ফেনী নদী শুধুই বাংলাদেশের

কাজী লুৎফুল কবীর: ফেনী নদী,অভিন্ন নয়-শুধুই বাংলাদেশের সম্পদ। এর উৎপত্তি, প্রবাহ এবং ভৌগলিক অবস্থান নিশ্চিত করে ফেনী নদী কোনভাবেই আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহের সীমা রেখায় প্রবাহিত নয়। দেশি-বিদেশি যারাই ফেনী নদীকে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী প্রমাণের চেষ্টা করছেন বহু বছর ধরে,তারা কখনই মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করে এর পক্ষে যুক্তি দেখাতে পারেননি। লেখালেখি বা বক্তব্য-বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ তাদের অপচেষ্টা। সেখানেও তারা কোনভাবেই দু’দেশের অমিমাংসিত ভূমি নিয়ে কথা বলেন না। খাগড়াছড়ির ১৭শ একর অমিমাংসিত বাংলাদেশের যে ভূমির উপর দিয়ে এ নদী প্রবাহিত,তা ভারতের বলেই চালিয়ে দিতে চেষ্টা করেন অনেকে। শুধু তাই নয়,পার্শ্ববর্তী বন্ধু প্রতিম দেশ ভারতও নিজেদের উত্তর-পূর্ব অংশের বেশ কটি রাজ্যের পানির অভাব মেটাতে দীর্ঘ বছর ধরে নানা কৌশলে ফেনী নদীকে আন্তর্জাতিক নদী প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় তিস্তার পানি বন্টনের সঙ্গে ফেনী নদীকে জড়িয়েও দেয়া হয়েছে। সে মোতাবেক দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ফেনী নদীর পানি ব্যবহার এবং নদীর উপর সেতু নির্মাণের একটি চুক্তিও হয়েছে। যা কোনভাবেই আন্তর্জাতিক নদী সীমার আওতায় হতে পারে না। যদি তা বিনিময় হয়,তাহলেও এর মূল্য হওয়া উচিত চড়া। অর্থ্যাৎ তিস্তার পানি বন্টন হওয়া উচিত ন্যায্য হিস্যার ভিত্তির চেয়ে বেশি হিসেবে।

দেখা যাক, আসলে ফেনী নদী কেন অভিন্ন ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে পড়ে না।

উৎপত্তি এবং পথচলা: এক পাশে পার্বত্য রামগড় ও চট্টগ্রামের মিরসরাই, আরেক পাশে ফেনীর সাগরনাইয়া। মাঝে কল কল ধ্বনিতে ধেয়ে চলছে সাগরনাইয়ার গর্বের সন্তান, ফেনী নদী। খাগড়াছড়ি’র পার্বত্য মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ির মধ্যবর্তী “ভগবান” টিলা থেকে ছড়া নেমে আসে ভাটির দিকে। আর আসালং-তাইন্দং দ্বীপ থেকে রূপ নেয় ফেনী নদী নামে।

ভগবানটিলার পর আসালং তাইন্দং এসে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত ছড়াকে কেটে ভারতের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়েছে।
কোথাও কোথাও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আমলীঘাট সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের লুসাই পাহাড় থেকে ছড়া নেমে এসে, ইজেরা গ্রামের সীমান্ত ছুঁয়ে বা ঘেঁষে ফেনী নদী নামে ভাটির দিকে ধেয়ে গেছে। প্রকৃত অর্থে এই তথ্যটি সর্ম্পূণ মিথ্যা ও বানোয়াট। কারণ ইজেরা গ্রামের সাথে আসালং-তাইন্দং এ বাংলাদেশের প্রায় ১৭শ একর জায়গার সম্পর্ক রয়েছে। যা ভারত গায়ের জোরে দখল করে রেখেছে।

আসালং তাইন্দং থেকে নেমে আসা ছড়া আমলীঘাটের এখানটাতেই সাগরনাইয়া ছুয়ে ফেনী নদী নামে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলেছে।

রামগড়ের লাচারীপাড়া, খেদাছড়া, কাঁশিবাড়ি, মহামনি বল্টুরাম টিলা, আনন্দপাড়া, দারোগাপাড়া, সোনাইপুল ও বাগান বাজারের কোল ঘেঁষে চট্টগ্রামের মিরসরাই সীমান্তের আমলীঘাট হয়ে সাগরনাইয়ার জগন্নাথ সোনাপুর ছুঁয়ে শুভপুর, নাঙ্গলমোড়া, ফরহাদনগর দিয়ে (প্রায় ১১৬ কিলোমিটার পানি প্রবাহের পর) বুবুড়িয়াঘাটে এসে ফেনী নদী আর মুহুরী নদী মিলে বঙ্গোপসাগারের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে রূপ নেয়। প্রায় ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর ১০৫ কিলোমিটারই সীমান্ত এলাকার বাইরে বাংলাদেশের ভেতরের মূল ভূ-খন্ডের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত। বাকী ১৩ কিলোমিটার নদী পথ অর্থ্যাৎ উৎপত্তিস্থল ভগবান টিলা ও আসালং-তাইন্দং থেকে আমলীঘাট সীমান্তের আগ পযর্ন্ত অমীমাংসিত জায়গা বা বির্তকিত “নো ম্যানস ল্যান্ড”।

এক্ষেত্রেও ভারত ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চল থেকে আলীগঞ্জ পযর্ন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারত বাংলাদেশের সীমান্ত রেখা তৈরি করেছে বলে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে থাকে।

ভৌগলিক অবস্থান: পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্বত শ্রেণিতে ২৩.২০’ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯১.৪৭’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে উৎপত্তি হয়ে ফেনী নদী রামগড় পযর্ন্ত দক্ষিণ পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে পাহাড়ি নিবাস শেষে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা থেকে চট্টগ্রামকে বিভক্ত করে সমভূমি ধরে এগিয়ে ২২.৫০’ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯১.২৭’ পূর্ব দ্রাঘিমাতে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে। উৎসমূল থেকে বঙ্গোপসাগর পযর্ন্ত নদীটির দৈর্ঘ্য ১১৫.৮৫ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগর থেকে রামগড় পযর্ন্ত ৮০.৪৫ কিলোমিটার ছাড়া বাকী অংশে শুধুমাত্র ছোট নৌকা চলাচলের উপযোগী।

