সিরামিক শিল্পে জিএসপি সুবিধা ও বিকল্প গ্যাস জরুরি

বিশ্বের বাজারে সুনাম রয়েছে বাংলাদেশের সিরামিক পণ্যের। হাতে গোনা যে কয়টি কোম্পানির কারণে এ সুনাম অর্জন সম্ভব হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ফার্ সিরামিকস্ লিমিটেড। কোম্পানিটির পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন ইমতিয়াজ উদ্দিন। তিনি সিরামিক শিল্পের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন আজকের বাজার টেলিভিশন-এবিটিভির সঙ্গে। কথোপকথনের মূল অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

আমাদের সিরামিক সেক্টরের এখনকার প্রধান সমস্যা হচ্ছে গ্যাসের স্বল্পতা। এই শিল্পখাত পুরোপুরি গ্যাসনির্ভর, প্রায় শতভাগ এই জ্বালানির ওপর নির্ভর করতে হয় আমাদের। এ ছাড়া গত কিছুদিনের মধ্যে সরকার গ্যাসের দাম কয়েকবার বাড়িয়েছে ফলে সিরামিক শিল্প একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমাদের মূল্য সমন্বয় করা, প্রাইস অ্যাডজাস্ট করতে আমরা বেশ অসুবিধায় পড়ছি। দ্বিতীয়ত আমরা ডিউটি স্ট্রাকচার নিয়ে অসুবিধায় আছি। সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার পরও আমরা এটাকে জিরো লেভেলে আনতে পারিনি। এই  সেক্টরটার প্রতি সরকারের আরো নমনীয় হওয়ার অনুরোধ করবো। বাংলাদেশের  প্রেক্ষাপটে সিরামিক শিল্পের উন্নতির সম্ভাবনা প্রচুর। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে  সিরামিকই দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত হতে পারে। রপ্তানির দিক দিয়ে এখন আমরা চতুর্থ অবস্থানে  আছি। এটাকে তৃতীয় কিংবা আরো এগিয়ে আনা সম্ভব যদি সরকার আরো একটু  সহায়তা করে।

এই সিরামিক শিল্প গ্যাস নির্ভরশীল আর র’ ম্যাটেরিয়াল প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়, কোয়ালিটি  প্রোডাক্টের জন্য দেশি কাঁচামাল মানসম্মত নয়, ফলে আমরা তা ব্যবহার করতে পারি না।  এই সেক্টরে আমাদের প্রায় তিন হাজার  কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়ে আছে।

সিরামিকসের তিন ধরনের পণ্য আছে। প্রথমত, ট্যাবল ওয়্যার, টাইলস এবং স্যানিটারি ওয়্যার। বলা যায় শুধুমাত্র ট্যাবল ওয়্যারেই আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়ে আছে।
এই ট্যাবল ওয়্যারের প্রায় পুরোটাই যেমন কাপ, প্লেট এসব সামগ্রী রপ্তানি হচ্ছে।  বাংলাদেশের পুরো সিরামিক শিল্পের প্রায় ৯৫ ভাগ রপ্তানি আয় আসে ট্যাবলওয়্যার রপ্তানি থেকে। গত দশ বছরে সিরামিক পণ্যের রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। টাকার অংকে এর পরিমাণ ৪ হাজার  কোটি টাকার  বেশি।

বাংলাদেশ এখনো চায়না ও ইন্ডিয়া থেকে র’ম্যাটেরিয়াল ইমপোর্ট করে।  ব্যাসিক্যালি  আমরা ট্যাবল ওয়্যার বেশি রপ্তানি করি। এই ট্যাবল ওয়্যারে কিন্তু আমরা নতুন করে বিনিয়োগ দেখছি না। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সরকারের দুই দফা গ্যাসের দাম বা ও ডিউটি স্ট্রাকচার বাড়ানো। এতে বিনিয়োগকারীদের  ওপরে একটা নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট পড়ে। যেমন এখন পর্যন্ত আমরা  র-ম্যাটেরিয়ালের ৯৯ শতাংশ ইমপোর্ট করে থাকি; যার ডিউটি স্ট্রাকচার মিনিমাম ৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত। আমরা যদি শূন্য ডিউটি সুবিধা পেতাম তাহলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করাটা সহজ হতো। এ ছাড়া আমরা এরইমধ্যে গ্যাস সমস্যার মতো একটা চাপের মধ্যে আছি।

