সম্ভাবনাময় কাগজ শিল্প

বর্তমান সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ শিল্প পণ্যের একটি কাগজ। বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, ইত্যাদি ছাপার অপরিহার্য উপাদান কাগজ। লেখার অন্যতম উপকরন ছাড়াও কাগজের রয়েছে হাজারো ব্যবহার ।তাই অত্যন্ত সম্ভাবনাময় গুরুত্বপূর্ন শিল্প এটি।

মূলত ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এদেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কাগজ শিল্পের বিকাশ ঘটে। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে কাগজ কলের সংখ্যা ছিল সর্বসাকুল্যে দুটি আর তা ছিল সরকার পরিচালিত। ৫০ এর দশকে স্থাপিত কর্ণফুলী পেপার মিল ও খুলনা মিল থেকে সারা দেশে কাগজের চাহিদা মেটানো যেত। কালক্রমে কাগজের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ৬০ এর দশকের শেষের দিকে নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্বাধীনতার পর সরকারি আরও একটি কাগজ কল প্রতিষ্ঠিত হয় পাবনার পাকশীতে। লোকসানের মুখে পরবর্তীতে তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত কাগজ কলই বন্ধ হয়ে যায়। পরে বেসরকারি খাতে কাগজ কল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। বর্তমানে রাষ্ট্রয়ত্ত খাতে ৩ টি কাগজ কল ছাড়াও বেসরকারি মালিকানাধীন ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৬টি পেপার মিল রয়েছে। আর দেশেই উৎপাদন হচ্ছে উন্নত মানের কাগজ।দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে কাগজ রপ্তানিও করছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, মুদ্রণ ও প্যাকেজিং শিল্পে ব্যবহৃত উন্নতমানের কাগজ এখন বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। দেশি কাগজকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা দেশের মোট চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। দেশে উৎপাদিত কাগজ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ প্র্রিন্টং প্রেসসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে দেশের কাগজ। চলতি অর্থবছরও ১৬৮ কোটি টাকার কাগজ রপ্তানি করেছে মিলগুলো।

কাগজ তৈরির উপকরণ: পৃথীবির বিভিন্ন দেশে হাজারো রকমের ও মানের কাগজ তৈরি হচ্ছে। উপাদান ও প্রস্তুত প্রণালীর উপর কাগজের মান নির্ভর করে। কাগজ তৈরির উপাদান মূলত সেলুলাসযুক্ত আঁশ। প্রতিটি গাছের কোষ প্রাচীরে এই রাসায়নিক উপাদানটি বিদ্যমান। পানির সাথে মিশিয়ে এই আঁশ মসৃণ জালির উপর দিয়ে প্রবাহিত করলে আঁশগুলো পরস্পর যুক্ত হয়ে কাগজে রূপ নেয়। শুকানোর পর কাগজের রাসায়নিক উপাদানগুলো দৃঢ়ভাবে পরস্পর যুক্ত হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে কাগজ তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে বাশঁ, কাঠ, তুলা, আখের ছোবরা, শন, ধান ও গমের বিচালী ইত্যাদি। তবে কাগজ তৈরিতে কাঠ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বর্তমান তিনটি কাগজ কল ভিন্ন ভিন্ন কাঁচামাল ব্যবহার করে কাগজ উৎপাদন করে। দেশের কাগজকল গুলো বিদেশ থেকে মন্ড আমদানি এবং ছেঁড়া বা পুরানো কাগজ রিসাইক্লিং করে কাগজ তৈরি করে।

রয়েছে হুমকি: দেশে মানসম্মত কাগজ উৎপাদন এমনকি বিশ্বের উন্নত বিভিন্ন দেশে তা রপ্তানি হলেও নানা অজুহাতে বিদেশ থেকে কাগজ আমদানি বন্ধ নেই। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে দেশে অবাধে ঢুকছে আমদানিকৃত কাগজ। রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত আমদানি হওয়া কাগজ, বোর্ড, বস্ত্রসহ নানা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি হওয়ায় টিকতে পারছে না দেশি শিল্প। বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পেরে লোকসান গুনছেন ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা কাগজ শিল্প। বন্ড সুবিধায় আমদানি হওয়া সস্তা কাগজের দাপটে টিকতে পারছেন না দেশীয় উৎপাদকরা। টানা লোকসানের কারণে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৫০টি কাগজকল।
বর্তমানে দেশের কাগজকলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন আর দেশে কাগজের চাহিদার পরিমাণ ৬ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশি। বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের কাগজ । মিলগুলোয় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে ১৫ লাখ মানুষ, পরোক্ষভাবে এই সম্পৃক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ।

এ শিল্পে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা। সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্বও পাচ্ছে এ শিল্প থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী দেশের ১০৬টি কাগজ শিল্পে ৩১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৬ হাজার ১১২ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে। এ অবস্থায় দেশীয় কাগজ শিল্পকে প্রায় বিনা শুল্কে আমদানিকৃত বিদেশি কাগজের সাথে অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেয়াটা এ শিল্পের জন্য হুমকি।

করনীয়: বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাদের স্থানীয় শিল্পের স্বার্থে অপ্রয়োজনীয় আমদানিকে নিরূৎসাহিত করলেও আমাদের দেশে করা হচ্ছে ঠিক উল্টোটা। দেশীয় কাগজ শিল্পকে বাঁচাতে হলে আমদানিকৃত কাগজের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন- সব ধরনের কাগজ আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক ১০ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। একইসঙ্গে যেসব কাগজে ২৫ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা আছে, সেগুলোতে আরও উচ্চ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে হবে।

বাজার ঘুরলেই দেখা যায়- আমদানিকৃত কোটেড পেপার, গ্রাফিক পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ড, মিডিয়া পেপার, সেলফ অ্যাডহেসিভ পেপারে রাজধানী সয়লাব। যাদের সহায়তায় এসব কাগজ বিক্রি হচ্ছে তাদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে অব্যাহত রাখা হচ্ছে এ বাণিজ্য। কাগজ আমদানির বেশিরভাগ বন্ড আবার ভুয়া। অসাধুচক্রের কারণে আমদানিকারকরা হয়েছে শক্তিশালী। কাগজের মার্কেটে অভিযান চালাতে গেলে কাস্টমস কর্মকর্তাদের হতে হয় নাজেহাল।একমাত্র সরকারি সহায়তা ও দৃষ্টিই পার দেশীয় কাগজ শিল্প বাঁচাতে।

পাশাপাশি বাড়াতে হবে আমাদের বনায়ন । নাহলে কাঁচামাল সংকটের কারণে বড় বড় কাগজের কলগুলো দিনে দিনে আরো বেশি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।

লেখা ও ছাপার কাগজ না থাকলে শিক্ষা, শিল্প কারখানা, সরকারও অচল হয়ে পড়বে। পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য দেশে কাগজের ব্যবহার রয়েছে। কাগজ ছাড়া সভ্যতাকে কল্পনা করা যায়না। কিন্তু রপ্তানিমুখী শিল্পে ব্যবহারের নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাগজ কালোবাজারে বিক্রি করে দিয়ে দেশীয় কাগজ কলগুলোকে অসম প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তাই এ শিল্পকে বাচিয়ে রাখতে পারলে তা দেশীয় অর্থনীতিতে বড় ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

 

 

আজকের বাজার/মিথিলা