ফেনী নদীর নামকরণ: ফেনী” রাজার নামানুসারে ফেনীর নাম করা হয় বলে অনেকে মনে করেন। আর মৌর্য বংশের শাসনামলে একদিন অবস্থানকারী চীনা পর্যটক, ফাহিয়েনের নামানুসারে কালক্রমে ফাহিয়েনী থেকে ফেনী নামকরণ হয় বলেও কারো কারো বিশ্বাস। তবে, স্থানীয় গবেষকদের মতে, মূলত সাগরনাইয়ার কিছু অংশ, সোনাগাজী এবং ফেনী সদর পুরোটাই ছিল বঙ্গোপসাগরের উপকুলীয় চর। তখন সাগরের ফেনা আচ্ছাদিত করে রাখতো এই উপকুলীয় চরকে। কালের বিবর্তনে সাগর উপকূলে গড়ে ওঠে জনবসতি। আর তারই ধারাবাহিকতায় ফেনীর নামকরণ হয়। সেই সাথে ভৌগলিক অবস্থানে এ অঞ্চলের বুক চিরে প্রবাহিত নদীর নামও হয়েছে ফেনীর নামনুসারে। স্থানীয়দের কাছে ‘ফেনী নদী’ বড় ফেনী নদী নামে পরিচিত। কারণ ফেনীর দাগনভুঁইয়ার উপর দিয়ে প্রবাহিত ‘ডাকাতিয়া খাল’ ছোট ফেনী নদী হিসেবে পরিচিত এখানকার মানুষের কাছে।

ফেনী নদী নিয়ে বিতর্কের শুরু : দেশ বিভাগের আগে ১৯৩৪ সালে ভারত, ফেনী নদীর পানি নেয়ার দাবি ওঠায় বলে কেউ কেউ মন্তব্য করলেও মূলত: ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পযর্ন্ত নানা কৌশলে “নো ম্যানস ল্যান্ড” ও “ট্রান্সবাউন্ডারির” অজুহাতে আর্ন্তজাতিক নদী প্রবাহের অংশ দেখানোর চেষ্টা করে তারা। ১৯৬১ সালের দিকে এসে প্রথম আসালং ও তাইন্দং মৌজার প্রায় ১৭শ একরের বিশাল জায়গা দখল করে নেয় ভারত। ১৯৬২ সালে সীমান্ত রেখা ও ফেনী নদীর উৎসকে কেন্দ্র করে আসালং-তাইন্দং এ ভারত-পাকিস্থান দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ৬২’র ২৮ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) এর ১১ উইংয়ের ক্যাপ্টেন সি আর দত্তের (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের মহাসচিব) নেতৃত্বে বিএসএফের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ভূমিটি পুনরুদ্ধার করা হয়। ১৭ দিনের এ যুদ্ধে ইপিআরের এক হাবিলদার ও তিন সিপাহি শহীদ হন। এখনো সেই যুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে ইপিআর পরে বিডিআর এবং বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবির তাইন্দং বিওপির পাশে বাজার সংলগ্ন স্থানে হাবিলদার গোলাম রসুল, সিপাহি আবদুল খালেক, আবদুল জলিল ও মোহাব্বত খানের কবর এবং স্মৃতিস্তম্ভ।

আসালং যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ব্যর্থ হয়ে যায় ঐ সময়ে ভারতে সব ধরনের কৌশল ও কূটনৈতিক চেষ্টা। কিছুতেই জবরদখলে রাখতে পারে নি বাংলাদেশের এই ভূমিটি। এরপর, ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের সীমা রেখা মেনেই ৭১ এর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। আর তারই ধারাবাহিকতায় মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে ফেনী নদীর উৎস আসালং-তাইন্দং ছড়াটি সীমান্ত রেখার ভেতরে বাংলাদেশ অংশে ছিল। ১৯৮৬’র দিকে শান্তি বাহিনীর অত্যাচার ও অব্যাহত নাশকতার কারণে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ঐ দূর্গম এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার। জনশূন্যতার এই সুযোগে ভারতীরা বিএসএফের সহযোগিতায় আসালং তাইন্দং এলাকায় ফেনী নদীর উৎস মুখে কৃত্রিম বাঁধ ও খাল কেটে এর প্রকৃত গতি পথ পরিবর্তন করে। খাগড়াছড়ির আসালং-তাইন্দং থেকে ভারতের ইজেরা গ্রাম পযর্ন্ত কোথাও কোথাও নিজেদের মূল সীমানার ভেতরে, আবার কোথাও আর্ন্তজাতিক সীমান্ত রেখা “নো ম্যানস ল্যান্ডের” উপর দিয়ে খননের মাধ্যমে ফেনীর নদীর গতি পথ ঘুরিয়ে দেয়। সেই সাথে ঐ এলাকার প্রায় ১৭শ একর জায়গা দখল করে নেয় তারা। মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তাইন্দং ইউনিয়নের ১৮৩ নম্বর আসালং ও তাইন্দং মৌজার এই ১৭০০ একর ভূমি ৮৬র ঐ সময়টাতেই দ্বিতীয়বার দখলে নেয় ভারত। বিশেষ করে বর্তমানে আন্তর্জাতিক সীমারেখা হিসেবে চিহ্নিত মূল ফেনী নদীর বিপি ২২৬১ নম্বর সীমান্ত পিলার সংলগ্ন অংশে বাঁধ দিয়ে নতুন নালা খনন করে। নদীর জলধারা সীমান্ত থেকে বেশ ভেতরে (বাংলাদেশ ভূখ-ের কয়েক হাজার গজ) প্রবহমান ছোট ফেনী ছড়া খালের সঙ্গে সংযোগ করে দেয়। এতে করে মূল নদীর নিচের অংশ শুকিয়ে যায়। তখন মাটি ও আবর্জনা দিয়ে ভরাট করা হয় নদীর বেশির ভাগ অংশ। এরই সূত্র ধরে তারা মূল ফেনী নদী ও ছোট ফেনী ছড়া খালের মধ্যবর্তী বাংলাদেশের এই বিশাল জায়গা দখল করে এবং ছোট ফেনী ছড়া খালকে সীমান্ত নদী হিসেবে দেখানোর চক্রান্ত শুরু করে। দখল করা ঐ ভূমির বেশির ভাগই বনাঞ্চল ঘেরা টিলা ছিল। এর মধ্যে কৃষিজমিও ছিল প্রায় দুই শতাধিক একর। এসব এলাকায় গড়ে তোলা হয় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বসতি। ভোটার তালিকায় নাম অর্ন্তভুক্তির মাধ্যমে এদের দেখানো হয় ভারতীয় নাগরিক হিসেবে।

