অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান বাড়ছে

দেশের বেকার যুব সমাজের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি পোল্ট্রি শিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। সম্প্রতি জয়পুরহাটে রিপোর্টিং অন পোল্ট্রি ইস্যু বিষয়ক এক মিডিয়া ওয়ার্কশপে এর পরিমাণ জানানো হয়েছে। ওই ওয়ার্কশপে জানানো হয়েছে, জাতীয় অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান ২ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সহযোগিতায় ওয়াচডগ বাংলাদেশ এ মিডিয়া ওয়ার্কশপের আয়োজন করে।

পোল্ট্রি শিল্পের সম্প্রসারণ, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও পোল্ট্রি মুরগী ও ডিম নিয়ে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা তুলে ধরে আলোচনা করেন প্রবীণ সাংবাদিক সোহরাব হাসান, পোল্ট্রি শিল্প বিশেষজ্ঞ ড. এস এম এফ বি আবদুস সবুর, রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভেটেনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শশি আহমেদ, যমুনা টিভি’র বিজনেস এডিটর সাজ্জাদ আলম খান তপু, ওয়াচডগের নির্বাহী পরিচালক মো. সাজ্জাদ হোসেন প্রমুখ।

বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের শুরুটা মোটেও আশাব্যঞ্জক ছিল না। পোল্ট্রি’র ডিম কিংবা ব্রয়লার মুরগীর মাংস সাধারণ মানুষ খেতেই চাইতো না। পোল্ট্রি মাংস খেতে সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত তা বুঝাতে উদ্যোক্তাদের অতিথি ডেকে রান্না করা মাংস পরিবেশন করা হতো। আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৫শ’ কোটি, সেখানে বর্তমানে বিনিয়োগ ৩৫ হাজার কোটি ছাড়িয়ে গেছে। তিন যুগের ব্যবধানে পোল্ট্রি শিল্প দেশের একটি আত্মনির্ভরশীল খাত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে পোল্ট্রি মাংস, ডিম, একদিন বয়সী বাচ্চা এবং ফিডের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। সরকারের আন্তরিকতাসহ পোল্ট্রি শিল্প উদ্যোক্তা ও খামারিদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে এ শিল্পের উন্নয়নে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১,১৯০ মার্কিন ডলার। ২০১৪-১৫ সালে হয় ১,৩১৪ ডলার এবং ২০১৫-১৬ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ১,৪৬৬ ডলারে। সরকারের ভিশন অনুযায়ী ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ তাই মাথাপিছু আয় ২,০০০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে এমনটি আশা সরকারের।

দেশের পোল্ট্রি শিল্পে সরাসরি ২০-২৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের মতে ২০৩০ সালে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আবার পোল্ট্রি শিল্পে নিয়োজিত জনশক্তির শতকরা ৪০ ভাগই নারী। ফলে পরিবারে নারীদের স্বাবলম্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ অবদান রাখছে। বর্তমানে জাতীয় অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ। যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সুষম খাদ্যের মধ্যে ডিম প্রথম সারির একটি খাদ্য। ডিম রক্তে লোহিত কণিকা তৈরি করে। ডিমে আছে ভিটামিন এ, ই, বি৬, বি১২, ফোলেট, ফসফরাস, প্রায় সব ধরনের ক্যালসিয়াম, আইরন, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, সেলিনিয়াম, থিয়াসিন, এমিনো এসিড ইত্যাদি। একটি সিদ্ধ ডিম থেকে প্রায় ৮০ ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। বর্তমানে সাধারণ দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জন্য কম দামে প্রাণীজ আমিষের যোগান দিচ্ছে এ শিল্প। শিশুর পেশীগঠন ও মেধার বিকাশ, শ্রমজীবী মানুষের শক্তির যোগান দেওয়া সহ সর্বোপরি স্বাস্থ্যবান জাতি গঠনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্র জানায়, বেকার যুব সমাজের মধ্যে আশার আলো জ্বালানো এই পোল্ট্রি শিল্প গড়ে ওঠার পেছনে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে জামালগঞ্জ সরকারি হাসঁ মুরগী খামার। স্বল্প পুঁজিতে পোল্ট্রি খামার করে লাভবান হওয়া যায় এমন বিষয়টি ছড়িয়ে দিতে তৎকালীন সহকারী পরিচালক শাহ জামাল স্থানিয় যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ উদ্বুদ্ধ করা শুরু করেন। এভাবেই উত্তরাঞ্চলের ছোট জেলা জয়পুরহাট আজ পোল্ট্রি শিল্পে দেশের শীর্ষস্থান দখল করেছে এবং এ শিল্পের সফলতায় জয়পুরহাটসহ দেশব্যাপী প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে হ্যাচারি, ফিড মিল ও পোল্ট্রি খামার। পোল্ট্রি শিল্প গড়ে ওঠার সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে বাচ্চার চাহিদা।

ফলে জয়পুরহাটে বেসরকারিভাবে স্থাপন করা হয়েছে ৩৯টি হ্যাচারী (একদিনের বাচ্চা উৎপাদন কারখানা)। এসব হ্যাচারি থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে একদিনের বাচ্চা উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখ। মুরগির খাদ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গড়ে উঠেছে ১১টি ফিড মিল। প্রতি মাসে এ ফিড মিলগুলোতে উৎপাদন হয় প্রায় ১৪ হাজার মে. টন খাদ্য।

জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার পাঁচ উপজেলায় আড়াই হাজার রেজিস্টার্ড খামারসহ জেলায় প্রায় নয় হাজার ছোট-বড় পোল্ট্রি খামার রয়েছে বর্তমানে। ছোট বড় হিসেবে একেকটি খামারে ২ হাজার থেকে শুরু করে ৮০ হাজার পর্যন্ত মুরগি পালন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে সোনালী জাতের মুরগি জেলায় সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এ শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জেলার দুই লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

জয়পুরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রি’র সহ-সভাপতি ও কিষাণ পোল্ট্রি হ্যাচারি অ্যান্ড ফিড প্রা. লিমিটেডের মালিক জিয়াউল হক জিয়া, শেফালী পোল্ট্রি ফার্মের মালিক সাইফুল ইসলাম আলম, এসএসবি পোল্ট্রি ফার্মের মালিক ইসমাইল হোসেন টুকু, পদ্মা ফিডের মালিক আনোয়ারুল হক আনু মন্ডল, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাসহ পোল্ট্রি শিল্প উদ্যোক্তা ও জেলার সাংবাদিকরা এ ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন।