সরকারের ‘সিদ্ধান্তহীনতা’য় চালের দর বৃদ্ধি

আজকের বাজার প্রতিবেদন
চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। তবে ৬.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারলে, তা ভালো প্রবৃদ্ধি হবে বলে উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক এই দাতা সংস্থা।
বুধবার বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সংস্থাটির বাংলাদেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, প্রবৃদ্ধির এই প্রাক্কলন একমাত্র ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে এটা খুবই ভালো প্রবৃদ্ধি।
প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, চলতি অর্থবছর চীন ৬ দশমিক ৩, ইন্দোনেশিয়া ৫ দশমিক ৩, থাইল্যান্ড ৩ দশমিক ৩, পাকিস্তান ৫ দশমিক ৫ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এখন ভালো করছে। গত অর্থবছরে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এবার প্রথম দুই মাসের যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা ভালোর দিকেই যাবে বলে মনে হচ্ছে।
তিনি বলেন, জনশক্তি রপ্তানি এবার বেশ বেড়েছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির একটি লক্ষণ দেখা দিয়েছে, কারণ ব্যাংক ঋণের সুদের হার কিছুটা কমেছে।
উল্লেখ, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সম্প্রতি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক ২০১৭’-এ বলেছে, এ বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ।
গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। এরপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরে, এগিয়ে বাংলাদেশ অর্জন করে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।
এ কারণেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বরাবর বলে আসছেন, প্রবৃদ্ধির হার আর কখনও ৭ শতাংশের নিচে নামবে না।
এছাড়া মায়ানমারে সহিংসতার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা কয়েক লাখ রোহিঙ্গার ত্রাণ বা ভরণপোষণে বাজেট ঘাটতি বাড়াবে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক।
এ প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, ৪ লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গাকে ত্রাণ দিতে বাজেট ঘাটতি আরও বাড়বে। কারণ তাদের এই ত্রাণ সহায়তার বিষয়টি বাজেটে ছিল না। তাই এটা বাজেটের উপর চাপ বাড়াবে। তিনি বলেন, এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে মূদ্রাস্ফীতি হবে। তবে জাতীয় পর্যায়ে হওয়ার সম্ভবনা নেই বলে মনে করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেন, রোহিঙ্গা ‘শরণার্থীদের’ জন্য সহায়তা দিতে বিশ্বব্যাংক প্রস্তুত আছে। বিশ্বব্যাংক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
তিনি বলেন, আগামী ৩ বছরের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (আইডিএ) এর ২ বিলিয়ন ডলারের রিফিউজি ফান্ড রয়েছে। যে কোনো দেশ প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও এই তহবিল পাওয়ার যোগ্য।
এ সময়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ঢাকার বাইরে নগরায়ন করতে হবে। মানুষ ঢাকার বাইরে যেতে চায় না। তবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে পরিকল্পিত নগরায়ন করা গেলে, মানুষ ঢাকার বাইরে যাবে। সেখানে তখন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে।
তিনি বলেন এখন বাংলাদেশের জন্য মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে কারিগরি শিক্ষাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
উল্লেখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সার্বিক বাজেট ঘাটতি দেখানো হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা।
এদিকে সম্প্রতি চালের দর বৃদ্ধিতে সরকারের ‘সিদ্ধান্তহীনতা’কে দুষছে বিশ্ব ব্যাংক। তারা বলছে বন্যার কারণে চাল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হলেও, সরকারের নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই দামে বেশি প্রভাব পড়েছে।
এ সম্পর্কে জাহিদ হোসেন বলেন, প্রথম পর্যায়ে হাওর অঞ্চলের বন্যায় ৮ থেকে ১০ লাখ টন চাল উৎপাদন কম হয়েছে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০ লাখ টন চাল উৎপাদন কম হয়েছে।
সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ লাখ টন চালের ঘাটতি মেটাতে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেই নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। সরকার চাল আমদানি করবে; নাকি স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করবে? আবার আমদানি করলে, সেটার ব্যাপারে নীতি কি হবে ? এই বিষয়গুলো পরিস্কার ছিল না।
আর চালের দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুজব একটি বড় ভূমিকা রেখেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, সম্প্রতি ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডেও চালের দাম বেড়েছে। এছাড়া সরকারি গুদামেও চালে যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দেশের হাওরে বন্যা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে উত্তরাঞ্চলে বন্যার পর, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ফসল নষ্ট হয়েছে। এতে সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকে চালের দাম প্রায় ৮ টাকা থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধি পায়।
যদিও বরাবরের মতো এই দর বৃদ্ধিতে মিল মালিক ও আড়ৎদারদের দায়ী করেছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। বাজার মনিটরিংয়ের অভাবও ছিল তাদের অভিযোগের তালিকায়। তবে নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তহীতাই দায়ী করছে বিশ্ব ব্যাংক ।
এই দর বৃদ্ধিতে মোটা স্বর্ণা ও পারিজা চাল প্রতি কেজিতে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা দরে। এছাড়া মিনিকেট কেজি প্রতি৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে বিক্রি হয় (ভালো মানের) ৬৫ টাকা দরে, মিনিকেট (সাধারণ) ৬০ টাকা, বিআর-২৮ ৫৮ টাকা, উন্নত মানের নাজিরশাইল ৭০ টাকা, পাইজাম চাল ৫৫ টাকা, বাসমতি ৭২ টাকা, কাটারিভোগ ৭৬ টাকা এবং পোলাও চাল ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।