১৯৯০ সালের জরিপে ভারতীয়দের খনন করা ছোট ফেনী ছড়া খালকে মূল ফেনী নদী হিসেবে দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সীমারেখা চিহ্নিত করা হয়। এভাবেই ১৯৩৪ সালের মানচিত্রের আন্তর্জাতিক সীমারেখা পরিবর্তন করে ভারতকে বাংলাদেশের ভূমি দখলে রাখার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

এরপর ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঐ এলাকা সরেজমিন পরির্দশন না করে ভারতীয়দের উপস্থাপিত নথিপত্রের মাধ্যমে ফেনী নদীর উৎসমুখে কৃত্রিম বাঁধ ও খালকে দু’দেশের সীমান্ত রেখা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। দেশীয় অযোগ্য ও ভারতমুখী কর্মকর্তাদের খাম-খেয়ালীপনার কারণে আসালং-তাইন্দং এর এই বিশাল ভূ-খন্ড বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যায়। তখনই ভারত দ্রুত বাংলাদেশের ভূ-খন্ডের উপর সীমান্ত পিলার নির্মাণ করে দখল পাকাপোক্ত করে। ১৯৩৪ সালের আন্তর্জাতিক সীমারেখাকে ১৯৯৫ সালে পরিবর্তনের মাধ্যমে এসব ভূমি স্থায়ী মালিকানা দেখিয়ে দখল করে নেয় তারা।

এর পর, প্রায় দীর্ঘ নয় বছর বিষয়টি গোপন রাখা হয়। ২০০৩ সালে তৎকালীন পানি সম্পদমন্ত্রীর ভারত সফর ও দু’দেশের ভূমি জরিপ কর্মকর্তাদের সরেজমিন পরির্দশনের সময় পুরো বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। মাটিরাঙ্গা সীমান্তের আসালং মৌজার বিশাল এই ভূ-খন্ড গত ২৬ বছরেও উদ্ধার করতে পারেনি বাংলাদেশ।

শুধু তাই নয়, ভারতের দখল করা এসব জমিসহ পুরো আসালং মৌজার ভূমি রেকর্ড বই বা জমাবন্দি বই রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে গেছে। জেলা প্রশাসকের ভূমি রেকর্ড শাখা, মাটিরাঙ্গা উপজেলা ভূমি অফিস, এমনকি সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান অফিসের কোথাও এ জমাবন্দি বইয়ের সন্ধান মিলছে না। ১৯৭৪-৭৫ সালেই ভূমি অফিস থেকে জমাবন্দির বইটি উধাও হয়ে যায় বলে জানা গেছে। ফলে ১৯৮৬ সাল থেকে আসালং মৌজার তিন হাজার ৪১৭ দশমিক ৫ একর জমির খাজনা আদায় করাও সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে একরপ্রতি বার্ষিক তিন টাকা ১৪ আনা পয়সা হারে প্রায় ১৩ হাজার টাকার রাজস্ব কর বঞ্চিত হয়েছে সরকার।

আন্তর্জাতিক নদী প্রমাণের চেষ্টা : ১৯৯৫ সালের মে মাসে ত্রিপুরার সাবরুম মহকুমায় তৎকালীন বিডিআরের খাগড়াছড়ি সেক্টর কমান্ডার এবং বিএসএফের ত্রিপুরার ডিআইজি পর্যায়ে অনুষ্ঠিত সীমান্ত সম্মেলনে আসালংয়ের অপদখলীয় ভূমির ব্যাপারে দুই দেশের সরকারের মধ্যে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ভূমিটি উরংঢ়ঁঃবফ ষধহফ বা অমীমাংসিত ভূমি হিসেবে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার যৌথ সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু ভারত তা অমান্য করে ওই সময়ে অপদখলীয় ভূমির ওপর ফেনী ছড়া বিজিবি ক্যাম্পের বিপরীতে বিপি ২২৫২ নম্বর সীমান্ত পিলার সংলগ্নে জলাইয়া বিএসএফ ক্যাম্প এবং বিজিবির ভগবানটিলা বিওপির বিপরীতে বিপি ২২৬১ নম্বর পিলার এলাকায় ভগবান টিলা বিএসএফ ক্যাম্প স্থাপন করে।

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার আসালং মৌজার অপদখলীয় ঐসব সম্পত্তি নিজেদের দখলে রাখতে সশস্ত্র পাহারা বসিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ।

ভারত ইতিমধ্যে সেখানে অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে। সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ’র দুটি ক্যাম্প, বৈদ্যুতিক খুটি ও চলাচলের জন্য পাকা রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করেছে তারা। ভারতীয় নাগরিকরা চাষাবাদ করছে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি। এসব জমিতে আগে মাটিরাঙ্গার বগাপাড়া ও সর্বেশ্বরপাড়ার বাসিন্দারা ধানসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করত। কিন্তু এখন উর্বর এসব ভূমি অবৈধ্যভাবে ভোগ করছে ভারতীয়রা।

