট্রিতে সরকার নিজেই ইনভল্ব হয়ে গেছে। এবং এগুলো ব্যুরোক্র্যাসি দিয়ে চলছে। ফলে এসবের কোনটাই ভালোভাবে চলছে না। সেগুলোকে পুঁজিবাজারে ছেড়ে দেয়া দরকার। কিন্ত কই, প্রধানমন্ত্রীও বলছেন, অর্থমন্ত্রীও বলছেন, তারপরও সেসব প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আসছে না। কারণ ব্যুরোক্র্যাটরা আসতে দিচ্ছে না। না দেয়ার কারণও এখানে আছে। কারণটা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হলে তারা টাকা পায়, বাড়ি পায়, গাড়ি পায়, বিভিন্ন সুবিধা তারা ভোগ করে। তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আসতে পারছে না। বাজারে আসলে তো তাদের ট্রান্সপারেন্ট হতে হবে, জবাবদিহিতার মধ্যে চলে আসতে হবে। তাহলে তারা আসবে কেন ? এই জন্য মূলত তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আসতে দেয় না। এটা একটা চ্যালেঞ্জ।

ওভার রেগুলেশন হলো আরেকটা সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ। কি সেটা ? অনেক সময় দেখা যায়, বাজারে গুজব বা পত্রপত্রিকায় দেখা গেল, বাংলাদেশ ব্যাংক এক্সপোজারের নামে কয়েকটা ব্যাংকে ফাইন করেছে। কী কারণে, কেন ১০ লাখ ৫ লাখ করে ফাইন করেছে কেউ জানে না। এখন এক্সপোজারের এই ফাইনের খবর সমস্ত পত্রপত্রিকায় এসেছে। পত্রিকার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছে এর খবর চলে আসে। তাতে করে মানুষ মনে করলো, বি.বি তো ব্যাংকগুলোকে ফাইন করা শুরু করেছে, তার মানে ব্যাংক শেষ। এবং পরের দিন দেখা গেল, তার শেয়ার আশি পয়েন্টের মতো কমে গেছে। আবার যখন শেয়ার ব্যবসায়ীরা দেখলো, ব্যাপারটা আবার টার্ন নেয়া শুরু করছে। তখন বিনিয়োগকারীরা অস্থির। এই যে একটা নিউজের উপর বাজার প্যানিকড হয়ে যায় এটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

এ ধরনের অনেক সমস্যা রয়েছে আমাদের পুঁজিবাজারে। এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমাদের আগাতে হবে।

নতুনরূপে কমিশন:২০১০ সালের পর সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন নতুনভাবে নিজেদের সাজিয়েছে।অনেক নিয়মকানুন,আইন তৈরি করেছি আমরা। বিনিয়োগকারীদের কল্যাণে যতরকমের ব্যবস্থা প্রয়োজন এর সবই করা হয়েছে। কিন্ত সবচেয়ে বড় যে সমস্যা ছিল, তা হলো, বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারিয়ে ফেলা। এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমাদের সময় লেগেছে ৬ টি বছর। ধীরে ধীরে তারা এসেছে। শতভাগ ফিরে আসেনি এখনও, তবে আসছে। এটা ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমার কাছে যেটা মনে হয় সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ ইজ নট অ্যা বিগ রেগুলেটর, দে আর ট্রাইং টু বি অ্যা ফেসিলিটেটর টু দা ইনভেস্টরস, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য, স্টেক হোল্ডারদের জন্য, সবার জন্য। তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে, তারা পুঁজিবাজারে আসবে, একটা জবাবদিহিতা থাকবে। আপনি যদি কমপ্লায়েন্সের মধ্যে না আসেন, ট্রান্সপারেন্সি যদি না বুঝানো হয়, আপনার টাকার অবস্থান, কত দিয়ে কেনা হলো, কত টাকা বিক্রি হলো এগুলোই আসলে পরিষ্কার থাকতে হবে। এ জন্য আমি মনে করি রেগুলেটর হিসেবে স্টক এক্সচেঞ্জ সাক্সেসফুল ।

মোশতাক আহমদে সাদকে
চয়োরম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরচিালক
ইনভস্টেমন্টে প্রমোশন র্সাভসিসে লিঃ