গ্যাসের বিকল্প
গ্যাস সমস্যা এখন আমাদের জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত যার কোনো কার্যকর সমাধান হয়নি। আর শিল্পে যেহেতু গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য সেহেতু এর বিকল্প তো লাগবে।  বিকল্প হিসেবে সিএনজি বা এলপিজি ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও এগুলোও ব্যয়বহুল। সরকার এখানে একটু সাহায্য করতে পারে। যদি শিল্পে ব্যবহারের জন্য এলপিজি বা সিএনজি ইমপোর্টের ওপর ডিউটি ছাড় দেওয়া হয় তাহলে ব্যবসায়ীদের উপকার হয়।

তবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করলে উন্নতমানের প্রোডাক্ট তৈরি করা সহজ হয়। আমাদের প্রোডাক্ট কিন্তু ওয়ার্ল্ড ওয়াইড সুনাম অর্জন করেছে এ রকম কোয়ালিটির জন্যই। মেজর কান্ট্রিগুলো কিন্তু চায়নাকে রিফিউজ করেছে। এটা কিন্তু আমাদের জন্য একটা বড় সম্ভাবনা।

এত সম্ভাবনা থাকার পরও আমরা এগোতে চেয়েও পারছি না। কারণ- গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ আরও কিছু কারণে আমাদের কস্ট বেড়ে যাচ্ছে।
আবারো বলছি, সিরামিকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গ্যাস ও ইমপোর্ট ডিউটি।

বাজেটে চাওয়া
আমাদের দেশে ট্যাবল ওয়্যার ও টাইলসের পণ্যে চায়নার একটা বড় বাজার রয়েছে। আমদানির ওপর সাপ্লিমেন্টরি ডিউটি বা এসডি থাকার কারণে আমরা নিজেদের ইন্ডাস্ট্রি থেকেই তা যোগান দিতে পারছি। অর্থাৎ চাহিদার বেশিরভাগই আমরা পূরণ করছি। সাপ্লিমেন্টরি ডিউটি হচ্ছে একটা এডিশনাল ডিউটি। এটা দেওয়ার কারণ হচ্ছে একটা প্রোডাক্টের ওপর একটা দেশের এডিশনাল ডিউটি ইমপোজ করা। এতে ওই দেশের ইমপোর্টের ক্ষেত্রে যে ডিউটি পড়ে সেটা দেখা যায় বাজারের সঙ্গে তার বেশ পার্থক্য থাকে। এটা নিজ দেশের ইন্ডাস্ট্রিকে সাপোর্ট করার মতো একটা ব্যাপার।

এই ৬৫ ভাগ এসডি সুবিধাটা সামনের বাজেটে হয়তো সরকার তুলে দিবে। আর তা উঠে গেলে  এ দেশের বাজার চায়না  প্রোডাক্টে সয়লাব হয়ে যাবে। আর বাজারে যদি চায়না  প্রোডাক্ট এত বেশি ছড়িয়ে যায় তাহলে দেশীয় ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকতে অনেক কষ্ট হবে। এতে অনেক অসাধু ব্যবসায়ীও সহজে চায়না থেকে কিছু প্রোডাক্ট ইমপোর্ট করে ফেলবে। তাই এই বাজেটে আমাদের নজর এসডি’র দিকে। এসডির বিষয়ে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়? আমরা চাই এটা যদি কোনো কারণে উঠাতে সরকার বাধ্য হয় তবে যেন অন্য একটা ডিউটি যোগ করে। যেমন ইউরোপ কিংবা আমেরিকা করে থাকে। আমেরিকা অলরেডি চায়নাকে এন্টি ডাম্পিং করেছে। এন্টি ডাম্পিং হচ্ছে বিদেশে কোনো প্রোডাক্ট বিক্রি করতে হলে অবশ্যই সাধারণ মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। আর যদি সমান দাম বা কম মূল্যে বিক্রি করে তাহলে এন্টি ডাম্পিং ডিউটি দিতে হবে। এই একই কাজটি বাংলাদেশ সরকারকে করতে হবে। তাহলে দেশীয় কোম্পানি সুবিধা পাবে। অথবা অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বাড়াতে পারে। সাপ্লিমেন্টরি ডিউটি উঠে গেলেও অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বাড়ালেও আমাদের জন্য কিছুটা সুবিধে হয়।