মাটিরাঙ্গার যামিনিপাড়ায় বিএসএফ দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কড়া পাহারায় থাকে। রাতে পুরো এলাকায় জ্বালিয়ে রাখা হয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক সার্চলাইট। বেসামরিকসহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর চলাচল রয়েছে এই এলাকায়। এমনকি সীমান্তের কোথাও কোথাও বাংলাদেশের নাগরিকদের এ নদীর পানি ছুঁতেও দেয়া হয় না। “নো ম্যানস ল্যান্ড” অ্যাখ্যা দিয়ে বিএসএফ বাংলাদেশীদের ফেনী নদীর পানি ব্যবহারে বাধা দেয়। কিন্তু ভারতীয়রা দিব্যি ব্যবহার করছে এর পানি। অন্যদিকে, জোর করে খাল কেটে আর্ন্তজাতিক সীমান্ত রেখার উপর দিয়ে প্রবাহিত করে দেয়া, ফেনী নদীর ভাঙ্গনে রামগড়, মিরসরাই ও সাগরনাইয়ার বিশাল এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

এছাড়া ত্রিপুরার অমরপুর থেকে সাবরুমের আমলিঘাট পযর্ন্ত নদীর পাড় সংরক্ষণ বাঁধের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তারা। ২০০৩ সালে ভারত বাঁধের কাজ শুরু করলেও আমলীঘাট এলাকায় বাংলাদেশের বিডিআরের বাধার মুখে তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এ বাঁধ নির্মিত হলে ফেনী নদীর বাংলাদেশ অংশে ভয়ঙ্কর ভাঙন দেখা দিবে।

শুধু তাই নয়, নদীর তীরে গ্রোয়েন, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ এবং নদীতে বড় বড় ব্লক ফেলে, বাংলাদেশ অংশের ভাঙনকে ত্বরান্বিত করছে প্রতিনিয়ত। ফলে নদীর ওপার ভরাট হয়ে, ভাঙ্গছে বাংলাদেশ অংশ। এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে। মিরসরাই ও সাগরনাইয়ার দিকে নদী ভাঙনে মানুষ হারাচ্ছে ঘরবাড়ি-স্বহায়-সম্ভল। আর ভারতের দিকে গড়ে উঠছে নতুন বসতি। ফলে, যতই নদী ভাঙ্গন হচ্ছে ততই ভারতের সীমান্ত রেখা বাংলাদেশের ভেতরের দিকে এগিয়ে আসছে। এভাবে বাংলাদেশের বেশ কিছু অংশ ভারতে চলে গেলেও নদীতে বাংলাদেশীদের নামতেই দেয় না বিএসএফ।

পানি বিশেষজ্ঞ ও ভূমি জরিপ কর্মকর্তাদের অযোগ্যতার কারণে বাংলাদেশের নিরবতায়, যেহেতু ভারত আর্ন্তজাতিক ভাবে ফেনী নদীকে “নো ম্যানস ল্যান্ড” বা “ট্রান্সবাউন্ডারী ওয়াটার সোর্স” প্রমাণের নানা কৌশল চালিয়ে যাচ্ছে, সেহেতু এই সুযোগ গুলোকে কাজে লাগিয়ে ফেনী নদীকে আর্ন্তজাতিক নদী হিসেবে দেখানোর দাবি জোরালো করছে বন্ধু রাষ্ট্রটি।

নিজস্ব চাহিদা মেটাতে ভারতের বিভিন্ন পরিকল্পনা : অন্যদিকে অব্যাহত নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে রামগড়সহ বিভিন্ন পয়েন্ট বাংলাদেশের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা বিএসএফ’র বাধার মুখে বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। উল্টো ভারত নিজেদের অংশে নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ র্নিবিগ্নে চালিয়ে যাচ্ছে। আর এর পেছনে ইন্দ যোগাচ্ছে ত্রিপুরার রাজ্য সরকার। কারণ পুরো ত্রিপুরায় রয়েছে ব্যাপক পানি সংকট। পানির নানা মুখি সংকট মোকাবেলায় ভারতের ত্রিপুরার রাজ্য সরকার আমলীঘাট সেচ প্রকল্প, শিলাছড়ি থেকে আমলীঘাট পযর্ন্ত ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থা এবং সাবরুম শহরে খাবার পানি সরবরাহের জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্টসহ ১৪টি সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ত্রিপুরার আমলীঘাট, শ্রীনগর, করিমাটিলা, হুয়াংবাড়ি, সমরগঞ্জ হয়ে মনুবাজার পযর্ন্ত সীমানার প্রায় ২০ থেকে ২৫ মাইল এলাকায় সেচ কার্যক্রম এবং খাবার পানি সরবরাহের জন্য এসব প্রকল্প হাতে নিচ্ছে তারা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ফেনী নদীর উপর ১৫০ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণের উদ্দেশ্যে “ডিটেইল্ড প্রজেক্ট রিপোর্ট” তৈরি শুরু করেছে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার। বঙ্গোপসাগর থেকে সাবরুমের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। ভারত চাইছে সাবরুমে নৌবন্দর স্থাপন করে নতুন সংযোগ খাল খননের মাধ্যমে একে বঙ্গোপসাগরের সাথে যুক্ত করতে।

ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারে ক্ষয়ক্ষতি: এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হলে শুষ্ক মৌসুমে নদী তীরবর্তী চট্টগ্রামের মিরসরাই,খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলা, ফেনীর সাগরনাইয়া, পরশুরাম, সোনাগাজী, মুহুরী সেচ প্রকল্প, ফুলগাজী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের দক্ষিণাংশ এবং নোয়াখালী-লক্ষীপুরের কিছু অংশের বিভিন্ন সেচ প্রকল্পে পানির জোগান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এতে করে লাখ লাখ হেক্টর জমি চাষাবাদের অনাবাদি হয়ে পড়বে। অকার্যকর হয়ে পড়বে ১৯৮৪ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের হাত ধরে তৎকালীন ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প “মুহুরী”।

যার আওতায় এ অঞ্চলের প্রায় ১৪ থেকে ১৫টি উপজেলার ৮/৯ লাখ হেক্টর জমিতে লোনামুক্ত পানির সরবরাহ করা হয়। যার মাধ্যমে শুধুমাত্র ফেনীর ৬টি উপজেলায় বছরে অতিরিক্ত প্রায় ৮৬ হাজার মেট্টিকটন ফসল উৎপাদন হয়। এ প্রকল্পের আওতায় যেখানে ফেনী, মুহুরী ও কালিদাস পাহালিয়া- এ তিনটি নদীর পানি দিয়ে ৮/৯ লাখ হেক্টর জমির সেচকাজ করার কথা, সেখানে এখনই শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে ২৩ হাজার হেক্টর জমিতেও সেচ দেয়া সম্ভব হয় না। মুহুরী সেচ প্রকল্পের প্রায় ৮০ ভাগ পানির মূল উৎস “ফেনী নদী”।

ফেনী থেকে ২৫ কিলোমিটার ও চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিলোমিটার এবং সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-ফেনী জেলার সীমানায় মুহুরী সেচ প্রকল্পটির অবস্থান। এখানে গড়ে ওঠা দিগন্ত বিস্তৃত চিংড়ি ঘেরগুলো ধংস হবে। মুহুরী, সিলোনিয়া, পিলাকসহ প্রায় শতাধিক ছোট-বড় নদী, খাল ও ছরায় পানি শূন্যতা দেখা দেবে। এক দশক আগ থেকেই সাগরনাইয়া উপজেলার যশপুর খাল, সাগরনাইয়া ছড়া, ফুলছড়ি খাল, হিছাছড়া,মন্দিয়া খাল,জংগলমিয়া খাল,পান্নাঘাট খালসহ অসংখ্য খালের তলা শুকনো মওসুমে পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এছাড়া মুহুরী প্রকল্পের নয়নাভিরাম পর্যটন সম্ভাবনা হারিয়ে যাবে নিমিষেই।

হুমিকর মুখে পড়বে কয়েক লক্ষ হেক্টর জমির গাছপালা। ফেনী নদী, মুহুরী ও কালিদাশ পাহাড়িয়া নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মৎস্য খামার বন্ধ হয়ে যাবে। যা থেকে উৎপাদিত মাছ দিয়ে পুরো চট্টগ্রামের ৭০ ভাগ মৎস্য চাহিদা পুরন করা যায়। বছরে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার মৎস্য উৎপাদন হয় এ প্রকল্পের পানি দিয়ে। নদীর তীরবর্তী ২০-২২ হাজার জেলে পরিবারের জীবন-জীবিকা অন্ধকারের মুখে পড়বে। বিলিন হয়ে যাবে বিরল প্রজাতির মাছ ও পশু-পাখি। সামুদ্রিক লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে ধংস হবে, সবুজ বনায়ন। দেখা দেবে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্যহীনতা। বেকার হয়ে যাবে লক্ষাধিক কর্মজীবী মানুষ। সব কিছু হারিয়ে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে পথে বসবে প্রায় ২০ লাখ পরিবার। সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধকোটিরও বেশী মানুষ।

ফেনী নদীর বালু মহাল ইজারার মাধ্যমে প্রতি বছর সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। ভারতের সঙ্গে চুক্তি হলে এ নদীতে পানি সঙ্কটের কারণে বালি উত্তোলন প্রক্রিয়াও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। হুমকির মুখে পড়বে ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলার হাজার হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।

ভারত পানি সরবরাহের জন্য বাঁধ তৈরি করতে এরই মধ্যে ৯০% ব্লক তৈরির কাজ শেষ করেছে। এসব ব্লক দিয়ে নদীতে বাঁধ দেয়া হলে করেরহাট ইউনিয়নের ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড নদী ভাঙনে বিলীন হবে। অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে ফেনী নদী। “চোর-ডাকাত হানা দিলে কিছু না কিছু থাকে, আগুনে পুড়ে গেলে ভিটেমাটি রক্ষা পায়; কিন্তু নদী ভাঙ্গন কেড়ে নেয় সবকিছু। নদীগর্ভে বিলীন হয় সবই। গত ১০ বছরে ফেনী নদীর ওপারে (ভারত সীমান্তের দিকে) ১০ গজ জায়গাও নদী ভাঙ্গনে পড়েনি । অথচ বছরের পর বছর এপারে ফেনী নদীর ভয়াল গ্রাসে বাংলাদেশ সীমান্তের করেরহাট এলাকায় কয়েকশ’ বাড়িঘর ও ফসলি জমি বিলীন হয়েছে। হারিয়ে গেছে এ অঞ্চলের একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আমলীঘাট বাজার। নদীর ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে মিরসরাইয়ের ৪নং ধুম ইউনিয়নের মোবারকঘোনা ও শুক্কুরবারইয়াহাট গ্রাম আর সাগরনাইয়ার জগন্নাত সোনাপুর,নাঙ্গলমোড়া ও ফরহাদনগর। এসব গ্রামের হাজারো মানুষ, কেউ রাস্তার পাশে ঝুপড়িতে কেউবা বস্তিতে মাথাগোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-তুফান এদের জীবনে সবই সমান। করেরহাটের অলিনগর ও আমলীঘাটে প্রতিমুহূর্তেই নদীর তীব্র ভাঙ্গনে তলিয়ে যাচ্ছে কৃষিজমি।

স্বাভাবিক নাব্যতা হারানোর কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের অন্যতম ৩৭৪ মিটার দীর্ঘ শুভপুর ব্রিজ এলাকায় শুকনো মৌসুমে ১০০ মিটারেরও কম পানির গভীরতা নেমে আসে। এ সময়ে ফেনী নদীতে গড়ে পানি থাকে ৪০০ কিউসেক।