ফার্ সিরামিকসের স্পেশালিটি
ফার্ সিরামিকসের জন্ম আজ থেকে ১০ বছর আগে। এই দশ বছরে আমাদের বড় অর্জন হচ্ছে টানা ৪ বছর সরকারের  এক্সপোর্ট গোল্ড ট্রফি পেয়েছি। লাস্ট ইয়ারের জন্যও আমরা মনোনীত হয়ে আছি। ফার্ সিরামিকসের বিশেষত্ব দুটো এক. এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে কোয়ালিটি মেইনটেইন করা এবং ভালো সার্ভিস। শুরু থেকে কখনোই আমরা কোয়ালিটিতে কোনো কম্প্রোমাইজ করিনি। আর কখনো করবোও না। আমাদের সার্ভিস, যে কোনো ইউরোপীয় কোম্পানির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে আমরা একই কাতারে রয়েছি।

যে সকল দেশে ফার্ সিরামিকস্ পণ্য রপ্তানি হয়

দেশীয় বাজারের বাইরেও জার্মানি, ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, ব্রাজিল অর্থাৎ ইউরোপিয়ান কান্ট্রিতেই আমাদের পণ্য বেশি রপ্তানি করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি না থাকার প্রভাব

ইউএসএ তো জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করেছে। এর ফলে সিরামিক, প্লাস্টিক ও গ্লাস সেক্টর বেশি ভুক্তভোগি। জিএসপি না থাকায় হয়তো রপ্তানির সবচেয়ে বড় খাত রেডিমেড গার্মেন্টসে তেমন প্রভাব পড়ছে না। যে কারণে সরকারেরও খুব একটা মাথাব্যথা নেই এ নিয়ে। কিন্তু আমরা তো এখনো ওই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি। আরএমজি’র মতো বড় রপ্তানি পণ্যে এখনো সিরামিক বা প্লাস্টিক পৌঁছাতে পারেনি; তাই এটা নিয়ে সরকার তেমন ভাবছে না।

জিএসপি’র কারণেই কিন্তু আমরা আমেরিকার বাজার দখলে নিতে পেরেছিলাম। তখন চায়নার কোম্পানিগুলো আমাদের কমপিট করতে পারেনি। এখন জিএসপি উঠে যাওয়াতে আমেরিকার বাজারে চায়না আমাদের সঙ্গে কমপিট করতে পারছে। অলরেডি চায়না প্রোডাক্টের একটা এন্ট্রি হয়ে গেছে ওখানে। আর আমাদের বাজারটা এখন অলমোস্ট ৩০ভাগ নেমে গেছে। তাই বলতেই হয়, জিএসপিটা আমাদের জন্য খুবই দরকার।

ফার্ সিরামিকস্ পুঁজিবাজারে না আসার কারণ

পুঁজিবার নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। ইচ্ছে আছে ইনশাহআল্লাহ ২০১৮ সাল নাগাদ র্ফা সিরামিকস্কে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসব। সেই লক্ষ্যে কাজও হচ্ছে। দেশীয় বা বিদেশি মার্কেটে ফার্ সিরামিকসের চাহিদা ব্যাপক। তাই চিন্তা রয়েছে পুঁজিবাজার থেকে টাকা নিয়ে প্রডাকশন বাড়াবো। এখন প্রতিদিন ৭০ হাজার পিস পণ্য উৎপাদন হয়। এটাকে ১ লক্ষ ২০ হাজার পিসে নিয়ে যেতে কাজ করছি।

ইমতিয়াজ উদ্দিন: পরিচালক, ফার্ সিরামিকস্ লিমিটেড