চুক্তি ছাড়াই ফেনী নদী থেকে পানি তুলে নিচ্ছে ভারত: আর্ন্তজাতিক সীমান্ত আইন অনুযায়ী, সীমানার ১৫০ গজের মধ্যে কোনো স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ অবৈধ। অথচ ফেনী নদী থেকে ৩০-৫০ গজ দূরে স্থায়ী ভাবে পাম্প হাউজ নির্মাণ করেছে ভারত। মানুষের নজর এড়াতে বেশির ভাগ পাম্পই মাটির নিচে বসিয়ে টিনের ঢাকনা দিয়ে রাখা হয়েছে। এসব পাম্পের সাহায্যে ত্রিপুরার সাবরুম মহুকুমার সীমান-এলাকার কয়েক হাজার একর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে ফেনী নদী থেকে জোর করে তুলে নেয়া পানি দিয়ে। নদী সংলগ্ন ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎচালিত প্রায় ২৬-২৮টি লো-লিফট পাম্প বসিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭৫ কিউসেকেরও বেশি পানি তুলে নিচ্ছে তারা। এ কারণে ইতিমধ্যে সাগরনাইয়ার প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে ধান চাষ করতে পারছে না এখানকার চাষিরা।

ত্রিপুরার উপেন্দ্রনগর (আমলীঘাট নামেই সর্বাধিক পরিচিত) এলাকার সোনাইছড়া খাল দিয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরে “পানিঘাটা” নামক স্থানে পানি নিয়ে যাওয়ার জন্য এসব পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে ভারত। ওই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে বিশালাকৃতির বেশ কয়েকটি পাইপও স্থাপন করা হয়েছে ঐ এলাকায়। পাইপের বিশালাকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাইপগুলোর ভেতর দিয়ে যে কোন মানুষ হেঁটে যেতে পারবে। ভারত ইতোমধ্যে ৫০ ফুট গভীর পাম্প হাউজ এবং ২০০ ফুট দীর্ঘ রিজার্ভার নির্মাণ করে এর সাপ্লাই লাইন বসিয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ৭০০ মিলিয়ন রুপি বরাদ্দ দিয়েছে।

এছাড়া গোমতী ও মুহুরী নদীর ভারতীয় অংশে “ক্লোজার ড্যাম” নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ইতিমধ্যে আসাম রোডের কালাশিমুখে বাঁধের নির্মাণ কাজ চলছে। মুহুরীর ভারতীয় অংশের নিজকালিকাপুরে ‘স্পার’ নির্মাণের ফলে যে কোন মুর্হূতে নদীটির গতি পথ পরিবর্তন হতে পারে। মুহুরী সেচ প্রকল্পকে অকার্যকর করতে এসব বাঁধ এবং স্পার ভূমিকা রাখবে।

যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক : ত্রিপুরা রাজ্যে খাওয়ার পানির সংকট দীর্ঘদিনের। সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ফেনী নদীর পানি খুবই স্বচ্ছ। পাহাড়ি র্ঝণার মাধ্যমে সারা বছর এ নদীতে অঢেল পানি আসে। এ কারণে নদীটির পানি অনেকাংশে বিশুদ্ধ। ২০০৩ সালে ভারত তাদের ত্রিপুরা রাজ্যের খাওয়ার পানির সংকট মোকাবিলা ও সেচকাজে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে ফেনী নদীর পানি-বণ্টন চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন এ বিষয় চুড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত হয় নি।

বিগত জোট সরকারের আমলে ঢাকায় জেআরসির মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠকে তৎকালীন ভারতীয় পানিসম্পদমন্ত্রী ফেনী নদীর ওপারের (ত্রিপুরা রাজ্যের) মানুষের জন্য ৪০ কিউসেক পানি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের কাছে। কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় ফেনী নদী নিয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি। পরে, ২০০৫ এ, ঢাকায় অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের ৩৬তম অধিবেশনে ফেনী নদীর পানি বণ্টনে দুই দেশ সম্মত হয়। নদীর প্রবাহের জন্য ২০ শতাংশ রেখে অবশিষ্ট পানি সমহারে বণ্টনের জন্য প্রস্তাব করা হয়। তা নিয়ে তেমন কোন অগ্রগতি হয় নি, তিস্তার পানির ন্যায হিস্যা চাওয়ার কারণে।

অতীতে ভারত যে কাজ করতে ব্যর্থ হয় সেটা তারা বাস্তবায়ন করে এবারের ক্ষমতাসীন সরকারের সময়ে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় দুই দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের বৈঠকে ফেনী নদী থেকে এক কিউসেক পানি বণ্টনের বিষয়ে সমঝোতা হয়। নয়াদিল্লিতে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক বসে ১৮-১৯ মার্চ ২০১০। ২০ মার্চ নেট ইন্ডিয়ান নিউজ নেটওয়ার্ক ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, ফেনী ও মুহুরী নদী থেকে ভারতের পানীয় জল সংগ্রহ এবং ভারতে কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় পানি উত্তোলনে আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রী বাবু রমেশ চন্দ্র সেন সম্মত হয়।
ত্রিপুরার উপেন্দ্রনগর ও সাবরুম অঞ্চলের বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে প্রতিদিন ৭০ কিউসেক পানি ভারতকে দেয়া হবে। তবে সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য কোনো পানি দেয়া হবে না। প্রতিদিন ৭০ কিউসেকের বেশি পানি ভারত নিচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণের জন্য জেআরসি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের বিশেষ দল পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়।

যার অংশ হিসেবে ড.মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় তিস্তাচুক্তির সাথে ফেনী নদীকে জুড়ে দেয়া হয়। ভারতের দাবি অনুযায়ী, ফেনী নদী থেকে বাংলাদেশ পানি দিতে সম্মত হলে তার বদলে ভারত নদীর ভাঙন রোধে সহায়তা করার প্রস্তাব করে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে ‘লোয়ার রাইপেরিয়ন’ থেকে পানি টেনে উজানে নিয়ে যাওয়ার ভারতীয় দাবি আর্ন্তজাতিক মানদন্ডে কতটুকু যৌক্তিক, তা খতিয়ে দেখা। ভারতের পানি প্রভুত্বের প্রমাণ জোগাড় করা। দিল্লি, ঢাকা আর কলকাতায় বসে যৌথ নদী কমিশন ৪০ বছর ধরে ফারাক্কার পানি নিয়ে যে তাত্ত্বিক গবেষণা করেছে, তাতে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশে ইতোমধ্যেই মরুকরণ দেখা দিয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের সদস্যরা ফারাক্কার উজানে গিয়ে কখনও দেখে আসেনি গঙ্গার পানি কেমন করে হলদিয়া নদীতে যায়- পাঞ্জাব, হরিয়ানায় যায়। পানি যদি উজানেই টেনে নিয়ে যাওয়া হয় একতরফাভাবে, তাহলে ফারাক্কার পানি নিয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি তো ‘বানরের পিঠা ভাগাভাগি’র মতোই হবে, ঠিক তেমনি অবস্থা হয়েছে ফেনী নদীর ক্ষেত্রেও।

ফেনী নদীর পানিসহ বাংলাদেশের কাছ থেকে একতরফা স্বার্থ আদায়ের পর যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠকে আর বসতে রাজি হচ্ছে না ভারত। গেল সাত বছরে বেশ ক’বার জেআরসি’র বৈঠকের সিদ্ধান্ত থাকলেও ভারতের পক্ষ থেকেই স্থগিত করা হয় সেসব বৈঠক। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১৮ জুন ঢাকায় নির্ধারিত জেআরসি’র বৈঠকটিও স্থগিত করা হয়। গত দু’বছর ধরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশক’বার জেআরসি’র ৩৮তম বৈঠকের তাগাদা দিয়ে চিঠি দেয়া হলেও কোন ধরনের সাড়া মেলেনি বন্ধুপ্রতিম দেশটির তরফ থেকে। আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে ভারতের আসল চেহারা। টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গ, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি ও গঙ্গাচুক্তির পর্যালোচনাসহ অভিন্ন নদী বিষয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে বারবার চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানানো হলেও ভারত এতে আর সাড়া দিচ্ছে না। ফেনী নদী থেকে পানি নেয়ার বিষয়ে চুক্তির আগ পর্যন্ত ভারতই দুই দেশের মধ্যে বৈঠকের বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখাত। ভারত কৌশলে বাংলাদেশের কাছ থেকে ফেনী নদীর পানি নেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে। এ নদী থেকে দিনে পৌনে দুই কিউসেক পানি নেয়ার কথা থাকলেও তারা মূলত এখন প্রতিদিন ৭৫ কিউসেক পানি তুলে নিচ্ছে।

ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন, নদী ভাঙন রোধ, জেগে ওঠা চরের মালিকানা নির্ধারণসহ বিরাজমান এ সংক্রান্ত অন্যান্য সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সম্মত করতে ভারতের তাগিদেই মাত্র দুই বছরে জেআরসির ৭টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর থেকেই এ কমিশনের বৈঠক বিষয়ে ভারত আর আগ্রহ দেখায়নি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রথম দুই বছরে ভারতের প্রয়োজন ছিল বলেই তারা তাগাদা দিয়ে ৭টি বৈঠক করিয়েছে। পরে ৩৭ বছরে সর্ব সাকুল্যে বৈঠক হয়েছে মাত্র ৩০টি জেআরসির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যদিও বছরে ৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। উভয় দেশের এ সংক্রান্ত যৌথ ঘোষণার ৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী অববাহিকার উন্নয়ন এবং জলবিদ্যুৎ শক্তি ও সেচ ব্যবস্থা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা ও যৌথ কার্যক্রম গ্রহণে উভয় দেশ একসঙ্গে কাজ করবে। এছাড়া উভয় দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর ব্যাপক জরিপ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উভয় দেশের জন্য প্রকল্প প্রণয়ন ও সেগুলোর বাস্তবায়নের উদ্দেশে দুই নদী কমিশন একসঙ্গে কাজ করবে।

আয়তনে ও শক্তির দিক থেকে ভারত যত বড়, প্রতিবেশীকে তার ন্যায্য হিস্যা প্রদানের ব্যাপারে ততই ছোট। ভারত যেমন তার রাজ্য সরকার ও আমলাদের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে আসছে; ঠিক বাংলাদেশ সরকারও তার জনগণ ও বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ব্যাপারে ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। জেআরসিকে অনেকটাই অকার্যকর করে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে বার বার দাবির চেয়েও অতিরিক্ত আদায় করে নিচ্ছে।

বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রী বলেন, ‘ভারত টিপাইমুখে বাঁধ দিলে বাংলাদেশ লাভবান হবে।’ আবার কোনো মন্ত্রী বলেন, ‘ভারত আগে বাঁধ নির্মাণ করুক। তারপর কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা দেখে প্রতিবাদ করব।’ বাংলাদেশের মন্ত্রীদের মুখে এ ধরনের কথা শোনার পর ফেনী নদী কেন, কোন বিষয়েই ভারতের আর জেআরসির বৈঠকে বসার প্রয়োজন থাকার কথা নয়। ভারত না চাইতেই বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশ উজাড় করে দিতে প্রস্তুত। তারা বুঝতে পেরেছে যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব আইনকানুন, রীতিনীতি ভেঙে বাংলাদেশ সরকার নিজেদের তিতাস নদীসহ ১৮টি খাল হত্যা করে এর বুকের ওপর দিয়ে রাস্তা বানিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রের গাড়ি চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছে। কাজেই বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা না দিলে এবং ফেনী নদী থেকে পানি নিয়ে গেলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি উঠবে না।

বস্তুত, নদীর পানিবণ্টন সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতের একটি উদ্দেশ্য ছিল। সেই উদ্দেশ্য পূরণের পর পরই তারা এখন পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছে । বন্ধুত্বের ফলাফল দাঁড়িয়েছে ‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও।’ এ ধরনের দাতা-গ্রহীতা সম্পর্ক যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চালাকি করে বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছে আশাতীত ফায়দা। একইভাবে এবার দু’দেশের শীর্ষ পর্যায়ের সফর ও বৈঠকের পর ফেনী নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ এবং ত্রিপুরা ও বাংলাদেশ অংশে স্থলবন্দর স্থাপনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। এভাবেই কৌশল আর অপকৌশলে বাংলাদেশের ফেনী নদী দখলে নিচ্ছে একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের একমাত্র সহযোগি বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারত।

ফেনীর মানুষের অনুভূতি : দলমত নির্বিশেষে ছাগলনাইয়া, পরশুরাম ও সোনাগজীসহ ফেনীর মানুষ ফুঁসে উঠছে। ফেনী নদীর পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনীর সাগরনাইয়ার মানুষের মধ্যে বেড়েছে উৎকন্ঠা। ভারতের সাথে পানি বন্টনের কি চুক্তি হয়েছে, তা জানতে চায় এলাকাবাসী। বাঁধ হবে নাকি পাইপ দিয়ে পানি নেয়া হবে, তাও পরিস্কার কিছু জানেন না এখানকার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। পানি আগ্রাসনে ফেনী নদী শুকিয়ে যাওয়ার এবং মুহুরী সেচ প্রকল্প অকার্যকর হওয়ার আতঙ্কে রয়েছে নদীর তীরবর্তী সাগরনাইয়ার জনগণ। এ নদীর পানি নিয়ে ‘দাদাগিরি’ রুখে দেয়ার জন্য জীবন-মরণ লড়াইয়ে প্রস্তুত তারা। শুধু চায়, যোগ্য নেতৃত্ব।

মানুষের সেই দাবি ও অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ২০১১ সালে প্রত্যক্ষভাবে মাঠে নামেন ফেনী নদী পাড়ের অসহায় মানুষের নেতা,ত্রিপুরার প্রথম স্বাধীন মুসলিম নবাব শমসের গাজির সপ্তম বংশধর, তৎকালীন জাপা’র অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী। শুরু করেন ফেনী নদীর পানি রক্ষা আন্দোলন। চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। মাঠ পর্যায়ে চলে গবেষণা। খোঁজা হয় নদীর মূল উৎপত্তিস্থল ও প্রবাহের বাস্তবতা। স্থানীয় নদী গবেষক ও জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকদের নিয়ে নদী পথে সরেজমিন পরির্দশন করা হয়, গতিপথের প্রতিটি বাঁক। শুরু হয় স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমে লেখালেখি। প্রাইভেট টিভি চ্যানেলেও প্রচার করা হয় ধারাবাহিক প্রতিবদেন। জেগে ওঠে ফেনীবাসি। দলমত নির্বিশেষে তীব্রতর হয় ফেনী নদীর পানি রক্ষা আন্দোলন। এ আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন ও আস্থা রেখে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে ফেনী নদীর পানি রক্ষা আন্দোলনে সর্বশেষ ২০১২ সালের ৫ মার্চ লংমার্চ করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি,জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাতেও বরফ গলেনি ভারতের

তাই সাগরনাইয়াসহ ফেনীর মানুষের বক্তব্য একটাই…‘জীবন দিয়ালামু, হেনী নদীর হানি ভারতেরে দিতাম ন’
নদীর জন্ম হয় ভূপ্রকৃতি আর জলবায়ুকে কেন্দ্র করে, ফলে তার বিস্তৃতিও হয় প্রাকৃতিক ভাবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই নদী অববাহিকা বা নদীর গতিপথ ও তার প্রবাহ রাজনৈতিক সীমারেখা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। একটি নদীর গতিপথ যখন রাজনৈতিক ভাবে দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে বিভক্ত হয় তখন তাকে “আন্তঃসীমান্ত বা ট্রান্সবাউন্ডারি রিভার” বলে। ট্রান্সবাউন্ডারি নদীগুলোর প্রবাহকে যখন রাজনৈতিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস আসে, তখনই ঐ দেশগুলোর মধ্যে তা নিয়ে সমস্যা শুরু হয়, যা আস্তে আস্তে দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে মোট ৫৮টি ট্রান্সবাউন্ডারি নদী রয়েছে, যার মধ্যে ফেনী, সাঙ্গু, মাতামুহুরি ও নাফ বাদে বাকী ৫৪টিই এসেছে ভারত থেকে। এই ৫৪টি নদীকে অভিন্ন নদী হিসেবে ভারতের সাথে পানি বন্টনের কথা আসে। কিন্তু এক্ষেত্রে “ফেনী নদী” কোনোভাবেই অভিন্ন নদী সীমার মধ্যে পড়ে না।
বাস্তবতা হলো, এই নদীর উৎপত্তির সাথে ত্রিপুরার কোন যোগাযোগ নেই। অর্থাৎ ফেনী নদীর উৎপত্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং রামগড়ের পাশ দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতর ( কোনোভাবেই ভারতের দাবি অনুয়ায়ী নো ম্যানস ল্যান্ড নয়, বরং বাংলাদেশ অংশেই প্রবাহিত ছিল। দিনে দিনে নদী ভাঙনকে ত্বরান্বিত করে সীমানা পরিবর্তনের চেষ্টা করছে ভারত ) দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে।

মোদ্দা কথা, ভারত চোরাগুপ্তা বা চুক্তির মাধ্যমে ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখলে উত্তর ফটিকছড়ি, শুভপুর, সোনাগাজী, মিরসরাই ও পুরো সাগরনাইয়া অচিরেই মরুভুমিতে পরিণত হবে।